মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে অনেকগুলো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। সেইসব ঘটনার শোক ও দুঃখের দহন কখনো চট্টগ্রামবাসী ভুলতে পারবে না। দিনগুলো যখন ঘনিয়ে আসে, তখন চট্টগ্রামের আকাশে কান্নার রোল বাষ্পাকারে ঘনীভূত হতে হতে ভারি মেঘে ছেয়ে যায়। তারপর আসে একে একে বেদনাবিধূর সেইসব দিনÑ২৮ মার্চ চেরাগী পাহাড় হত্যাকা-, ১৩ এপ্রিল রাউজানের পাহাড়তলীতে সাইফুদ্দিন-রব-দিলীপ-মোজাফফর হত্যাকা-, ১৮ এপ্রিল হাটহাজারীতে মোজাফফর-আলমগীর হত্যাকা-; ২১ সেপ্টেম্বর যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের ন্যায় যুদ্ধ করতে করতে ঢলে পড়েন মুরিদুল আলম। আর সেসব দিনে বেদনার রঙে রঙে নীল হয়ে যান বশরুজ্জামানের ভ্রাতুষ্পুত্র ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, সাইফুদ্দিনের ভাই মাহতাবউদ্দিন চৌধুরী (বর্তমানে নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি), শেখ মোজাফফরের পুত্র কবি খুরশিদ আনোয়ার। দামপাড়ায় সাইফুুিদ্দনের বাড়িতে, চন্দনাইশের বরমা গ্রামে বালবিধবা জেসমিন আলমের শ্বশুর বাড়িতে, এনায়েতবাজারে দীপকের ভাই বাপ্পীর বাসায়, মাদারবাড়িতে জাফরের বাড়িতে, ফটিকছড়িতে মাহবুবুল আলমের বাড়িতে, ঢেমশায় অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরীর বাড়িতে এবং বোয়ালখালীতে মোজাফফরের বাড়িতে হাহাকার পড়ে যায়।
চারটি ঘটনায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বড় ক্ষতি হয়ে যায়। সালারে জিলা শেখ মোজাফফর সাহেব ছিলেন বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি; মুরিদুল আলম ছিলেন ষাট দশকে আইয়ুবের সামরিক লৌহবেষ্টনী থেকে ছাত্রলীগের সূর্য ছিনিয়ে আনার দুরন্ত অভিযাত্রিক; সাইফুদ্দিন ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরীর প্রাণাধিক জ্যেষ্ঠপুত্র এবং সিটি কলেজের এজিএস ও কলেজ ছাত্রলীগের নির্বাচনী সংগঠন অভিযাত্রিকের সভাপতি; আবদুর রব ছিলেন চাকসুর প্রথম জিএস ও তুখোড় ছাত্রনেতা; মোজাফফর ছিলেন বোয়ালখালী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বশর-জাফর-দীপক ছিলো চট্টগ্রামের সাহসী ছাত্রনেতা।
আজ ১৩ এপ্রিল, একাত্তরের চরম বিভীষিকাময়, বীভৎস, ভয়াবহ এবং ভীষণ রকম অশুভ একটি দিন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই এদিন ঝরে গিয়েছিলো পাঁচটি অমূল্য প্রাণ। কু-েশ্বরীতে অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহ, পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সম্মুখে জহুর আহমদ চৌধুরীর পুত্র ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী, চাকসুর জিএস আবদুর রব, বোয়ালখালী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোজাফফর আহমদ। এক একটি মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারি।
সাইফুদ্দিন অভিযাত্রিক তথা ছাত্রলীগের অন্যতম নীতি নির্ধারক ছিলেন। পিতা জহুর আহমদ চৌধুরী সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন বলে নয়, আপন যোগ্যতা বলেই নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তিনি। নেতৃত্বের সমস্ত গুণই তাঁর ছিলো, যেমন সাহস। পিতার ন্যায় শীর্ণ দেহটি ছিলো যেন জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, সময়ে জ্বলে উঠতে যার বিলম্ব হতো না। একটি ঘটনা এখানে উদাহরণ হিসেবে পেশ করা যেতে পারে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে ফেরদৌস কোরেশী-আল মুজাহিদীর নেতৃত্বে বাংলা ছাত্রলীগ নামে একটি নতুন সংগঠনের সৃষ্টি হলে চট্টগ্রামে তাকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হয় মহাবলী কিবরিয়াকে। এই সেই কিবরিয়া, একদা এনএসএফ-এর দৌরাত্ম্যের মুখে যার বাহুবলে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এবার তিনি খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ছাত্রলীগ ধ্বংসের মিশনে নামলেন। তা’ প্রথমেই তাঁর চোখ পড়লো সিটি কলেজের ওপর। কারণ একে তো তিনি এই কলেজের ছাত্র, তদুপরি তাঁর মারামারি, নেতাগিরি সব এই কলেজকে ঘিরেই। শহরের রাজনীতির ওপরও সিটি কলেজের বিরাট প্রভাব ছিলো। তাই কিবরিয়া সিটি কলেজ দখল করতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। একদিন তিনি সদলবলে কলেজ আক্রমণ করতে গেলে কিবরিয়া-ভীতির কারণে কেউ তার সামনে দাঁড়াবার সাহস তো পেলোই না, বরং পড়ি মরি করে ছুটে পালাতে লাগলো। কিন্তু না, হঠাৎ দেখা গেলো হালকা পাতলা একটি ছাত্রই কিবরিয়াকে রুখে দাঁড়িয়েছে। তিনিই সাইফুদ্দিন।
অসম লড়াই, কিবরিয়ার সামনে সাইফুদ্দিন কিছুই না, ফুৎকারেই উড়ে যাওয়ার কথা। তবুও টাইসনকে মুষ্ট্যাঘাত করে সাইফুদ্দিন বলেছিলেন, ‘কিবরিয়া, গু-ামি করবি না, তোর দিন শেষ।’ তার পরের দৃশ্যে কিবরিয়ার প্রত্যাঘাতে সাইফুদ্দিন রক্তাক্ত। এতেই কাজ হয়। কিবরিয়ার আগমনে যারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলো, তারাও এবার সম্বিৎ ফিরে পায় এবং সাইফুদ্দিনের সমর্থনে এগিয়ে আসে। এখানে সাইফুদ্দিন কিবরিয়াকে কতটা আঘাত করতে পেরেছিলেন, সেটা ধর্তব্য নয়। বিবেচ্য বিষয় হলো সাইফুদ্দিন একা কিবরিয়াকে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং নিজের শরীরের রক্ত ঝরিয়ে ছাত্রলীগের দুর্গকে বেদখল হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। এই ঘটনা থেকে সাইফুদ্দিনের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সাহস ও ব্যক্তিত্বের পরিচয় ফুটে ওঠে।
২৬ মার্চ সকালে সাইফুদ্দিন এই বলে ঘর থেকে বের হয়ে যান যে তিনি প্রথমে আলি আকবর সওদাগরের কাছে যাবেন, সেখান থেকে চকবাজারে যাবেন টাকার জন্য। তাঁর ৭০টি টাকার প্রয়োজন গাড়ি ভাড়ার জন্য, পটিয়া যেতে হবে। পটিয়া সদরে তখন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্য যারা বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন তাদের শক্ত ঘাঁটি। তবে সাইফুদ্দিন সেখানে নয়, তিনি যান তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফের কুসুমপুরার বাড়িতে। সুলতান (সুলতান উল কবির চৌধুরী) ও ইউসুফ সাহেবের ছাত্র, সেই হিসাবে তারা সবাই হয়ত কর্ণফুলী পার হয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ গ্রামীণ জনপদে সাময়িক আশ্রয় নিতে গিয়েছিলেন। সাইফুদ্দিনের বন্ধু এবং অধ্যাপক ইউসুফের ছাত্র কলামিস্ট ইদরিস আলম লিখেছেন, তিনি এবং সাবেক মন্ত্রী ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এম এ মান্নান ২৮ মার্চ সাইফুদ্দিনকে কোরবাণীগঞ্জ থেকে পটিয়া থানার কুসুমপুরা গ্রামে সিটি কলেজের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফের বাড়িতে রেখে আসেন। সম্ভবত কুসুমপুরা থেকেই পরে কোন এক সময় সাইফুদ্দিন পটিয়া সদরে যান এবং সেখানে সুলতান ও ফিরোজের সাথে তাঁর দেখা হয়। ইদরিস আলমের সাথে পটিয়ায়ও সাইফুদ্দিনের দেখা হয়েছিল। তিনি তখন একবার ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আবার দেশে ফিরে এসেছেন। তিনি সাইফুদ্দিনকে তাঁর সঙ্গে ভারতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু সাইফুদ্দিন রাজি হননি।
পরবর্তীকালে সুলতান উল কবির চৌধুরী যখন ভারতে যাওয়ার উদ্যোগ নেন, তখন সাইফুদ্দিন তাঁর সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে যান। সেই যাত্রাপথেই তাঁরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে পড়ে যান এবং তাদের ব্রাশ ফায়ারে সাইফুদ্দিন, রব, অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী, মোজাফফর আহমদ ও চালক ইউনুস কচুকাটা হয়ে যান।
