মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের কোন বিরাম ছিলো না। ৭০-এর নির্বাচন থেকে ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনের শেষদিন ২৫ মার্চ পর্যন্ত সকল আন্দোলন-সংগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে। অসহযোগের সময়ে আওয়ামী লীগের নির্দেশেই প্রশাসন পরিচালিত হয়েছে। তারপর ইয়াহিয়া যখন আলোচনার মাঝপথে পঁচিশে মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে চোরের মতো গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলো এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সে রাতে বাংলার জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ট্যাংক, কামান, মেশিনগান নিয়ে, তখন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই ঘোষণা তিনি চট্টগ্রামে শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁর বিশ্বস্ত সহচর জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে পাঠান। জহুর আহমদ চৌধুরী চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সেই ঘোষণাটি সাইক্লোস্টাইল করে সমগ্র চট্টগ্রামে বিলি এবং মাইক দিয়ে সর্বত্র প্রচারের ব্যবস্থা করেন। অয়্যারলেসের মাধ্যমে বিদেশেও পাঠিয়ে দেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার ঘোষণা দ্রুত সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ২৬ মার্চ দুপুরে বহদ্দারহাটে চট্টগ্রাম বেতারের ট্রান্সমিশন সেন্টারে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেন এবং সেখান থেকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অনুরোধে পরদিন মেজর জিয়াউর রহমানও উক্ত বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
স্টেশন রোডের রেস্ট হাউসে ছিল শহর আওয়ামী লীগের অফিস। ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সেখানে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়। জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ আন্দরকিল্লা অফিস ও হাজারী গলি বিনোদা ভবনে কট্রোল রুম খুলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রতিরোধ যুদ্ধের নায়ক ক্যাপ্টেন রফিককে (পরে মেজর) সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা দেয়া হয়। যুদ্ধরত সৈনিকদের অস্ত্র-খাবার ও ঔষধ সরবরাহ করা হয়। সৈনিকদের রসদ সরবরাহ করতে গিয়েই ২৭ মার্চ ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী ও মোছলেমউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানি কমান্ডোদের হাতে গ্রেফতার হন।
২৮ মার্চ রামগড়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয় সাব্রুম থানায় গিয়ে চট্টগ্রাম জেলা ও শহর আওয়ামী লীগের জরুরি সভা করেন এম এ হান্নান, এমএ মান্নান, আতাউর রহমান কায়সার এমএনএ, মির্জা আবু মনসুর ও মোশাররফ হোসেন এমপিএ। সেই সভায় যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। জহুর আহমদ চৌধুরী, এমআর সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ আর হারুন চলে গেলেন আগরতলা, কায়সারও তাদের সঙ্গে ছিলেন। পরে তিনি চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি রাজাখালী তাঁর পৈত্রিক জমিদারির অন্তর্গত খামার বাড়িতে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। শহর থেকে ডবলমুরিং-এর এমপিএ ইসহাক মিয়াও সেখানে গিয়ে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ পরিচালনায় নিয়োজিত হন। বাকি সব এমএনএ, এমপিএ ভারতে গিয়ে মুজিবনগর সরকারের দায়িত্ব পালন করেন। শুধু সীতাকু-ের এমপিএ শামসুল হক ও ফেনীর ওয়াবুদল্লাহ মজুমদার (পটিয়া কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ) বেঈমানি করে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে দালালিতে নিয়োজিত হন। চট্টগ্রামের তিনজন এমপিএ মোশাররফ হোসেন, ডাক্তার এমএ মান্নান ও মির্জা আবু মনসুর সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাদের তিনজনকে ১নং সেক্টরের জোনাল কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতাদের সবচেয়ে বড় অবদান হলো তাঁরা সমগ্র বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ভারতের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগটা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, সেটা বুঝতে হলে মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে বাংলাদেশের অবস্থাটা জানা থাকা দরকার। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বাঙালি জাতিকে নির্মূল করার নির্দেশ দিয়ে চোরের মত চুপিচুপি পালিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ঢাকার ওপর নরক ভেঙে পড়ে; পাকিস্তানি বর্বর হায়েনা বাহিনী স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির অহিংস অসহযোগ আন্দোলনকে সামরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দমন করার জন্য পঁচিশে মার্চ কালরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক নিষ্ঠুর গণহত্যার পরিকল্পনা নিয়ে বাংলার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং জনগণকে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে বাসা থেকে গ্রেফতার করে প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে, পরে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধুর আহবানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু হয়, কিন্তু তা’ ছিলো বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত। চট্টগ্রামে ইপিআর-এর এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল (পরে মেজর, বীর উত্তম) ইসলামের নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনী পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাত ৮টা ৪০ মিনিটে বিদ্রোহ করে; পরে সে রাতেই মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টও বিদ্রোহ করে। দেশের অন্যান্য স্থানেও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বিদ্রোহ করে প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
অন্যদিকে অসহযোগ আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনুসর আলী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে আন্দোলনের বিকাশের ধারায় অনানুষ্ঠানিকভাবে গড়ে ওঠা হাইকমান্ড বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারত সাহায্য করবে, আশ্রয় ও অস্ত্র দেবে, ভারতের সঙ্গে এমন কোনো বন্দোবস্ত ছিলো না। এমনি পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম থেকে একমাত্র আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য তৎপর হয়েছিলেন। এই প্রেক্ষাপটটি মনে রাখলে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সেদিন জাতীয় জীবনের সন্ধিক্ষণে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছিলেন।
