চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা এলাকার মো. হাসান (৬১) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তারই ছোট ছেলে শফিকুর রহমান ওরফে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী আনারকলি।
মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেনের আদালতে এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি।
এর আগে, একই আদালতে নিহত হাসানের বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আনারকলি বলেন, আমার বাড়ি মহেশখালী। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমার প্রথম বিয়ে হয়। স্বামী মারধর করায় আর সংসার করিনি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে শফিকুর রহমান ওরফে জাহাঙ্গীরকে বিয়ে করি। তার ভাইয়ের নাম মোস্তাফিজুর রহমান। আমার শাশুড়ি অসুস্থ থাকায় আমার বাসায় ছিল। ১৯ সেপ্টেম্বর আমার শ্বশুর হাসান আলী আমার বাসায় আসেন। সেদিন তিনি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
পরদিন সকালে আমাদের ঘরের পাশের একটা খালি ঘরে আমার শ্বশুর, স্বামী ও ভাশুর মোস্তাফিজ যায়। ওই ঘরের ভিতর তারা কী করেছে আমি সব দেখিনি। আমি একবার লুকিয়ে দেখতে গিয়ে জানালা দিয়ে দেখতে পাই আমার স্বামী শফিক ও ভাশুর মোস্তাফিজ শ্বশুরকে একটা বস্তায় ভরছে। পরে বিকেলে জানতে পারি ওরা আমার শ্বশুরকে মেরে ফেলেছে।
আনারকলি বলেন, বিকেলে আমার স্বামী ও আমি লাশটা আমার ঘরে নিয়ে যাই। ওরা লাশটা টুকরো টুকরো করে লাগেজ, স্কুল ব্যাগ ও বস্তায় ভরে। আমার স্বামী পলিথিন ও স্কচটেপ আমাকে দেয়। আমি সেগুলো ভাশুরকে দেই। রাতে একটা লোককে দিয়ে ওরা বস্তা ফেলে দেয়। কোথায় ফেলে দেয় তা জানি না। পরদিন ভোরে আমি, শফিক ও মোস্তাফিজ লাগেজ ১২ নম্বর ঘাটের দিকে ফেলি। স্কুল ব্যাগে রাখা ছিল মাথা। সেটি আমি ও শফিক মিলে পতেঙ্গা বিচে নিয়ে যাই। শফিক মাথাটা পুলিশ বক্সের একদম নিচের দিকে পাথরের ভেতর ফেলে দেয়।
সেসময় শফিক আমাকে ব্যাগটিও ফেলে দিতে বলে। কিন্তু আমি ফেলিনি। আমি স্কুলে প্রথম হওয়ায় ব্যাগটি পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম। ক্লাস ওয়ান থেকে এইট পর্যন্ত আমার রোল নম্বর ১ ছিল। আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পিএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পাই।
আমি খুনের বিষয়টি জানতাম না। পরে জেনেও চুপ ছিলাম। ভাবলাম সংসার ভেঙে যাবে কী না। অভাবের কারণে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় পরিবার আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। আমি পুলিশকে ঝুড়ি ও ব্যাগ উদ্ধারে সহায়তা করি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খান বলেন, গত ৩০ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) গভীর রাতে কক্সবাজারের মহেশখালী বাবার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় হাসানের ছোট ছেলে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী আনারকলিকে।
গ্রেপ্তারের পর আনারকলি পিবিআই টিমকে জানায়, ঘটনার পর পিবিআই যখন হাসানকে শনাক্ত করতে তার স্বজনদের খোঁজ করতে থাকে, তখন জাহাঙ্গীর ও আনারকলি পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। ২২ সেপ্টেম্বর তারা দুজন মাথাটি সমুদ্র সৈকতে পাথরের নিচে ফেলে দেন। এরপর তারা প্রথমে নোয়াখালী চলে যান। সেখান থেকে যান ভোলা। একপর্যায়ে দুজন আলাদা হয়ে যান। আনারকলি চলে আসেন চট্টগ্রামে। বড়উঠানে তার এক ফুপুর বাড়িতে যান। সেদিন রাতে ফুপুকে ঘটনা খুলে বললে ফুপু ভয় পেয়ে যান। পরদিন তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। পরে একটি ফোনের দোকান থেকে আনারকলি ফোন দেন তার মাকে। তার মা বলেন, তুই আমার কাছে চলে আয়। আনারকলি চলে যান তার বাবারবাড়ি মহেশখালীতে। সেখান থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরদিন ১ অক্টোবর (শনিবার) তাকে আদালতে হাজির করে তিনদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। প্রথমে তাকে নিয়ে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ধারালো দা উদ্ধার করা হয়। এরপর তাকে নিয়ে ভুক্তভোগী হাসানের কাটা মাথা উদ্ধারে অভিযানে যাই। