সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, গত কয়েকদিন ধরে এসব জায়গার অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো ‘শরীফার গল্প’।
মূলত, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ নামক একটি অধ্যায়ে এই নামের একটা গল্প যুক্ত করা হয়েছে।
১৬ পৃষ্ঠার এই অধ্যায়ে শরীফার গল্প আছে দুই পাতা জুড়ে। কিন্তু মাত্র দুই পাতার এই গল্পকে ঘিরে সারাদেশে বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল বিতর্কের ঝড় তৈরি হয়েছে। সমাজের এক অংশ এই গল্পের পক্ষে, অপর অংশ বিপক্ষে।
এই বিতর্কের মধ্যে বুধবার অর্থাৎ ২৪শে জানুয়ারি পাঁচ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ কমিটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি) গল্পটি পর্যালোচনায় সার্বিক সহায়তা করবে।
পাঁচ সদস্যের এই কমিটির আহ্বায়ক ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুর রশীদ। বাকি সদস্যদের মাঝে রয়েছেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর) এবং ঢাকা আলিয়া মাদরাসার প্রতিনিধিরা।
এর আগে গত ২৩ জানুয়ারি নবনিযুক্ত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সাংবাদিকদের শরীফার গল্পে বিভ্রান্তি বা বিতর্ক থাকলে তা পরিবর্তনের করার কথা বলেছিলেন।
কিন্তু এই পুরো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু যে ‘শরীফার গল্প’, তাতে আসলে কী আছে?
কী আছে শরীফার গল্পে?
৩৭৪ শব্দের এই গল্পে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বলা হয়েছে। বইয়ে এই গল্পটি যুক্ত করার প্রধান উদ্দেশ্য, এই জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরদেরকে সচেতন করা।
শরীফার গল্প’র প্রধান চরিত্রের নাম আসলে দুটো। শরীফ এবং শরীফা। শরীফ আহমেদ এক সময়ে শরীফা আকতার হয়ে যান, যিনি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।
শরীফার গল্প শুরুর আগের গল্পটা এরকম— শরীফাদের শ্রেণি শিক্ষকের ডাকনাম খুশি, তাকে শিক্ষার্থীরা খুশি আপা হিসেবে সম্বোধন করে। তিনি তার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে খেলার ছলে ‘সম্প্রদায়’ সম্বন্ধে শেখাচ্ছেন।
খুশি আপা সেদিন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য লিখে শ্রেণি কক্ষের বিভিন্ন জায়গায় সাঁটিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর তিনি নিজ নিজ সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে শিক্ষার্থীদেরকে দাঁড়াতে বললেন। শিক্ষার্থীরা এত সহজভাবে একটা কঠিন বিষয় সমন্ধে জানতে পেরে দারুণ উচ্ছ্বসিত।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা যাতে কাছ থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে দেখতে পারে, তাই তিনি পরদিন ক্লাসে একজন অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। যার নামই মূলত শরীফ ওরফে শরীফা।
এখান থেকেই গল্পের শুরু। শরীফা এই স্কুলেরই একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী।
তাকে খুশি আপা পরিচয় করিয়ে দেন এভাবে, “ইনি ছোটবেলায় তোমাদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। আজ এসেছেন, নিজের স্কুলটা দেখতে।”
এরপর শরীফা শিক্ষার্থীদেরকে নিজের পরিচয় জানান। তিনি বলেন, “যখন আমি তোমাদের স্কুলে পড়তাম তখন আমার নাম ছিল শরীফ আহমেদ।”
তখন আনুচিং নামক এক শিক্ষার্থী অবাক হয়ে যায়। সে জানতে চায়, শরীফা কীভাবে মেয়ে হলো।
শরীফার উত্তর ছিলো, “আমি তখনও যা ছিলাম, এখনও তাই আছি। নামটা কেবল বদলেছি।”
