মাহী তো বেঁচে নেই, তাই তার জন্মদিন আনন্দের সাথে উদযাপন হবে না। বরং তা শোকাবহ! তার মৃত্যুর পর থেকে আমার ও আমার পরিবারের কাছে প্রত্যেকটি দিনই শোকের দিন। কারণ তার করোনা টিকাবিহীন মৃত্যুর প্রায় দু’বছর হতে চলল। কিন্তু তার মৃত্যুর জন্য দায়ী সেই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এখনো তার স্বপদে বহাল রয়েছে। আসলে কি তাই? সে রয়েছে, নাকি তাকে তদবির করে রাখা হয়েছে? সে প্রশ্নের উত্তর আপনারা একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। কি উদ্দেশ্যে, কি এজেন্ডা বাস্তবায়নে, কাকে মানসিক আঘাত করার হীন স্বার্থে তদবির করে একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে জোরপূর্বক নির্দিষ্ট মেয়াদের বাইরেও রাখা হয়েছে। সেই কর্মকর্তা পটিয়ার জন্য কি এমন অবদান রেখে যাচ্ছে যে, সে চলে গেলে ব্যক্তি বিশেষ পাগল প্রায় হয়ে যাবে। তা আমাদের সহজ সরল মনে বুঝে আসে না অথবা আমরা বুঝতে পারিনা, পারলেও তা কাউকে বলতে দ্বিধা হয়।
আমি অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ও গভীর শোকাভিভূত হয়ে সকলের জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই যে, গত ২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি আমার একমাত্র সন্তান আতিক শাহরিয়ার মাহী করোনা আক্রান্ত হয়ে মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আমরা আল্লাহর কাছে তার আত্মার শান্তি ও মাগফেরাত কামনা করছি। পটিয়ার বিভিন্ন সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো এ দিনটি অত্যন্ত দুঃখের সাথে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে পালন করছে।
মৃত্যু প্রত্যেক মানুষের জন্য স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু কিছু মৃত্যু আছে যা মনের গহীনে চিরকাল বেদনা হয়ে থাকে। আমার ছেলের মৃত্যু পৌর এলাকার বাসিন্দাদের মনে গভীর দাগ কেটেছিল। অনেকে অজান্তে চোখের জল ফেলেছে। কারণ অকালে মাহীর মৃত্যু সকল পিতা-মাতার হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে। আর স্বজন হারানোর বেদনার গভীর অনুভূতি সকলে গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারে। মূলত মাহীর এ মৃত্যুটি ছিল করোনা টিকাবিহীন অবহেলাজনিত মৃত্যু।
আসলে দীর্ঘদিন যাবৎ পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিজে, দায়িত্বরত ডাক্তার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত অনুপস্থিতিসহ বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রমের বিষয়ে জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে আমি সোচ্চার ছিলাম। কারণ প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি সেবামূলক । মানুষ সেখানে যায় একান্ত দুঃখের ও কষ্টের সময়। তখন কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেলে জনগণ সরকারের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। এ বিষয়গুলোর পাশাপাশি উক্ত স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সরাসরি নির্দেশে ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপির জ্ঞাতসারে ৩০ ও ৩১ জুলাই ২০২১ তারিখে পটিয়া উপজেলার শুধুমাত্র শোভনদন্ডী ইউনিয়নে পূর্বে মজুদকৃত কয়েক হাজার টিকা সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রদান করা হয়েছিল।
পরবর্তীকালে তা জানাজানি হলে ঐ কর্মকর্তা উক্ত টিকাগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ০৭ আগস্ট ২০২১ তারিখের টিকাকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের আগে অগ্রিম প্রদান করা হয়েছে বলে প্রচার করতে থাকে। এতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর টিকা প্রদান উদ্বোধন কার্যক্রমের ভাবমূর্তি কেন ক্ষুণ্ণ করেন তা জানতে চাইলে ঐ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ভুল তথ্য দিয়ে সাধারণ জনগণকে টিকা প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে।
এছাড়া ০৭/০৮/২০২১ তারিখে প্রত্যেকটি ইউনিয়নে ৩/৪টি করে টিকাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। যেখানে প্রায় দুই লক্ষ লোকের বসবাস সেই প্রথম শ্রেণির পটিয়া পৌরসভায় শুধুমাত্র ১টি টিকা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। যাতে জনগণের কাছে আমাকে অযোগ্য প্রমাণ বা হেয় প্রতিপন্ন করা যায়। আমি সাধারণ জনগণকে হয়রানি না করার বিষয়ে সরাসরি ঐ কর্মকর্তাকে অবহিতপূর্বক দায়িত্ব পালনে তাকে আরো আন্তরিক হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। তাছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার জন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত আবাসিক বাস ভবন থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজ বাসভবনে বসবাস না করার কারণে প্রায় সময়ই নিয়মিত কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন।
সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যে প্রদানকৃত করোনা টিকা টাকা দিয়ে জনগণকে প্রদান করার ও স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত টাকা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আত্মসাৎ করার বিষয়গুলো নিয়ে আমি জনগণের অধিকার নিশ্চিতে সোচ্চার ছিলাম। তাতে ঐ কর্মকর্তা ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর দপ্তর থেকে প্রেরিত বিভিন্ন অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনায় ও দাপ্তরিক পত্র যোগাযোগে সরকার কর্তৃক প্রণীত পদ মর্যাদার ক্রম অনুসরণ না করে ঈর্ষান্বিত হয়ে পৌরসভার মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করে যাচ্ছিলেন।
