রবিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৫, ১২ মাঘ, ১৪৩১, ২৫ রজব, ১৪৪৬

ইতিহাস সৃষ্টির নায়ক, ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ জহুর আহমদ চৌধুরী

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

জহুর আহমদ চৌধুরী একজন ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ। এমন নেতা গ-ায় গ-ায় জন্মায় না। কালেভদ্রে তাঁরা জন্মগ্রহণ করেন এবং কালকে অতিক্রম করে কালোত্তীর্ণ হয়ে যান। তাঁরা যুগ¯্রষ্টা পরমপুরুষ স্বীয় জীবনকালেই তাঁরা কিংবদন্তী হয়ে যান এবং ব্যক্তি জীবনের গ-ি ছাপিয়ে ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন।
৪৭-এর দেশভাগ-উত্তর চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আমরা যেসব প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিষ্ঠাবান নেতার সাক্ষাৎ পাই, তাঁদের মধ্যে খান সাহেব আবদুল হক দোভাষ, শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকী, খান বাহাদুর ফরিদ আহমদ চৌধুরী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, ব্যারিস্টার সানাউল্লাহ, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবুল খায়ের সিদ্দিকী, নুরুল আনোয়ার চৌধুরী, শেখ মোজাফফর আহমদ, আমীর হোসেন দোভাষ, সুধাংশ বিমল দত্ত, নেলী সেনগুপ্তা, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, চৌধুরী হারুনুর রশিদের নাম উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানের তেইশ বছরের চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসকে পর্যালোচনা করে উপর্যুক্ত নেতাদের মধ্যে ৭০ সালে মাত্র দু’জনকেই নেতৃত্বের স্বর্ণ সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখা যায়। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী। মুসলিম লীগের সমস্ত নেতা স্বর্গচ্যুত হয়ে ধূলিশয্যা নিয়েছেন। যাঁরা প্রবীণ তাঁরা পরলোকবাসী; জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রবল জোয়ারে ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টির আন্তর্জাতিক রাজনীতি খড়কুটোর মত ভেসে গেছে।
এমএ আজিজ ৭১-এর ১১ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে জহুর আহমদ চৌধুরী একাই তখন চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। জহুর আহমদ চৌধুরী ইতিহাস গড়লেন। তাঁর সামনে আরো ইতিহাসের হাতছানি। জহুর আহমদ চৌধুরী তাতে সাড়া দিতে ভুল করলেন না। নব নব ইতিহাস সৃষ্টি করে তিনি নিজেও ইতিহাস হয়ে গেলেন। বাংলাদেশে তখন একে একে অনেক ঘটনা ঘটে যাবে। পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা চালাবে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন এবং চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে সেই ঘোষণা পাঠাবেন দেশে বিদেশে প্রচারের জন্য।
জহুর আহমদ চৌধুরী সম্ভব সব পন্থায় সে ঘোষণা প্রচারে ব্যবস্থা করলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা সাইক্লোস্টাইল করে হাজার হাজার কপি ছড়িয়ে দিলেন মানুষের মাঝে। ট্যাক্সি, রিক্সা, ঠেলা গাড়িতে মাইক লাগিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারে নিয়োজিত করেছিলেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের। তিনি নিজে, তাঁর পরিবার এবং সমস্ত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের নেতৃ ও কর্মীবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই লীন হয়ে গিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে জহুর আহমদ চৌধুরীর কোরবানী সর্বাধিক। তাঁর প্রণাধিক জ্যেষ্ঠপুত্র ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং ভারতে যাওয়ার পথে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি সৈন্যদের এম্বুশে পড়ে যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্রে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর দামপাড়া পল্টন রোডের বাড়িটি ছিলো শহরের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সে বাড়ি থেকেই শহরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকা- পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাও পাঠিয়েছিলেন