দক্ষিণ ভারতের ব্যাঙ্গালুরু যা একসময় ব্যাঙ্গালোর নামে পরিচিত ছিল, এই শহরটি বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানির জন্য বিখ্যাত। এসব কোম্পানির কাজের ধরন ও কর্মীদের কারণে এখানে গড়ে উঠেছে ভিন্ন ধরনের এক সংস্কৃতি।
ভারতের অন্য যে কোনো শহরের তুলনায় এই ব্যাঙ্গালুরু শহরে অনেক দ্রুত ব্যবসা ও বাণিজ্যের প্রসার ঘটে প্রযুক্তির কল্যাণে। এখানকার বিভিন্ন কোম্পানিতে যেসব প্রকৌশলী ও তথ্য-প্রযুক্তিবিদ কাজ করেন, তাদের রয়েছে বিশেষ কদর ও মর্যাদা। সুপরিচিত সব আন্তর্জাতিক টেক জায়ান্ট অনেক বেশি বেতন দিয়েও তাদেরকে কর্মী হিসেবে হায়ার করতে আগ্রহী।
কিন্তু ৫০ বছর আগেও বর্তমান ব্যাঙ্গালুরু শহরের চিত্রটা এরকম উজ্জ্বল ছিল না। প্রযুক্তির দিক থেকে এটি ছিল ভারতের পিছিয়ে থাকা অন্যান্য শহরের মতোই আরো একটি শহর।
এই শহরটি কিভাবে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং এক পর্যায়ে হয়ে উঠল ভারতের সিলিকন ভ্যালি?
ইনফোসিসের সূচনা
ব্যাঙ্গালুরুতে গড়ে ওঠা এমন একটি সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানের নাম ইনফোসিস। শহরটিকে ভারতের সিলিকন ভ্যালিতে রূপান্তরিত করার পেছনে এই কোম্পানির অবদান উল্লেখ করার মতো।
“একেবারে প্রথম দিন থেকেই আমরা কৃচ্ছ্র সাধনে বিশ্বাস করতাম। কারণ আমাদের কাছে প্রচুর অর্থ ছিল না। একারণে আমরা যে পাঁচ/ছ’জন কাজ করতাম, তারা সবাই মিলে এক রুমের একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম,” বলছিলেন ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি।
১৯৮০-এর দশকে গড়ে ওঠা এই ইনফোসিস বর্তমানে ভারতের বৃহত্তম প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর একটি।
কোম্পানির শুরুর দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে গিয়ে মি. মূর্তি বলেন, “সন্ধ্যার সময় আমরা সবাই একসঙ্গে সময় কাটাতাম। সেটা ছিল অন্য রকমের আনন্দ। আমাদের মধ্যে কেউ রান্না করতো, কেউ সবজি কাটাকুটি করতো, কেউ হয়তো থালাবাসন ধোয়া-মোছা করতো। আমরা একটা টিমের মতো ছিলাম। সবাই মিলে অনেক মজা করতাম।”
“ভেবে দেখুন, আজকের দিনে এরকম একটি কোম্পানির আর্থিক মূল্য আট হাজার কোটি ডলার। এ থেকে বোঝা যায় সেসময় আমরা যে কঠোর পরিশ্রম করেছি তার প্রতিদান আমরা পেয়েছি,” বলেন তিনি।
নারায়ণ মূর্তির উদ্যোগ
নারায়ণ মূর্তির জন্ম ১৯৪৬ সালে, ভারতের কর্নাটক রাজ্যে, যা ব্যাঙ্গালুরু থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
নিজের পরিবারের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের পরিবারে ছিল ১১ জন। এটা ছিল একটা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার। হাই স্কুলের একজন শিক্ষকের বেতন দিয়ে এতো জনের সংসার পরিচালনা করা খুব এটা সহজ ছিল না।”
নারায়ণ মূর্তির জন্মের মাত্র এক বছর পরেই ১৯৪৭ সালে ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দেশটির প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন।
এর আগে থেকেই দক্ষ প্রকৌশলী তৈরির করার জন্য ব্যাঙ্গালুরু শহরটির খ্যাতি ছিল। ভৌগলিকভাবেও দেশের মাঝখানে হওয়ার কারণে এই শহরটির ছিল বাড়তি কিছু সুবিধা।
ভারতের শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ার কারণে, প্রধানমন্ত্রী নেহরু এই শহরে প্রযুক্তি খাত গড়ে তোলার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটা লাভবান হয়েছিল।
বিশাল বিশাল যন্ত্র
কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের আগ পর্যন্তও ভারত প্রযুক্তি বিষয়ক সুপার-পাওয়ার হয়ে উঠতে পারেনি।
“সেসময় আমরা যেসব যন্ত্র দেখেছি সেগুলো ছিল বিশাল আকৃতির। একটি ছিল দুই ফুট বাই তিন ফুট,” বলেন নারায়ণ মূর্তি।
“একদিন আমার এক সহপাঠী বলল যে সে আমাকে কম্পিউটার দেখাতে নিয়ে যাবে। পড়ালেখার জন্য আমি যেখানে থাকতে গিয়েছিলাম সেখানে পৌঁছানোর দ্বিতীয় দিনেই সে একথা বলল।”