কিন্তু শিশুরা শরীফার কথা ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। তারা শরীফার বাড়ি কোথায় জানতে চায়। বাড়ির হদিস দেয়ার পরও তাদের পরের প্রশ্ন— শরীফা কেন বাবা-মায়ের সাথে থাকে না।
গল্পের পরবর্তী অংশ
সবাইকে অবাক হতে দেখে শরীফা এরপর নিজের জীবনের কথা বলতে শুরু করেন।
শরীফা বলেন, “ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজে একসময়ে বুঝলাম, আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে।”
তিনি জানান, ছোটবেলায় তিনি মেয়েদের মতো পোশাক পরতে ভালোবাসতেন। মেয়েদের প্রসাধনী দিয়ে সাজতেন। কিন্তু বাড়ির কেউ তাকে তার পছন্দের পোশাক কিনে দিতে রাজি হতো না।
“মেয়েদের সঙ্গে খেলতেই আমার বেশি ইচ্ছে করত। কিন্তু মেয়েরা আমাকে খেলায় নিতে চাইত না। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গেলেও তারা আমার কথাবার্তা, চালচলন নিয়ে হাসাহাসি করত। স্কুলের সবাই, পাড়া-পড়শি এমনকি বাড়ির লোকজনও আমাকে ভীষণ অবহেলা করত। আমি কেন এ রকম একথা ভেবে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হতো, নিজেকে ভীষণ একা লাগত।”
এভাবে অবহেলিত হতে হতে একদিন একজনের সাথে শরীফার পরিচয় হয়।
“একদিন এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো যাকে সমাজের সবাই মেয়ে বলে কিন্তু সে নিজেকে ছেলে বলেই মনে করে। আমার মনে হলো, এই মানুষটাও আমার মতন। সে আমাকে বলল, আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)।”
সেই নতুন মানুষ শরীফাকে নিয়ে এমন এক জায়গায় নিয়ে যান, যেখানে নারী-পুরুষের বাইরে আরও মানুষ আছেন। “এই মানুষদেরকে বলা হয় ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠী।”
শরীফা বলেন, “তাদের সবাইকে দেখেশুনে রাখেন তাদের ‘গুরু মা’। আমার সেখানে গিয়ে নিজেকে আর একলা লাগল না, মনে হলো না যে আমি সবার চেয়ে আলাদা। সেই মানুষগুলোর কাছেই থেকে গেলাম।”
এই জনগোষ্ঠীর নিয়ম-কানুন, ভাষা, রীতিনীতি শরীফাদের বাড়ির চেয়ে অনেক আলাদা হলেও শরীফা শেষ পর্যন্ত তাদের কাছেই থেকে যান বলে গল্পে উল্লেখ করা হয়।
শরীফার ভাষায়, “আমরা সবার সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে একটা পরিবারের মতনই থাকি। বাড়ির লোকজনের জন্যও খুব মন খারাপ হয়। তাই মাঝে মাঝে বাড়িতেও যাই।”
কিন্তু সেখানে থেকে যাওয়ায় শরীফার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায় এবং তিনি রোজগারে মন দেন।
বিশ বছর আগে বাড়ি ছেড়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “সেই থেকে আমি আমার নতুন বাড়ির লোকদের সঙ্গে শহরের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে, নতুন শিশু আর নতুন বর-বউকে দোয়া-আশীর্বাদ করে পয়সা রোজগার করি। কখনো কখনো লোকের কাছে চেয়ে টাকা সংগ্রহ করি।”
গল্পে শরীফা আরও যোগ করেন, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীরও ইচ্ছে করে সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন কাটাতে, পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা করতে। কিন্তু ২০১৩ সালে সরকার তাদেরকে স্বীকৃতি দিলেও মানুষ এখনও তাদের সঙ্গে মিশতে চায় না, যোগ্যতা থাকলেও কাজ দিতে চায় না।
বিতর্কের শুরু ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক খণ্ডকালীন শিক্ষকের বক্তব্য ধরে।
সপ্তম শ্রেণির এই পাঠ্যবইয়ে থাকা ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক অধ্যায় নিয়ে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবের একটি দশ মিনিটের ভিডিও ভাইরাল হয়।