এই হত্যাকা- থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বাঁশাখালীর সাবেক সংসদ সদস্য সুলতান উল কবির চৌধুরীর কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১১ এপ্রিল পটিয়া ডাক বাংলোয় সাইফুদ্দিন, রব ও ফিরোজের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তাঁরা সেখানে বসে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা বান্দরবানগামী ইপিআরের একটি লরিতে উঠে পড়েন। বান্দরবান পৌঁছে তারা সেখানকার এসডিও আবদুল শাকুরের সাথে দেখা করে ভারতে যাওয়ার রুট নিয়ে খোঁজ-খবর নেন। এসডিও তাদেরকে বলেন, আপনারা ভুল পথে এসেছেন, এই পথে ভারতে যেতে হলে আপনাদেরকে প্রায় চারশ মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে। তিনি তাদেরকে বিকল্প সহজ পথ হিসেবে চন্দ্রঘোনা, কাপ্তাই, পাহাড়তলী হয়ে রামগড় দিয়ে ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেই পরামর্শ অনুযায়ী সুলতান, সাইফুদ্দিন, রব, ফিরোজ, রামুর সিদ্দিক, মিরসরাই’র রুস্তম বা শামসু-এই সাত জনের দলটি চন্দ্রঘোনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তাঁরা দ্রুত ধাবমান একটি জিপকে থামানোর চেষ্টা করেন কিন্তু জিপের চালক তাদের ইশারায় কর্ণপাত না করে দ্রুত তার গন্তব্য পথে চলে যান। বিধি বাম! জিপটি কিছুদূর গিয়ে ছড়ার মধ্যে অচল হয়ে পড়ে থাকে। সুলতানদের দল কাছে এসে দেখেন জিপের আরোহীরা তাদের পূর্ব পরিচিত। তাদের মধ্যে ছিলেন কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের গণিতের অধ্যাপক সাতকানিয়ার দিলীপ চৌধুরী, বোয়ালখালী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোজাফফর আহমদ, ইউনুস, নুরুল ইসলাম, ইদ্রিস।
সবার গন্তব্য অভিন্ন জেনে একসঙ্গে যাওয়া সাব্যস্ত হলো এবং সবাই ধরাধরি করে জিপটিকে খাড়া করে চড়ে বসলেন। রাতেই তারা চন্দ্রঘোনা পৌঁছলেন কিন্তু কর্ণফুলী পার হবার ফেরি পেলেন না। সকালে পার হলেন। জিপের সামনের আসনে অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী, আবদুর রব ও মোজাফফর আহমদ। পেছনের সিটে সুলতান, সাইফুদ্দিন, ফিরোজ, সিদ্দিক, রুস্তম, নুরুল ইসলাম ও ড্রাইভারের সহকারী। জিপে ছিলো বঙ্গবন্ধু’র স্বাধীনতার ঘোষণার কপি, প্রচারপত্র, অয়্যারলেস সেট ও কিছু বেতার যন্ত্রপাতি। জিপের সামনে ছিলো একটি সাবমেশিন গান, কয়েকটি রাইফেল ও বেশ কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড। জিপ দ্রুত ছুটে যাচ্ছিলো।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কিছু আগে একটি মাজারের মোড় পার হতেই হঠাৎ খোলা রাস্তা। একপাশে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, অন্য পাশে ইমাম গাজ্জালী কলেজ। চৈত্রের সকাল বেলার সূর্যের তেজ ঠিকরে পড়ছিলো, রাস্তায় সুনসান নীরবতা। হঠাৎ একটি লোক যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হলো। ড্রাইভার ইউনুস গাড়ির গতি শ্লথ করে তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন রাস্তা পরিষ্কার আছে কি না। সে হ্যাঁ বলতে ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। ইমাম গাজ্জালী কলেজ পার হবার সাথে সাথেই সেটআপটা ধরা পড়ে গেলো। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বর্তমানের চুয়েট) সামনে একটি প্রাইমারি স্কুল; মোড় ঘুরে জিপ সেই স্কুলের সামনে পড়তেই রব দেখলেন পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে কলেজে, তিনি সবাইকে সাবধান করার জন্য চেঁচিয়ে উঠলে ড্রাইভার কড়া ব্রেক কষলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও স্কুলের ছাদে ওঁৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলিবৃষ্টি উপহার দিয়ে তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানালো। ঝাঁক ঝাঁক রাইফেল, মেশিনগানের গুলিবৃষ্টির সামনে উলঙ্গ জিপ। কোনো আড়াল নেই কোথাও। প্রথম গুলিতেই চাকা ফেটে গাড়ি অচল হয়ে যায়। অরক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যুত্তর দেয়ার চেষ্টা করলেন। গুলি নিঃশেষ হয়ে যায়। টপ টপ করে একজন একজন করে পড়ে গেলেন চট্টগ্রামের ভবিষ্যতের অসীম সম্ভাবনাময় দুই নেতা। প্রথমে সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, তারপর চাকসু ভিপি আবদুর রব।
