শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫, ৯ কার্তিক, ১৪৩২, ২ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭

শেখের বেটি হারলে বাংলাদেশ হেরে যায় আওয়ামী লীগ ট্রিলজির তৃতীয় পর্ব

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

আওয়ামী লীগ এদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আওয়ামী লীগ হাত ধরাধরি করে অগ্রসর হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ ও ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রত্যাশার প্রহর গোণার কাল গণণা করলে দেখা যাবে পাকিস্তানের রাজনীতি যত অগ্রসর হয়েছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টাও তত বেগবান হয়েছে। সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারি শাসকের কাটা বিছানো পথে দুয়ের যুগ্ম অভিযাত্রায় কত বাঁক বদল-কত রক্ত, কত অশ্রু, কত নির্যাতন, কত গুলি, কারফিউ, ১৪৪ ধারা, সামরিক কুদেতা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে বাঙালি জাতিকে, তার কোন লেখা জোখা নেই। আওয়ামী লীগের রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশ শাসন আমার বহুদিনের চর্চা, অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণের বিষয়। বহু বছর ধরে পড়াশোনা করতে করতে আওয়ামী লীগের উপর একটি লেখা তৈরির আইডিয়া আমার মাথায় আসে। সে লেখাটি এত বড় হয়ে যায় যে, তাকে নিয়ে একটি ট্রিলজি তৈরি হয়ে গেছে। তিন পর্বে বিভক্ত আমার ধারাবাহিক লেখার এটি তৃতীয় পর্ব।
আওয়ামী লীগ নিয়ে ধারাবাহিক রচনার এ পর্যায়ে এসে আমার একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সেটা হলো আওয়ামী লীগ সমর্থক বা আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের কী আওয়ামী লীগ সম্মান জানাতে পারে না? বুদ্ধিজীবীরা সরাসরি আওয়ামী লীগের সদস্য না হয়েও এই দলটির বিকাশে এবং দুঃসময়ে তাদের লেখনি দিয়ে সৃজনকলা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দেয়ার পর, যতদিন পর্যন্ত ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মিয়া ৬ দফা সমর্থন করেননি, ‘মুসাফির’ ছদ্মনামে লেখা রাজনৈতিক কলামে তাঁর ক্ষুরধার কলম দিয়ে ৬ দফার সমর্থনে যুক্তিতর্ক দিয়ে লেখনি আরম্ভ করেননি এবং সারাদেশে ৬ দফার সমর্থনে অনুষ্ঠিত সভা-সমিতি ও বক্তৃতা বিবৃতির সংবাদ ইত্তেফাকের পাতায় ফলাও করে ছাপা শুরু করেননি, ততদিন পর্যন্ত ৬ দফার পালে বাতাস লাগেনি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, সমর্থক ও সংখ্যালঘুদের ওপর যেভাবে আক্রমণ শুরু করেছিলো, তাতে বাড়িঘরেও টেকা দায় হয়ে পড়েছিলো। সারাদেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এমনি ভয়ার্ত পরিবেশ শুধু চারজন বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠই সরব হয়ে উঠেছিলো। তাঁরা হচ্ছেন-আবদুল গাফফার চৌধুরী, ড. মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির ও আবেদ খান। শাহরিয়ার কবিরকে গ্রেফতার করে নির্যাতনও চালানো হয়েছিলো। সেদিন বুদ্ধিজীবীদের নির্ভীক কণ্ঠ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ঘর থেকে বের হতে পারতেন কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করার যথেস্ট কারণ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংকটে বুদ্ধিজীবীদের বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা অবগত আছেন বলেই তিনি বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে দলের জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে নিয়মিত তাঁদের মতামত জানার ও শোনার জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সেজন্যই তো চট্টগ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ ও প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. অনুপম সেন এবং অধ্যক্ষ ড. প্রণব বড়–য়া আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হতে পেরেছেন। কিন্তু চট্টগ্রামে মহানগর আওয়ামী লীগের যে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে তাতে সাংবাদিক লেখক বুদ্ধিজীবীদের কোন স্থান হয়নি; শুধু প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাদের ঠাঁই হয়েছে। বুদ্ধিজীবীরা সরাসরি দলীয় কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করেন না, কিন্তু তাঁদের কলমের লেখনি দ্বারা অথবা বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে একই কাজই তো করেন তাঁরা।
বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে সমাজ থেকে অন্ধত্ব, কূপম-ুকতা, কুসংস্কার সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ফতোয়াবাজি নির্মূল করে সমাজকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। সেজন্য আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা ছাড়া তাদের সামনে অন্য কোন পথ খোলা থাকে না। বিএনপি, জামায়াত বা অন্য কোন পশ্চাৎপদ শক্তি ক্ষমতায় আসলে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, মুক্তবুদ্ধি চর্চা, মানবাধিকার তথা সমাজ প্রগতির প্রবহমান ধারা ব্যাহত হওয়ার আশংকা থেকে যায়। এ কারণে সর্বাবস্থায় আওয়ামী লীগ বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন পেয়ে যায়। সংখ্যালঘুদের যে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তারও উৎস এটাই। এ এক নিদারুণ পরিস্থিতি। এটা লক্ষ্য করেই কবি শামসুর রাহমান এবং সাহিত্যিক আহমদ ছফা বলেছিলেনÑ“শেখের বেটি হারলে বাংলাদেশ হেরে যায়। আর শেখের বেটি জিতলে শুধু আওয়ামী লীগই জেতে”। একথার অর্থ হচ্ছে শেখের বেটি অর্থাৎ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের চেতনার প্রতীক, আদর্শের প্রতীক, মূল্যবোধের প্রতীক। বাংলাদেশের চেতনা অর্থাৎ স্বাধীনতার চেতনা। বাংলাদেশের আদর্শ রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি-গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র। বাংলাদেশের মূল্যবোধ মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িকতা, উদার মানবিকতা ও নারী স্বাধীনতা। বাংলাদেশের আদর্শ ও চেতনায় সকল প্রকার শোষণ, বঞ্চনা, অসাম্য, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও সংগ্রামের সংকল্প নিহিত রয়েছে। শেখ হাসিনা নির্বাচনে পরাজিত হলে অন্ধকারের অপশক্তি মানবিকতা, শুভ্রতা, শুভবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার উপর চড়াও হয়ে অট্টহাসি হাসে।
উক্ত কথার দ্বিতীয় ভাগ নিয়ে এবার আলোচনা করা যেতে পারে। দ্বিতীয় ভাগে বলা হয়েছে, “শেখের বেটি জিতলে শুধু আওয়ামী লীগ জেতে”। এর নির্গলিতার্থ হচ্ছে শেখ হাসিনা নির্বাচনে জয় লাভ করলে আওয়ামী লিগাররাই ক্ষমতার স্বাদ পায়। দেশ বা গোটা জাতি পায় না। কিন্তু এই কথাটা এখন সংশোধনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কারণ ২০০৮ সাল থেকে তিন দফায় টানা ১৪ বা ১৫ বছর শেখ হাসিনার বর্তমান ক্ষমতার মেয়াদে বাংলাদেশ অর্থাৎ জনগণেরই জিৎ হয়েছে। জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য, জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য, দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সোপানে উন্নীত করার জন্য কত পদক্ষেপ, কত কর্ম পরিকল্পনা যে তিনি নিয়েছেন, তা’ বলে শেষ করা যাবে না। অনুন্নত দেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত করেছেন। এখন উন্নত দেশে উন্নীত করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন।
তিন টার্ম মনে হচ্ছে লম্বা সময়, কিন্তু একদিনের জন্যও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় স্বস্তি পাননি। দেশ-বিদেশে বহুমাত্রিক সংকটে তাঁর শাসনকাল তীব্র টানাপড়েনের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। তিন টার্মের মধ্যে দু’ টার্ম রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিএনপি’র অগ্নি-সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যার নৃশংস ঘটনায় সৃষ্ট মানবিক সংকট এবং বিদেশে অর্থনৈতিক মন্দা, করোনা অতিমারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার সংকটে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর মূল্যবৃদ্ধির আঘাত সয়ে শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির চাকা সচল রেখেছেন। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক অস্বীকৃত হওয়ায় নিজস্ব উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে উক্ত সেতু নির্মাণ করে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে দেশপ্রেম ও আত্মনির্ভরশীলতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার নির্মাণ, ঢাকায় মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন সম্প্রসারণ, মহেশখালীতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, রাজপথ চার লেইন, ছয় লেইনে সম্প্রসারিত করে উন্নয়নের মহোৎসব সৃষ্টি করেছেন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