অপরদিকে আমি ২০২০ সালের করোনা মহামারীকালীন সময়ে সরকারি বরাদ্দ প্রদানের লক্ষ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার মানুষের সুষ্ঠু তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন বরাদ্দ থেকে প্রাপ্ত ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবেপালন করেছি। পাশাপাশি আমার স্ত্রী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হওয়ায় তাকেও সাধারণ মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে। ঘরে তখন আমাদের প্রায় ১৮ বছরের মাহী এবং ১৫ বছরের ছোট মেয়ে। সন্তানরা উভয়েই শিক্ষার্থী। মানুষ যখন জীবন বাঁচানোর জন্য ঘরে রয়েছে তখন সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে, অসহায়দের ঘরে খাবার ও অন্যন্যা সেবা প্রদানের নিমিত্তে মেয়র হিসেবে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে শিক্ষিকা হিসেবে প্রতিদিন শত শত মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়েছিল।
তখন আমার পরিবারটি করোনা মহামারীতে অত্যন্ত ঝুঁকিতে দিন অতিবাহিত করেছিল। ঐসময় পিতা হিসেবে আমার সন্তানদেরকে সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যে টীকা প্রদান করার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে বারবার অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু ঐ কর্মকর্তা ১৮ বছর না হওয়ার অজুহাত দাঁড় করিয়ে টীকা দেননি। পরবর্তীকালে ০৫ অক্টোবর ২০২১ তারিখে ১৮ বছর পূর্ণ হবার পর থেকে তার কাছে ছেলেকে টীকা প্রদান করার জন্য ১০/১২ বার অনুরোধ করেছি। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সকলকে করোনা ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য টীকা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু উক্ত কর্মকর্তা নানা অজুহাতে ১৮ বছর ০৩ মাস পর্যন্ত মাহীকে টাকা প্রদান না করে কালক্ষেপণ করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে ১৩ জানুয়ারি আমার ছেলে করোনা আক্রান্ত হয়ে পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামে আইসিউতে ভর্তি করাই, পরে আরও উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা নেওয়ার পথে সে মৃত্যুবরণ করে। ছেলের মৃত্যুর সংবাদটি ঢাকা বাসা থেকে আমি সাথে সাথে হুইপ মহোদয়কে, তার ছেলে শারুন চৌধুরী এবং পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানকে অবগত করে টীকাবিহীন ছেলের মৃত্যুর বিষয়টিতে তাদেরকে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলাম।
ছেলের জানাজায় হাজার শোকার্তমুসল্লীদের সম্মুখেও আমি বিষয়টি উত্থাপনপূর্বক অবহেলাজনিত মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছিলাম। যাতে আর কাউকে এ ধরণের অবহেলার শিকার হয়ে তাদের প্রিয় সন্তানকে অকালে হারাতে না হয়। আমার ছেলের মৃত্যুর এ বিষয়টিতে হুইপ ও আমাদের উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবের কাছ থেকে আমি কোনরূপ সহযোগিতা তো পাইনি বরং তাদেরকে বিষয়টি অবগত করে অফিসিয়ালি বিভিন্নভাবে আমাকে নাজেহাল করার অপচেষ্টা করা হয়েছে।
পরবর্তীকালে আমি বিষয়টি দক্ষিণ জেলা আ’লীগের সভায়ও যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের দায়িত্ব প্রাপ্ত কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য আলহাজ মোছলেম উদ্দিন আহমদ।
কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমার মাহীর করোনা টিকাবিহীন মৃত্যুর বিষয়ে কেউ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এ বিষয়গুলো ১৪ মার্চ ২০২২ তারিখে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ও সিনিয়র সচিবকে সুষ্ঠু তদন্ত করে উক্ত স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করি। পরবর্তীতে গত ২২ মে ২০২২ তারিখে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালককে বিষয়টি অবগত করি।
আরো পরে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) কে এ স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা সময়ে উত্থাপিত নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দাবি জানিয়েছিলাম। ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখ বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) এর দপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগ কর্তৃক ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলেন। তদন্ত কমিটি ০৩ অক্টোবর ২০২২ খ্রিঃ তারিখে সরেজমিনে তদন্ত করেছিল। তদন্তকালে পটিয়ার সাধারণ জনগণ, হয়রানির শিকার ও প্রত্যক্ষদর্শী, বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশকারী পত্রিকার সংবাদিকবৃন্দ লিখিতভাবে তদন্ত কমিটিকেঅভিযোগ দিয়েছিল। বিভিন্ন অনিয়মের দলিলাদিসহ যাবতীয় সাক্ষ্য প্রমাণ কমিটির চাহিত তথ্য মোতাবেক হাজির করে প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু অদ্যাবধি তার কোন সুষ্ঠু সুরাহা হয়নি। বরং সেখানে অদৃশ্য শক্তি উক্ত স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পক্ষ নিয়ে তদন্তে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে যাতে পটিয়ার মানুষ ঐ দুর্নীতিবাজ স্বাস্থ্য কর্মকর্তার জুলুমের শিকার হয়ে তার কাছে আরো দীর্ঘদিন লাঞ্ঝনা সহ্য করতে হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা’র কাছে অত্যন্ত বিনীত চিত্তে আকুল আবেদন আমার পুত্র হত্যার বিষয়টি মানবিকভাবে বিবেচনা করত ঐ স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অপসারণমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি। তাতে আমাদের পটিয়ার সাধারণ জনগণ আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন।
লেখক
আলহাজ্ব মো. আইয়ুব বাবুল
মেয়র, পটিয়া পৌরসভা, পটিয়া,
চট্টগ্রাম।