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও মাথাটির খোঁজ পাওয়া যায়নি। আনারকলি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এর আগে পিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হাসানের বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানও জানিয়েছিলেন, ২০ সেপ্টেম্বর পারিবারিক ও সাংসারিক নানা বিষয় নিয়ে বাবা, ছোট ভাইসহ আমরা তিনজন চট্টগ্রাম শহরে ছোট ভাইয়ের বাসায় আলোচনা করতে থাকি। একপর্যায়ে বাবার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। তখন আমার বাবা আমার গালে থাপ্পড় মারেন। এতে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। সহ্য করতে না পেরে দুই হাত দিয়ে বাবার গলায় চেপে ধরি। এতে বাবা মারা যায়। প্রথমে বস্তায় বাবার লাশ ঢুকিয়ে রুমের এক কোণায় রেখে রুমটি তালা মেরে চলে আসি। এরপর ছোট বোনের জামাই ফোরকানকে কল দিয়ে একটি সিএনজি আনার কথা বলি। ওই সিএনজিতে করে মাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিই। এরপর বাবাকে টুকরো টুকরো করি।
এদিকে খণ্ডবিখণ্ড হওয়া মো. হাসানের শরীরের নয় টুকরো পাওয়া গেলেও মাথার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, গত ২১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা থানার ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় সড়কের পাশে পড়ে থাকা একটি লাগেজ থেকে মানুষের শরীরের আটটি খণ্ড উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ছিল দুইটি হাত, দুইটি পা, কনুই থেকে কাঁধ এবং হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত অংশ। প্রত্যেকটি অংশ টেপ দিয়ে মোড়ানো ছিল। তবে ওই লাগেজে ভুক্তভোগীর মাথা না থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে তার পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কাদির বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর খণ্ড-বিখণ্ড এই মরদেহের পরিচয় শনাক্ত ও রহস্য উন্মোচনে মাঠে নামে পিবিআই কর্মকর্তারা। তারা প্রথমে ফিঙ্গারপ্রিন্টের সহায়তায় খণ্ড-বিখণ্ড হওয়া ব্যক্তি মো. হাসান বলে শনাক্ত করেন। পরে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী নিশ্চিত হয় হাসানের বাড়ি বাঁশখালীর উপজেলার কাথারিয়া এলাকা এবং তিনি ওই এলাকার সাহেব মিয়ার ছেলে। তবে তার বর্তমান ঠিকানা লেখা আছে সিলেট সদরের সাধুর বাজার সংলগ্ন রেলওয়ে কলোনির এলাকায়।
পিবিআই জানায়, ২৮ বছর ধরে পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না ভুক্তভোগী হাসানের। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি কোথায় ছিলেন জানতেন না তার পরিবারের সদস্যরা। বছরখানেক আগে হঠাৎ তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে হাসানের নামে কিছু পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। সেগুলো বিক্রি করতে চান হাসান।
এটা নিয়ে বিরোধের জেরে গত ২০ সেপ্টেম্বর নগরের ইপিজেড থানার আকমল আলী রোডের পকেট গেট এলাকার জমির ভিলা ভবনের একটি বাসায় তার স্ত্রী-সন্তানরা মিলে হাসানকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে ফেলেন।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ইতোমধ্যে নিহত হাসানের স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম (৫০) ও বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানকে (৩২) গ্রেপ্তার করে পিবিআই।