মুসলিম হাই স্কুলে পড়ার সময় তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তখনকার দিনে মুসলিম হাই স্কুলে বৃহস্পতিবার পাঠ্য বিষয়ের বাইরে এক ঘণ্টা অতিরিক্ত ক্লাশ হতো। বিভিন্ন আলোচনা, বিশেষত নিয়মিত বিতর্কের আসর বসতো। সাইফুদ্দিন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে থাকেন।
১৯৬৭ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে সিটি কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বছরেই তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দিবা বিভাগের সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) নির্বাচিত হন। ৬৭ থেকে ৭১-এর ৩০ মার্চ পর্যন্ত সিটি কলেজ ছিলো ছাত্র আন্দোলনের দুর্ভেদ্য দুর্গ। আর এ আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে যারা চট্টগ্রামের রাজপথ প্রকম্পিত করে তুলতেন, সাইফুদ্দিন তাদের অন্যতম। তিনি তুখোড় বক্তা, অপ্রতিদ্বন্দ্বী তার্কিক, অসাধারণ সংগঠক, মেধাবী ছাত্রনেতা, নিষ্পাপ চেহারার নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারি, সদালাপী, বন্ধুবৎসল ছিলেন। সর্বোপরি তিনি এক খাপখোলা তলোয়ারের তুলনাÑসত্যের জন্য, আদর্শের জন্য যিনি প্রয়োজনের সময় ঝলসে উঠতে পারেন। সাইফুদ্দিন খালেদ অর্থও ‘ধর্মের তলোয়ার’। স্ত্রী জাহানারা বেগমের কোল আলো করে যখন প্রথম শিশুপুত্রটি জন্মগ্রহণ করে, তখন জহুর আহমদ চৌধুরী সাধ করে তার নাম রেখেছিলেন সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী। পুত্রটি বড় হয়ে সার্থকনামা হয়েছিলো। অন্যায় দেখলেই এই তরবারি ঝলসে উঠতো। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মুখোমুখি হয়েও এমনি ঝলসে ওঠেছিলেন; বীরের মতো লড়াই করতে করতে প্রাণ বিলিয়ে দিতে এতটুকু বুক কাঁপেনি তাঁর।
সাইফুদ্দিনের বন্ধু কলামিস্ট ইদরিস আলম লিখেছেন সাইফুদ্দিন শরীর থেকে বিন্দু বিন্দু রক্তে দেশমাতৃকার মাটি ভিজিয়ে দিয়ে মাতৃঋণ শোধ করেছিলেন এবং অবশেষে অমৃতের পুত্র হয়ে যান দামপাড়ার পল্টন রোডের সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী।
জহুর আহমদ চৌধুরী এমন একজন রাজনৈতিক নেতা, যিনি পাকিস্তান আন্দোলন করতে আপন ভাইকে হারিয়েছিলেন কলকাতার দাঙ্গায়, তার নাম মাহবুবুল আলম। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির একমাত্র নেতা, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ করতে গিয়ে নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রটিকে কোরবানি দিয়েছিলেন। তিনিই একমাত্র নেতা, যাঁর কাছে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রেরণ করেছিলেন; তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি কলকাতা থেকে বহুদূরে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আগরতলায় অবস্থান করে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ঢাকা, কিশোরগঞ্জ এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিস্তীর্ণ এলাকায় লিবারেশন কাউন্সিল ইস্টার্ন জোন গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; তিনিই একমাত্র নেতা যিনি মুক্ত স্বদেশের মাটিতে প্রথম বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করেন; তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি সর্বপ্রথম ঢাকা রেডিওতে ভাষণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের প্রথম রেডিও চালু করেছিলেন এবং সম্ভবত তিনিই একমাত্র নেতা যিনি কপর্দকশূন্য অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। অথচ তখন তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ মন্ত্রী। সেজন্য জহুর আহমদ চৌধুরীর অনুশোচনা ছিলো না, তিনি পরিপূর্ণ জীবনযাপন করে পরিতৃপ্তি নিয়েই তাঁর প্রভুর কাছে ফিরে যান।