সেই বাড়ির টেলিফোনে। এসব কারণে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাড়িটির ওপর খড়্গহস্ত ছিলো। তাই ক্র্যাকডাউনের পর প্রথম চোটেই ক্রুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁর বাসভবনটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ও পরে গুঁড়িয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধে সবার আগে ভারত গিয়ে আরেক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর তিনি দিব্যদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ইপিআর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ এবং ছাত্র-জনতার প্রাথমিক প্রতিরোধ শেষ পর্যন্ত টিকবে না। আধুনিক ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রাভিযানের মুখে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে হটতে দেশের মাটিতে যখন আর এক ইঞ্চি জায়গা থাকবে না দাঁড়ানোর, তখন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। এসব কথা ভেবে চিন্তেই জহুর আহমদ চৌধুরী রামগড় সীমান্ত দিয়ে ফেনী নদী পার হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা চলে গেলেন। সঙ্গে চট্টগ্রামের দু’জন শীর্ষস্থানীয় নেতা ও সংসদ সদস্য এম আর সিদ্দিকী ও আবদুল্লাহ আল হারুন। তাঁরা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহকে জানালেন বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং তাঁর আহবানে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তাঁরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সমর্থন ও সাহায্য এবং শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় এ প্রশিক্ষণ প্রদানের আহবান জানান।
জহুর আহমদ চৌধুরী আগরতলায় অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগের পূর্বাঞ্চলীয় এমএনএ ও এমপিএগণ তাঁকে চেয়ারম্যান করে ইস্টার্ন লিবারেশন কাউন্সিল নামে একটি সংস্থা গঠন করেন। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বৃহত্তর নোয়াখালী, বৃহত্তর কুমিল্লা এবং ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ ইস্টার্ন লিবারেশন কাউন্সিলের নির্দেশেই পরিচালিত হয়েছে। এই ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, জহুর আহমদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে কত গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার যখন দেশকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে যুদ্ধ প্রশাসন পরিচালনার উদ্যোগ নেয়, তখনো জহুর আহমদ চৌধুরীকে দক্ষিণ-পূর্ব আঞ্চলিক প্রশাসনিক জোন-২ এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে জহুর আহমদ চৌধুরীই প্রথম মুক্ত স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাগমন করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর কসবা থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন জহুর আহমদ চৌধুরী এবং মুক্তিবাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন। তাঁর সঙ্গে কয়েকজন এমএনএ ও এমপিএ-ও ছিলেন।
১০ ডিসেম্বর বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কাছারী প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অসামরিক প্রশাসন চালু করেন। পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জহুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং উপস্থিত দশ হাজার জনতার এক সমাবেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণে সমস্যাসঙ্কুল আগামী দিনগুলিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের পাশে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে আলী আজম, আব্দুল জামান উপস্থিত ছিলেন। (সুকুমার বিশ্বাস : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আগরতলা ত্রিপুরা দলিলপত্র-পৃ. ৮৪০)
জহুর আহমদ চৌধুরী ১৫ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে কুমিল্লা থেকে ঢাকা যান, কিন্তু নিরাপত্তার খাতিরে তাঁর হেলিকপ্টার ঢাকায় নামতে দেওয়া হয়নি। তিনি ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থান করে ১৬ তারিখে বীরদর্পে ঢাকায় ঢুকে যান। এবং ঢাকা বেতার চালু করে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে দেশ স্বাধীন হওয়ার ঘোষণা দেন। ঢাকাও তাঁর প্রশাসনিক জোনের অন্তর্গত ছিল।
মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভা কলকাতা থেকে ঢাকায় আসে ২২ ডিসেম্বর ’৭১। ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন জহুর আহমদ চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা গঠনের পর মুক্ত স্বদেশে এই প্রথম মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করা হয়। বঙ্গভবনে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বাংলায় পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব হোসেন তওফিক ইমাম সেই সম্প্রসারিত মন্ত্রিসভায় জহুর আহমদ চৌধুরী ছাড়া আর মাত্র তিনজন অন্তর্ভুক্ত হন, তাঁরা হলেন : ফনীভূষণ মজুমদার, আবদুস সামাদ আজাদ ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী। মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী অব, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এএইচএম কামরুজ্জামান। মন্ত্রিসভায় সদস্যদের দফতর বন্টন করা হয় ২৯ ডিসেম্বর বিকেলে। জহুর আহমদ চৌধুরী চারটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান- স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। (ফারুক চৌধুরী : দেশ দেশান্তর-ঢাকা; মীরা প্রকাশ- পৃ. ৮২)
মাত্র যে দেশটি স্বাধীন হয়েছে, চারিদিকে ধ্বংসলীলার স্বাক্ষর আর সর্বস্বহারা মানুষের আহাজারি; সেই দেশটিকে নতুন করে গড়ে তোলার কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে দ্বিধা করলেন না যুদ্ধজয়ী জহুর আহমদ চৌধুরী। একটু জিরোবার সুযোগও পেলেন না; আরেক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শ্রম, সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, চারটি মন্ত্রণালয়ই গুরুত্বপূর্ণ; যুদ্ধের ক্ষত কোথায় নেই। এখন ভাঙ্গাচোরা, বিধ্বস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সারিয়ে তুলে সেখানে আবার স্বাভাবিক কর্মপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে দিনরাত পরিশ্রম করে যেতে লাগলেন। তাঁর স্বাস্থ্য কোন সময়ই ভালো ছিলো না; সেই ভঙ্গুর স্বাস্থ্য যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর দেশ পুনর্গঠনে আরো ক্ষয়ে গেল এবং অবশেষে তার দম ফুরিয়ে এলো। ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই ঢাকায় পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহা প্রস্থান করলেন মহাপ্রাণ জহুর আহমদ চৌধুরী।
জহুর আহমদ চৌধুরী যথার্থ অর্থে একজন পাবলিক লিডার ছিলেন। তাঁর রাজনীতির উৎস ছিলো জনগণ, গন্তব্যও ছিলো জনগণ। এমনই জনপ্রিয় ছিলেন যে, জীবনে কোন নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি। একবার শুধু ্আইয়ুবের আশি হাজার ফেরেশতার বিডি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাই তাঁর ভুল হয়েছিলো। কারণ সেটা তো নির্বাচন নয়, ছিলো প্রহসন।
১৯৫২ সালে জহুর আহমদ চৌধুরী জীবনে প্রথম নির্বাচনে অবতীর্ণ হন এবং তাতে বিজয় লাভ করেন। সেটি ছিলো চট্টগ্রাম পৌরসভার নির্বাচন, জহুর আহমদ চৌধুরী কমিশনার নির্বাচিত হন। তিনি চেয়ারম্যান পদেও নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর জয়ের সম্ভাবনা থাকায় নির্বাচনের প্রাক্কালে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে তিনি আর নির্বাচন করতে পারেন নি।
১৯৫৪ সালে ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জহুর আহমদ চৌধুরী এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে শহরের মূল আসন কোতোয়ালী থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ নির্বাচনে তাঁর বিজয় ছিলো একটি চমকপ্রদ ঘটনা। কারণ যাঁর সাথে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিলো, তিনি ছিলেন একজন হেভিওয়েট প্রার্থী-তৎকালীন চট্টগ্রামের শ্রেষ্ঠ ধনী ও অভিজাত পুরুষ রেয়াজউদ্দিন বাজারের মালিক শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকী। তিনি শুধু চট্টগ্রামের সামাজিক নেতা বা স্থানীয় মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতা ছিলেন না, মুসলিম লীগের প্রদেশ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো, এমনকি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহরও তিনি প্রিয়পাত্র ছিলেন। জহুর আহমদ চৌধুরীও তখন বড় নেতা, কিন্তু রফিউদ্দিন সিদ্দিকীর মাপে ছোট। তাই উভয়ের নির্বাচনী লড়াইটা ছিলো অসম এবং রফিউদ্দিন সিদ্দিকীর বিজয় সম্পর্কে সবাই একরূপ নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে জহুর আহমদ চৌধুরীই জয়লাভ করলেন। এই নির্বাচনী ফলাফলের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখে তাতে মন্তব্য করেছিলো “মক্ষিকার কাছে হস্তির পরাজয়”।