আতাউর রহমান খান কায়সার : বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে আওয়ামী লীগকে সমৃদ্ধ করেছেন

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তিনি একজন Knowledgeable মানুষ ছিলেন। রাজনীতিকের বুদ্ধিজীবী হতে বাধা নেই। রাজনীতিওত এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা। যদিও বহুদিন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তির পরিবর্তে

বিস্তারিত »

মুক্তিযুদ্ধে পটিয়ার বৃহৎ অপারেশন জিরি মাদ্রাসা, গুলিবিদ্ধ হন ইউসুফ

৭১ -এর মুক্তিযুদ্ধে পটিয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা একটি বড় ধরণের অপারেশন করেন জিরি মাদ্রাসায়। উক্ত মাদ্রাসা ছিলো মুজাহিদ বাহিনীর ঘাঁটি এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজাকার

বিস্তারিত »

রাজনীতির বরপুত্র, সফল নেতা মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী

চট্টগ্রামের রাজনীতির একটি বর্ণাঢ্য আকর্ষক চরিত্র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া, চট্টগ্রামের অভিভাবক সংস্থা পৌর কর্পোরেশনের একবার প্রশাসক ও একবার মেয়র, দেশে

বিস্তারিত »

ভারত আশ্রয় না দিলে, সাহায্য না করলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না

ভারত একটি জুজু, কিছুদিন পর পর এই জুজুর ভয় দেখিয়ে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। আগের দিনে যেমন পাড়া গাঁয়ের মা-বোনেরা বর্গীর ভয়

বিস্তারিত »

দেশের বর্তমান ক্রান্তিকাল উত্তরণে সিইউজের ঐতিহাসিক ভূমিকা স্মরণ

সাংবাদিকদের সমস্যা নিয়ে সংবাদপত্র মালিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা থেকে যে সংগঠনটি জন্ম লাভ করেছিলো ষাটের দশকে, তার নাম সিইউজে বা চিটাগাং

বিস্তারিত »

ত্রিশের যুববিদ্রোহে শ্বেতাঙ্গদের জাহাজে চড়ে সমুদ্রে পলায়নের অজানা কাহিনি

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ, যা সিপাহী বিদ্রোহ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত, সেই বিদ্রোহে চট্টগ্রামের শ্বেতাঙ্গ নাগরিকেরা ভয়ে প্রাণ রক্ষার জন্য সমুদ্রে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইতিহাসে এটুকু তথ্যই পাওয়া

বিস্তারিত »

আহমদ শরীফ মনীর : রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

স্বাধীনতা-উত্তর পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভক্তি এবং একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করে; সেই দলের নাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এটা বোধ হয় কারো অজানা

বিস্তারিত »

জান আলীকে নিয়ে মকবুলের কবিতা : তক দে মিয়া বকশিস দিবা আসলত্তুন হানি

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের পথিকৃৎ শিল্পপতি এ কে খানের পিতামহ জান আলী খান চৌধুরী ১৮ ও ১৯ একজন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার ও সমাজপতি ছিলেন। আঠার শতকে

বিস্তারিত »

ভালো মানুষের জন্য খারাপ সময়ে একজন ভালো মানুষের প্রস্থান

জীবন থেকে ছুটি নিলেন মোবারক ভাই। মোবারক ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে আমার মধ্য নানা রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন এটা সত্য

বিস্তারিত »