ঢাকায় দেশের প্রথম ও ব্যয়বহুল মেট্রোরেল প্রকল্পে নিরাপত্তাঝুঁকি দেখা দিয়েছে। রোববার (২৬ অক্টোবর) ফার্মগেটে মেট্রোরেলের পিলার থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারী নিহত হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনা চলছে ব্যয়বহুল এই প্রকল্প নিয়ে।
বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প এমআরটি লাইন-৬ অনুমোদন পায় ২০১২ সালে। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণে শুরুতে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। পরে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেলের পথ নির্মাণে খরচ প্রায় এক হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, যা আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।
বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল চলাচল করছে। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলছে।
ব্যয়বহুল গণপরিবহন মেট্রোরেলের নিরাপত্তাঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতো ব্যয়বহুল প্রকল্পে নিরাপত্তাঝুঁকি অস্বাভাবিক। এসব দুর্ঘটনা মেট্রোরেলে নিরাপদ যাত্রা বা নিচে পথচারী চলাচলে মানুষের নেতিবাচক ধারণা জন্মাবে। তাই মেট্রোরেলের নকশায় কোনো ত্রুটি বা বিয়ারিং প্যাডের গুণগত মান ঠিক আছে কি না, তা তদন্ত করে বের করা জরুরি। আর যদি কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়, সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যলয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সামছুল হক জাগো নিউজকে বলেন, মেট্রোরেল নির্মাণে যে ত্রুটি তার দায় সরাসরি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে নিতে হবে। এর আগে যিনি মেট্রোরেলের এমডি ছিলেন, উনি না বুঝেই কাজগুলো করেছেন। কারণ উনি নন-টেকনিক্যাল পারসন। এই নন-টেকনিক্যাল লোকটা পুরোপুরি কনসালট্যান্টের ওপর ট্রাস্ট করেছিলেন। ফলে জাইকা নির্মাণের জন্য টাকা নিয়েছে বেশি এবং পরামর্শকের জায়গায় অতি মূল্যায়িত হয়েছে। তারা যখন দেখেছে এখানে বুঝে নেওয়ার মতো প্রতিযোগিতামূলক মেধাবী লোক নেই, তখন তারা তাদের মতো করে করে গেছে। এখন বুঝতেই পারছেন, একটা জিনিস পড়ে মানুষ মারা গেলে নিরাপত্তাঝুঁকি কতটা বেড়ে যায়।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, মেট্রোরেল ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়ই চালু করা হয়। কিন্তু কী ধরনের নিরাপত্তা থাকবে সে সবকিছু হয়তো আমাদের প্ল্যান এবং ডিজাইনে আছে। আমি এটিই বলছি যে, মেট্রো যে একটা আশা জাগানিয়া প্রজেক্ট হয়েছে, এখন মেট্রো সম্পর্কে যদি অনিরাপদ পারসেপশন চলে আসে তাহলে খারাপ একটা উদাহরণ তৈরি হবে।
মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানায়, ২০১২ সালে অনুমোদনের সময় মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। মেট্রোরেল প্রকল্পের জন্য জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রথম মেট্রোরেল চালু হয়। শুরুতে চলাচল করতো উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত। পর্যায়ক্রমে স্টেশনের সংখ্যা বাড়ে। মতিঝিল পর্যন্ত সব স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা শুরু হয় ২০২৩ সালের শেষ দিনে। এখন কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল সম্প্রসারণের কাজ চলছে।
বিয়ারিং প্যাড পড়ে মৃত্যু
২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ফার্মগেটে মেট্রোরেলের ৪৩০ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। ওই ঘটনায় কেউ হতাহত হননি। তবে ওই দিন ট্রেন চলাচল ১১ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। রোববার (২৬ অক্টোবর) ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছে, যা ফার্মগেট স্টেশনের ঠিক পশ্চিম পাশে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ৪৩৩ নম্বর পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাডটা ঠিক ফুটপাতের ওপর আবুল কালাম (৩৫) নামে এক পথচারীর মাথার ওপর পড়ে। এতে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। আবুল কালামের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায়।
ঘটনার পরপর মতিঝিল থেকে উত্তরা মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিকেল ৩টায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও এবং সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়। কিন্তু পুরো পথে কখন নাগাদ মেট্রোরেল চলাচল শুরু হবে তা জানাতে পারেনি ডিএমটিসিএল।