আইন সভার সদস্য (এম.এল.এ-মেম্বার অব দি লেজিসলেটিভ এসেম্ব্লি) হয়ে জহুর আহমদ চৌধুরী নিজেকে সফল পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। আইন সভায় তিনি চট্টগ্রামকে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন। জীবনে আরো দু’বার ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ’৭৩ সালে ছিল তার শেষ নির্বাচন, একবছর পর ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই তিনি পরলোকগমন করেন।
জহুর আহমদ চৌধুরী আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা-সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। এমএ আজিজসহ চট্টগ্রাম থেকে মোট ১১জন ডেলিগেট রোজ গার্ডেন সম্মেলনে যোগদান করেন। পুরানো ঢাকার টিকাটুলীর কে এম দাশ লেনে কাজী মোহাম্মদ বশীর হুমায়ুনের বাসভবন রোজ গার্ডেন-এর হল রুমে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। উক্ত ১১জন ডেলিগেট ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে এসে এখানেও আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। সালারে জিলা শহীদ শেখ মোজাফফর আহমদ ও এমএ আজিজকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং আমীর হোসেন দোভাষ ও জহুর আহমদ চৌধুরীকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কমিটি গঠন করা হয়।
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের দুই স্তম্ভ জহুর আহমদ চৌধুরী ও এমএ আজিজ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত সহচর ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এই দুই নেতা চট্টগ্রামকে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুও চট্টগ্রামকে তাঁর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গণ্য করতেন। জহুর- আজিজের ওপর নির্ভর করে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করতেন। এমনই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যা’ পাকিস্তানের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো এবং বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলো, সেই ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণার জন্য তিনি ঢাকাকে নিরাপদ মনে করতে পারেন নি। নিরাপদ ভেবেছিলেন জহুর-আজিজের চট্টগ্রামকে। তাঁর বিশ্বাস ছিলো সরকার বা মুসলিম লীগের লোকেরা কোনো গ-গোল পাকাতে চাইলে তা জহুর-আজিজ ঠেকাতে পারবেন, কেননা চট্টগ্রামে তাদের শক্তিশালী সংগঠন আছে। এই নির্ভরতা থেকে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের জনসভায় ঘোষণা করলেন বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফা। ইতিহাস সৃষ্টি করলো চট্টগ্রাম।
আত্মজীবনীর অন্যত্র বঙ্গবন্ধু জহুর আহমদ চৌধুরীকে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু বলে উল্লেখ করেছেন (প্রাগুক্ত-পৃ: ৪৫)। ১৯৪৯ সালে ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পর প্রথম যে দু’ একটি জেলায় কমিটি গঠিত হয়েছিলো, তার মধ্যে চট্টগ্রাম অন্যতম। বঙ্গবন্ধু লিখছেন “…আমরা এখনও জেলা কমিটিগুলি গঠন করতে পারি নাই। তবে দু’একটি জেলায় কমিটি হয়েছিল। চট্টগ্রামে এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এবং যশোরে খড়কীর পীর সাহেব ও হাবিবুর রহমান এডভোকেটের নেতৃত্বে (প্রাগুক্ত-পৃ ১৩০)”। পরে আরো স্পষ্ট করে লিখছেন, “…নোয়াখালিতে আবদুল জব্বার খদ্দর সাহেব জেলা কমিটি গঠন করেছেন। চট্টগ্রামের আবদুল আজিজ, মোজাফফর (সালারে জিলা শেখ মোজাফফর আহমদ-সম্পাদক), জহুর আহমদ চৌধুরী ও কুমিল্লায় আবদুর রহমান খান, লাল মিঞা ও মোশতাক আহমদ আওয়ামী লীগ গঠন করেছেন। (পৃ: ২২১)