তিনি সেই ভিডিওতে ট্রান্সজেন্ডার এবং সমকামিতা বিরোধী বক্তব্য দেন। ‘মানুষ কীভাবে সমকামী হতে পারে’ এবং ‘একটা জাতি..একটা রাষ্ট্র কীভাবে সমকামী হতে পারে’ এমন প্রশ্ন করতে দেখা যায় তাকে।
সেসময় তাকে সপ্তম শ্রেণির এই বইয়ের ট্রান্সজেন্ডার বিষয়ক গল্পের পাতা ছিঁড়ে ফেলতে দেখা যায়।
ভিডিও’র নয় মিনিট ১৩ সেকেন্ডের সময় বইটি দেখিয়ে তিনি বলেন, “এইটা পাবলিশড বই, ঘরে ঘরে আছে। যাদের সামর্থ আছে, তারা একটা কাজ করবেন- সেটা হচ্ছে বইয়ের দোকানে যাবেন। এই বইটা আমি ৮০ টাকা দিয়ে কিনছি। বইটা কিনবেন, কিনে এই যে দুইটা পাতা আছে ‘শরীফ শরীফা’, ছিঁড়বেন।”
এই সময় তিনি নিজে হাতে থাকা বইটির দুইটি পাতা ছিঁড়ে দেখান।
এরপর তিনি আবার বলেন, “ছিঁড়ার পরে আপনারা বইটা আবার দোকানদারকে দিয়ে দেবেন। দিয়ে বলবেন এটা অর্ধেক দামে বেচো। এতে মানুষের অ্যাওয়ারনেস হবে। অভিভাবকেরা এখন জানেন না, জানবেন।”
এই গল্পে সমকামিতা প্রসঙ্গের কোনও উল্লেখ না থাকলেও এক পর্যায়ে তিনি অভিযোগ করেন, “আমাদের দেশে সমকামিতা অবৈধ। কিন্তু এই গল্পের মাধ্যমে সমকামিতাকে বৈধ করা হচ্ছে।”
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ্য যে সপ্তম শ্রেণির এই বইতে যে শুধু তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীদেরকে নিয়ে পাঠ বা গল্প যুক্ত করা হয়েছে, তেমন না।
অধ্যায়টিতে বেদে সম্প্রদায় ও পরিচ্ছন্নকর্মীদের নিয়েও আলাদা পাঠ আছে। এছাড়া, ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মের মানুষের গল্পও এই বইতে উঠে এসেছে।
গল্পের খুশি আপা যে শুধু ‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠীকে চেনাতে শরীফাকে ক্লাসে নিয়ে এসেছেন, তা না। এই বইতে ‘শরীফার গল্প’ পাঠের আগের পাঠের নাম ‘দেখে আসি বেদের বহর’।
সেখানেও তিনি শিক্ষার্থীদেরকে একটা নদীর তীরে নিয়ে যান, যেখানে বেদে জনগোষ্ঠীর বসবাস।
আসলে খুব সহজবোধ্য ভাষায় গল্পে গল্পে সমাজের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ, তাদের রীতি-নীতি ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বইয়ের এই অধ্যায়টিতে।
বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে ওঠা পাঠ্যপুস্তকের এই গল্পটি নিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা এনসিটিবি গত ২৩শে জানুয়ারি বিবিসি বাংলাকে বলছে, পাঠ্যক্রমের যেকোনো বিষয়বস্তু বা শিক্ষাসূচি প্রয়োজনীয় গবেষণা এবং বারংবার পর্যালোচনার পরই ছাপানো হয়।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সেদিন বলেছেন, “সরকার ট্রান্সজেন্ডারকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তারা সমাজেরই একটা অংশ। এ বিষয়ে বই রিভিউয়ের সময় ইনক্লুশন স্পেশালিস্ট, জেন্ডার স্পেশালিস্ট ছিলেন। তিনবার বইটি রিভিউ হয়েছে। তারা সবকিছু দেখে বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন।”
“বইতে যা দেয়া হয়েছে, তা সময়ের প্রয়োজন”, বলেন অধ্যাপক ইসলাম।
পাঠ্যপুস্তকের পাতা ছিঁড়ে ফেলা নিয়ে তিনি বলেন, “এ নিয়ে কে কী করেছে, তা নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই, এটা সরকার দেখবে।”
কমিটি এখন কী করবে
পাঁচ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি কি শুধু জাতীয় পাঠ্যক্রমের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের আলোচিত ‘শরীফার গল্প’ই পর্যালোচনা করবে? নাকি পুরো বইয়ের?
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “পুরো বইতে যা যা আছে, তা পর্যালোচনা করা হবে।”
কবে নাগাদ পর্যালোচনা শেষ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনতিবিলম্বে’।