দেশের স্বাধীনতার জন্য অনেক পরিবার সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে। স্বাধীনতার বেদীমূলে অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছেন এমন পরিবারের সংখ্যা বাংলাদেশে অসংখ্য। এ সকল পরিবারের মধ্যে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, আবার মুক্তিযোদ্ধা পরিবারও আছে। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেছে এখনো নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে; মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দানের নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে; স্বাধীনতার ৫১ বছর পরে আমরা জানতে পারলাম নাটোরের ক্যাপ্টেন হাবিবুর রহমানের পরিবারের কথা। ক্যাপ্টেন হাবিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন এবং তাঁর বড় ছেলে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
মানুষের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো জীবন; দেশের জন্য যাঁরা তাঁদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ জীবনকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন, আজ জাতির কৃতজ্ঞতার সাথে তাদের কথা স্মরণ করার সময় এসেছে। যে সকল পরিবার মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেছে, মুক্তিযুদ্ধে রক্ত অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার-এর জন্য আজ আমাদের বিস্মৃতির অতল থেকে তাদের বীরত্বের কাহিনী, আত্মত্যাগের কাহিনী তুলে আনতে হবে।
সীতারা নাহিদ প্রকাশ নাহিদ নজরুল এই শহীদ পরিবারের সন্তান, তাঁর কাছ থেকেই আমরা জানতে পারলাম মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পরিবারের চরম ত্যাগ ও অবদানের কথা।
সীতারা নাহিদের দাদা ছিলেন আবদুল কাদের মোল্লা। তিনি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ এর বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর পিতা শহীদ ক্যাপ্টেন হাবিবুর রহমান নাটোরে ফুড কন্ট্রোলার ছিলেন ১৯৭১ সালে, মাতা আছিয়া রহমান। ১৯৫০ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ব্রিটিশ গভর্মেন্টের আর্মির কমিশন রেঙ্কে চাকরিরত ছিলেন ক্যাপ্টেন হাবিবুর রহমান। দেশ ভাগ হওয়ার পরে তিনি পারিবারিক কারণে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরে পাকিস্তান সরকার তাঁকে পাঞ্জাবের হুশিয়ারপুর বদলি করে দিয়েছিলো। বছর খানেক পরে পারিবারিক কারণে তিনি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে নাটোরের অফিস থেকে পাঞ্জাবিরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায় মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিংÑএ সহযোগিতা এবং খাওয়া-দাওয়া আশ্রয়সহ সহ বিবিধ সহযোগিতা করার অভিযোগে; দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। জানা যায়, নামে মওলানা হাফেজ, যিনি একজন রাজাকার কমান্ডার ছিলেন, তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী শহীদ ক্যাপ্টেন হাবিবুর রহমানকে ধরে নিয়ে গুম করে ফেলেছিলো পাঞ্জাবীরা।
সীতারা নাহিদ ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফরিদপুর গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে এসএসসি এবং পরবর্তীকালে ঢাকার হোম ইকোনমিক্স কলেজ থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রী পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস কমিউনিকেশন ও জার্নালিজম বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ১৯৭৮ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। ফ্যামিলি প্লানিং, বিসিক, পপুলেশন রিসার্সার-এর পদে বেশ কিছুদিন চাকরি করেন। এরই মধ্যে তিনি ১৯৮৩ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশন স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা চলে যান এবং সেখানে সেটল্ড্্ হন। সেখানেও তিনি বসে থাকেন নি। ঢেঁকির স্বর্গে গেলে ধান ভানার মতো সেখানে গিয়েও তিনি আমেরিকায়, বিশেষ করে বোস্টন, নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সংগঠিত করছেন।
সীতারা নাহিদ একজন সমাজকর্মী, সংগঠক ও সাংবাদিক, বর্তমানে তিনি নিউ ইংল্যান্ড বাংলাদেশী-আমেরিকান ফাউন্ডেশন (নিবাফ) এর পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। এছাড়াও ফ্রিল্যান্সিং জার্নালিজম এবং ১৯৯৪ সাল থেকে তিনি নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ঠিকানা পত্রিকার সাথে যুক্ত আছেন।
১৯৬৯ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সৈয়দ খোরশেদ আলমের সাথে। তাঁর স্বামী সৈয়দ খোরশেদ আলম বিসিআইসিতে চাকরি করতেন। তাঁর শেষ পোস্টিং ছিল ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানায় ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার পদে। ১৯৯০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সীতারার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। তারা আমেরিকায় বসবাস করছেন।
তিনি সেখানে বাংলাদেশি কমিউনিটির অবিসংবাদিত নেত্রী হিসেবে বাংলাদেশি অভিবাসীদের নানা সমস্যা যেমন পাসপোর্ট, ভিসা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি নানা সমস্যার তিনি সমাধান দিয়ে থাকেন। তিনি বাংলাদেশিদের চিত্তবিনোদনের জন্য মেলা, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, মুক্তিযুদ্ধ উৎসব, বিজয় উৎসব, মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পী সম্মাননা প্রদানের রেওয়াজ চালু করেছেন।
সীতারা নাহিদের তিন ভাই চার বোন। ভাই হাফেজ মাহবুবুর রহমানও একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। তিনি ১৯৬৪ সালে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজেও ছাত্রলীগের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টার পাস করেন।
পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা পলিটেকনিক-এ ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের মার্চে তিনি নাটোরে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বাবা শহীদ হওয়ার কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি আর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব তিনি তাঁর কাঁধে তুলে নেন। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন। তার একটি মেয়ে রয়েছে।
সীতারা নাহিদ পিতা-মাতার দ্বিতীয় সন্তান; তৃতীয় হাসিনা চৌধুরী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক ইতিহাসের উপরে এমএ করেন। তাঁর স্বামী আজিজ চৌধুরীর বাড়ি সিলেট। তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তাদের দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
ভাইবোনদের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন জনাব হাফেজ মাসুদুর রহমান। তিনি বায়োকেমিস্ট্রি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে দেশের ক্রান্তিলগ্নে দুঃসাহসিক অপারেশনে তিনি শহীদ হন।
পঞ্চম শাহানা পারভীন, তিনি সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে এমএ শেষ করেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করছেন। তাঁর দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
ষষ্ঠ ছিলেন হাফেজ মনসুর রহমান, তিনি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করছেন এবং সেখানেই কর্মরত আছেন। তাঁর একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
সপ্তম সীতারা নাহিদের ছোট বোন তাহেরা আহমেদ। বর্তমানে তিনি আমেরিকায় বসবাস করছেন।তার স্বামী মারুফ আহমেদ খোরশেদ। তাঁদের এক মেয়ে ও এক ছেলে।
###