“আমার ওই সহপাঠী আমাকে একটি যন্ত্র দেখাল যা থেকে প্রচুর শব্দ তৈরি হতো। সেখান থেকে পাতার পর পাতা প্রিন্ট হয়ে বের হয়ে আসছিল। সে বলল এটা একটা কম্পিউটার যা দেখে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় বন্ধুদের বললাম যে এই প্রথম আমি একটা কম্পিউটার দেখেছি। তারা সবাই হেসে উঠল। সে তখন বলল, বন্ধু, তুমি যা দেখেছ সেটা কম্পিউটার ছিল না, সেটা ছিল প্রিন্টার,” হাসতে হাসতে বলেন তিনি।
নারায়ণ মূর্তি তখনও কম্পিউটার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতেন না। কিন্তু তিনি জানতেন যে এই কম্পিউটারই হতে যাচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ।
বদলে গেল যেভাবে
সেসময় ভারতের বামপন্থী সরকার দেশটির বেশিরভাগ প্রযুক্তি শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু বয়সে তরুণ নারায়ণ মূর্তি, সেসময় তার বয়স হবে ২৭-২৮, যখন ইউরোপ সফরে যান তখন তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে এই সিস্টেম বদলাতে হবে।
“আমি প্যারিস থেকে অমৃতসরে চলে এলাম। ইউরোপে আমি দেখলাম যে চারপাশে সমৃদ্ধি। রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দ্রুতগতির ট্রেনগুলো বেশ ভালোভাবেই চলছে। তখন থেকেই বামপন্থী আদর্শ এবং সমাজতন্ত্রের ওপর আমার বিশ্বাস ধসে পড়তে শুরু করল।”
মি. মূর্তি বলেন, “তখনই আমি উপলব্ধি করলাম যে দারিদ্র থেকে একটি দেশের বের হয়ে আসার একমাত্র উপায় হচ্ছে ব্যবসা বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা যাতে তারা আরো বেশি করে সম্পদ ও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে পারে।”
নারায়ণ মূর্তি তখনই একজন উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
“একদম। তখনই আমি ১৯৮১ সালে ইনফোসিস প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেই। এবং তার পরের ঘটনা তো, আমি বলবো, ইতিহাস।”
ইনফোসিস প্রতিষ্ঠার জন্য মি. মূর্তি ছ’জন প্রকৌশলী নিয়োগ করেন। প্রতিষ্ঠার দু’বছর পর ১৯৮৩ সালে কোম্পানির সদরদপ্তর নিয়ে যান ব্যাঙ্গালুরু শহরে।
শুরুর দিকে যেসব কোম্পানি ইনফোসিসের ক্লায়েন্ট ছিল তার বেশিরভাগই ছিল রিবকসহ আমেরিকার কয়েকটি পোশাক কোম্পানি।
সফটওয়্যার উদ্ভাবন
ইনফোসিস এমন কিছু সফটওয়্যার তৈরি করলো যার সাহায্যে আমেরিকার একটি কোম্পানি কোনো একটি পোশাক তৈরির জন্য তাইওয়ানের অরণ্যে অবস্থিত পোশাক প্রস্তুতকারী একটি কারখানার কাছে কাস্টমার অর্ডার পাঠাতে পারে।
এই সফটওয়্যারের কারণে অর্ডার দেওয়া এবং পণ্য ও সেবার জন্য মূল্য পরিশোধ করা অনেক বেশি দ্রুত ও সহজ হয়ে ওঠে।
কিন্তু তখনও ইনফোসিস প্রযুক্তি-খাতে ইতিহাস তৈরি করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানটির আরো বড় হয়ে ওঠার জন্য তাদেরকে ভারতের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বড় ধরনের লড়াই শুরু করতে হয়।
“আমার অ্যাপার্টমেন্টের একটি বেডরুম থেকে এই কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেসময় কোম্পানির কোনো কম্পিউটার ছিল না। একটি কম্পিউটার আমদানি করার জন্য ৩০ বার রাজধানী দিল্লিতে যেতে হতো এবং এজন্য গড়ে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতো,” বলেন নারায়ণ মূর্তি।
“১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ভারতের অবস্থা এরকমই ছিল।”
নানা ধরনের বাধা বিপত্তির কারণে ইনফোসিসকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া ছিল বেশ কঠিন কাজ। দশ বছর পর এই কোম্পানির রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়ায় মাঝারি আকারের। সেসময় রাষ্ট্রীয় নানা ব্যবস্থার কারণে কোম্পানির খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। ১৯৮৮ সালে আমেরিকায় যখন লাখ লাখ কম্পিউটারে কাজ হতো, তখন সারা ভারতে ছিল মাত্র কয়েক হাজার।
আকস্মিক পরিবর্তন
কিন্তু ১৯৯১ সালে হঠাৎ করেই সবকিছু বদলে গেল।
১৯৯৭ সালে প্রচারিত বিবিসির একটি তথ্যচিত্রে দেখানো হয় যে কয়েক বছর আগেও ভারতের ব্যাঙ্গালুরু শহর অনেক পিছিয়ে ছিল। কিন্তু এখন এই শহরের চেহারা আমূল বদলে গেছে। এটি এখন ভারতের ‘কম্পিউটার রাজধানীতে’ পরিণত হয়েছে।