শ্রমিক রাজনীতিতে জহুর আহমদ চৌধুরী একটি কিংবদন্তী নাম। তাঁকে চট্টগ্রামের শ্রমিক রাজনীতির পিতা, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানেও প্রথম ট্রেড ইউনিয়নের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। ট্রেড ইউনিয়ন দিয়েই তিনি রাজনীতি শুরু করেন এবং ট্রেড ইউনিয়নই হয়তো তাঁর সারাজীবনের মৌলিক কাজ। তিনি বহু ট্রেড ইউনিয়নের জন্ম দেন এবং আজীবন সেসব ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।
জহুর আহমদ চৌধুরীর শ্রমিক রাজনীতি ছিলো স্বকীয় বৈশিষ্ট্যম-িত। শ্রমিক রাজনীতিকে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন অর্থাৎ অর্থনীতিবাদী আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। ট্রেড ইউনিয়ন দিয়ে রাজনীতি করতে চাননি। কিংবা রাজনীতির মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নকে টেনে আনতে চান নি। তাঁর ট্রেড ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকরা হয়তো তাঁর রাজনীতির সহায়ক হয়েছে, যেমন চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তনে তাঁর অনুসারী শ্রমিক কর্মচারীরা বিরাট অবদান রেখেছিলো। কিন্তু তিনি নিজে সচতনভাবে ট্রেড ইউনিয়নকে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করতে চান নি। তাঁর ট্রেড ইউনিয়ন ঐ সিবিএ পর্যন্ত, শ্রমিক-কর্মচারীদের রুটি-রুজি, জীবনমান উন্নয়নের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিলো। এ কারণে ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে শ্রমিক লীগ প্রতিষ্ঠা করা হলে জহুর আহমদ চৌধুরী এই সংগঠনে যোগদান করতে অস্বীকার করেন। তাঁকে এই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো কিন্তু তাতেও তাঁর অবস্থান থেকে তাঁকে টলানো যায় নি। এমন কি, বঙ্গবন্ধুর অনুরোধও রাখতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় গণতান্ত্রিক শ্রমিক ফেডারেশন নিয়েই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন চালিয়ে যান। তিনি ছিলেন জাতীয় গণতান্ত্রিক শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আর জামশেদ আহমদ চৌধুরী ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। তিনিও একজন খ্যাতিমান শ্রমিক নেতা ছিলেন।
জহুর আহমদ চৌধুরী সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মছিলেন। তাঁর জন্মের কালে সম্ভবত পরিবারটির অবস্থা ভালো ছিলো না। ফলে তাঁর শৈশব ও কৈশোরের জীবন সুখকর হয় নি। জীবনের প্রারম্ভে যে দুঃখ ও দারিদ্র্যের করুণ অভিজ্ঞতা তিনি লাভ করেন, তার স্মৃতি তিনি সারাজীবন বহন করেছেন। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দারিদ্র তাঁর সঙ্গছাড়া হয়নি। জীবন যখন তাঁকে ত্যাগ করেছে, তখন তিন তরফের এক কম কুড়ি সদস্যের বংশধরদের জন্য রেখে যান মাত্র ২০০ টাকা উত্তরাধিকার। চাইলে বিরাট বড়লোক হয়ে যেতে পারতেন; অর্থবিত্তের অধিকারী হবার কত সুযোগ তাঁর সামনে খোলা ছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাজারে কলকাতার পথে-ঘাটে যখন টাকা উড়ছিলো, তখন তিনি সেখানেই ছিলেন; ৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় চোরাকারবার, মজুতদারি করে যখন বহু লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে, তখনো তিনি কলকাতায়; তাঁর নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন সরবরাহ মন্ত্রী. তো চাইলে জহুর আহমদ চৌধুরী তাঁর নেতার কাছ থেকে কোনো কন্ট্রাক্ট বা ঠিকা, পারমিট, এমকি তখন যে রেশনিং প্রথা চালু হয়েছিলো, সেখান থেকে একটি রেশন সপ খোলার অনুমতি নিয়ে নিজের আখের গোছাতে পারতেন। পরে সোহরাওয়ার্দী যখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন, তখন জহুর আহমদ চৌধুরী তাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মী; পয়সা কামানোর জন্য অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীর এক আঙুলের ইশারাই তো যথেষ্ট। সোহরাওয়ার্দী ৫৬ সালে পাকিস্তানেরও প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তিনি আওয়ামী লীগ নেতা আর জহুর আহমদ চৌধুরী তাঁর আরো কাছের মানুষ এবং চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