ভারত সরকার ১৯৯১ সালে উদার অর্থনীতির নীতি গ্রহণ করে। এর ফলে ইনফোসিসের মতো বিভিন্ন কোম্পানি নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ ও বিধি-নিষেধ থেকে মুক্তি লাভ করে।
এর ফলে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করে। প্রবেশ করে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েভ বা ইন্টারনেট।
স্যাটেলাইট যোগাযোগ এবং ভিডিও কনফারেন্সিং প্রযুক্তি কারণে বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী কোম্পানিগুলো এতো কাছাকাছি চলে আসে যেন তারা পাশের রাস্তায় অবস্থান করছে।
নব্বই-এর দশকের মাঝামাঝি ইনফোসিসে কাজ করতেন এরকম একজন প্রযুক্তিবিদ বলেন হঠাৎ করেই তাদের কদর কেন এতো বেড়ে গিয়েছিল।
“আমি যে ধরনের কাজ করতাম, এখানে সেই কাজটা খুব সহজেই ৩০ গুণ কম খরচে করা যায়,” বলেন তিনি।
সামনের কাতারে ব্যাঙ্গালুরু
কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো সামনের কাতারে চলে আসে। এর পরে গত কয়েক দশক ধরে তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছে। এবং তখনই সারা বিশ্বের নজরে চলে আসে ব্যাঙ্গালুরু শহর।
এই শহরে যেসব প্রকৌশলী কাজ করেন সারা বিশ্বের প্রযুক্তিবিদরা তাদের ইর্ষার চোখে দেখেন।
“এটা শুধু একারণে নয় যে ভারতীয়রা ভালো বেতনের আশায় পশ্চিমা দেশগুলোতে চলে যেতে চাইছে, এটা একারণেও হয়েছে যে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ সব পদের জন্য ভারতীয়দের খুঁজতে শুরু করলো,” বলেন ইনফোসিসের ওই কর্মকর্তা।
ইনফোসিস ১৯৯৯ সালের ১১ই মার্চ আমেরিকার শেয়ার মার্কেট নাসডাকে তালিকাভুক্ত হয়। এর মধ্য দিয়ে এটি পরিণত হয় বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে।
এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের ভূমিকা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
নারায়ণ মূর্তি বলেন, “ইনফোসিস যেদিন নাসডাকে তালিকাভুক্ত হলো, এটাই ছিল ভারতের প্রথম কোনো কোম্পানি যা নাসডাকে তালিকাভুক্ত হলো, সেদিন আমি নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে নাসডাক এক্সচেঞ্জের অফিসে উঁচু একটা টুলের ওপর বসেছিলাম। নীল আর্মস্ট্রং-এর কাছ থেকে কিছু কথা ধার করে সেদিন আমি বলেছিলাম- নাসডাকের জন্য এটা একটা ছোট্ট পদক্ষেপ, কিন্তু ইনফোসিস ও ভারতের জন্য এটা একটা বিশাল লাফ দেওয়ার ঘটনা।”
“আমি মনে করি সেই দিনটা ছিল অনেক বড় একটা দিন।”
প্রযুক্তি বিপ্লব
এর পরে গত ৪০ বছরে ব্যাঙ্গালুরুতে প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটে গেছে।
কিন্তু শহরের এই পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি কি তখনকার ইউরোপের মতো হয়েছে যা নারায়ণ মূর্তি তার সফরে প্রত্যক্ষ করেছিলেন?
মি. মূর্তি বলেন, “আমাদের নাগরিকদের জীবন অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক হয়েছে। এখন অনেক ভালো হাসপাতাল আছে, ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু এসব কি যথেষ্ট?”
“না, এটা এমন একটা কাজ যা এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু গত ৩০ বছরে আমরা বড় ধরনের পরিবর্তন দেখেছি যা আমাদের মধ্যে আশা জাগিয়েছে। একারণে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরই কঠোর পরিশ্রম করার কথা মনে পড়ে। কারণ আমরা জানি কাজের শেষে আমরা আরো উন্নত ভারত দেখতে পাবো।”
বর্তমানে ইনফোসিস বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির জন্য সফটওয়্যার তৈরি করে এবং ৫০টিরও বেশি দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তি সংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে থাকে।
নারায়ণ মূর্তি ২০১৪ সালে ইনফোসিস থেকে অবসর নিয়েছেন।
বর্তমানে তার বেশিরভাগ সময় কাটে পদার্থ বিজ্ঞান ও কম্পিউটার সায়েন্সের ওপর বই পড়ে।
বিবিসির জন্য ইতিহাসের সাক্ষীর এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বেন হেন্ডারসন।