জয় বাংলা

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত গতকাল এক রায়ে বলেছে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান নয়। ইতিপূর্বে হাইকোর্ট ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান বলে রায় দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ সেই

বিস্তারিত »

সাংবাদিক মাহবুব উল আলমের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, বাম রাজনীতির নীরব সমর্থক ও সংগঠক, মাইজভাণ্ডারী দর্শন ও মওলানা ভাসানীর একনিষ্ঠ অনুসারী এবং সাহিত্যিক মোহাম্মদ মাহবুব উল আলম হাটহাজারী

বিস্তারিত »

আতাউর রহমান খান কায়সার

আতাউর রহমান খান কায়সার চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আনোয়ারার জমিদার এয়ার আলী খান বঙ্গীয় আইন পরিষদ

বিস্তারিত »

বাংলাদেশে আবার পাকিস্তানের জিগির

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী শেখ হাসিনার যুগপৎ পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের পর দেশ পরিচালনার জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা উঠতে না উঠতেই প্রধান

বিস্তারিত »

এস আলমের সমর্থনে চট্টগ্রামের মানুষ রাস্তায় নামতে পারে

সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হয়েছে, চট্টগ্রামের এস আলম শিল্পগোষ্ঠী। এস আলমের স্বত্ত¡াধিকারী সাইফুল আলম মাসুদ, তাঁর স্ত্রী এবং শিল্পগোষ্ঠীর পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত তাঁর ভাইদের ব্যাংক

বিস্তারিত »

ব্যবসায়ী শিল্পোদ্যোক্তারা আতঙ্কিত

দেশের বৃহৎ কর্পোরেট শিল্পগোষ্ঠীগুলি সরকারের হয়রানির ভয়ে কুঁকড়ে আছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাদেরকে নিয়ে যে টানা হ্যাঁচড়া শুরু করেছে, তার কোনো থামাথামি

বিস্তারিত »

কক্সবাজার রেললাইন, বঙ্গবন্ধু টানেল, পদ্মা সেতু অনেক প্রধানমন্ত্রীর কাজ এক প্রধানমন্ত্রী করে ফেলছেন :

কেউ কি ভেবেছিলো কক্সবাজারে ট্রেন যাবে ? কেউ কি ভেবেছিলো কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সুড়ঙ্গ হবে এবং সেই সুড়ঙ্গ পথই কর্ণফুলীর পানি পাড়ি দিয়ে এপার ওপার

বিস্তারিত »

আওয়ামী লীগ নেতা, মুক্তিযোদ্ধা এজাহার মিয়া প্রথম বঙ্গবন্ধুর কবর জেয়ারত করেন

পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সকল সদস্য এবং নিকট আত্মীয়স্বজনকে পৈশাচিক উপায়ে হত্যা করার পর দেশে চরম ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ

বিস্তারিত »

বঙ্গবন্ধুর কবর প্রথম জেয়ারত করেন মুক্তিযোদ্ধা এজাহার মিয়া

পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সকল সদস্য এবং নিকট আত্মীয়স্বজনকে পৈশাচিক উপায়ে হত্যা করার পর দেশে চরম ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ

বিস্তারিত »