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের আগরতলা গমন সম্পর্কে আগরতলার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“২৮ মার্চ ১৯৭১ সাল। এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী, কায়সার আহমেদ (যিনি এখন রাষ্ট্রদূত) (আতাউর রহমান কায়সার-সম্পাদক) এরা প্রথম এসেছিলেন বর্ডার ক্রস করে। ওরা পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে রামগড় দিয়ে সাব্রুম হয়ে উদয়পুর ক্রস করে, বিশালগড় ক্রস করে তারপরে আগরতলায় এসেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। পরে তো তাঁরা বন্ধুতে পরিণত হলেন”।
শচীন সিংহের মাধ্যমে তাঁরা দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেটাই ছিলো ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন নেতা ও জনপ্রতিনিধির প্রথম যোগাযোগ। দিল্লি থেকে উত্তর আসলো বাংলাদেশের কোনো নেতাকে সেখানে যেতে হবে। সিদ্ধান্ত হলো এম আর সিদ্দিকী যাবেন, তাঁর সঙ্গে যাবেন কসবার এডভোকেট সিরাজুল হক, শচীন সিংহ নিজেই নিয়ে গেলেন তাঁদের দিল্লিতে। সেখানে ততদিনে তাজউদ্দীনও এসেছেন। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ এখন ইতিহাস।
আগরতলার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য এ বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“…তারপর ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল থেকে অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক, এখন যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা নিয়ে লড়াই করছেন, কসবা বাড়ি, (বর্তমানে প্রয়াত) উনি নয় মাস আমার বাড়ির উল্টো দিকে এমএলএ হোস্টেলের একটা রুমে ছিলেন। আমিই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। তখন ওনাকে এবং এম আর সিদ্দিকী-এই দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ দিল্লি চলে গেলেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। দিল্লি থেকে ফিরে এসে শচীন বাবু বললেন, দিল্লিতে তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর দেখা হয়েছে। তাজউদ্দিন সাহেব নিজেকে প্রধানমন্ত্রী পরিচয় দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেছেন। এ সময় শচীন্দ্র লাল সিংহও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে ত্রিপুরার অবস্থা, বাংলাদেশের শরণার্থীদের চাপ, এই পরিপ্রেক্ষিতে কি করা যায় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে গ্রীন সিগন্যাল দিলেন। তিনি বলে দিলেন, যাও তুমি সব লোকের ব্যবস্থা করো, আমি সব ব্যবস্থা করছি। এসব কথা তাঁর কাছ থেকেই শোনা”।
এম আর সিদ্দিকী নিজে লিখেছেন :
“With the help of some Hindu friends who knew the border well I managed to cross the border at Sabrum on 30th March along with Mr. Jahur Ahmed Chowdhury, Mr. Ataur Rahman Khan and Mr. Abdullah Al- Haroon. We were received well by the Indian border police, was given food and then taken to Agortala to their chief. ….
I was then taken to the Chief Minister of Tripura, Mr. Sacindra Singha. He is immediately talked to Mrs. Gandhi on phone. After discussion he suggested that I should go to New Delhi for talks. So passage was arranged for us…. After we arrived Delhi I was taken to a house were officers from Home and Foreign Ministry and also Dr. Triguna Sen, ex-Education Minister and others met me. An appointment was made with the Prime Minister for the following. In the evening I was told another leader from Bangladesh has arrived there. To my pleasure and relief I found Mr. Tajuddin accompanied by Barrister Amirul Islam. I talked to them for a while and requested Mr. Tajuddin to meet the Prime Minister so that I could fly back to the front to our forces next morning which I did”.
এ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলার দৈনিক সংবাদ-এর বিশিষ্ট সাংবাদিক বিকচ চৌধুরী এক সাক্ষৎকারে বলেন,
“… শচীন বাবু ২ এপ্রিল চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা মি. সিদ্দিকী (এম আর সিদ্দিকী) এবং কসবার এডভোকেট সিরাজুল হককে নিয়ে ফ্লাই করে চলে গেলেন দিল্লিতে। পরের দিন সকালে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তারা তাজউদ্দীন সাহেবের দেখা পান। তাজউদ্দীন সাহেব পশ্চিম বাংলা হয়ে দিল্লি। সেখানে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বিস্তারিত আলাপ হয় তাদের। ইন্দিরা গান্ধী শচীন্দ্র সিংহকে বলেন, তুমি অফিস খোল, তাদের সর্বতোভাবে সাহায্য কর, আমি তোমাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করব এবং তারপর উনি ফিরে এসে আস্তে আস্তে কর্ণেল চৌলীতে (চৌমুহনী- সম্পাদক) অফিস খুললেন। ১৫ এপ্রিল রিলিফ আসা আরম্ভ হল”।
তাজউদ্দীন দিল্লি যান ২ এপ্রিল এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয় ৩ এপ্রিল। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও হাই কমান্ডের অন্যতম সদস্য তাজউদ্দীন আহমদ যখন উপস্থিত হয়েছেন, তখন এম আর সিদ্দিকী আর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক করেন নি। তিনি তাজউদ্দীনকে অনুরোধ করেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার জন্য।
এম আর সিদ্দিকী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা না করলেও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহ তাঁর দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাতে ফল হয়েছিলো এই, তিনি ত্রিপুরায় বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে অফিস খোলার এবং সব রকম সাহায্য সহযোগিতা প্রদানের জন্য শচীন্দ্র লাল সিংহকে নির্দেশ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বাত্মক সহায়তার নিশ্চয়তা দেন। যার ফলে ত্রিপুরায় শরণার্থী শিবির ও বিভিন্ন স্থানে চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দের অফিস খোলা সম্ভব হয়। ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এই রাজনৈতিক যোগাযোগের ফলেই প্রথম বিদ্রোহী বাঙালি সামরিক অফিসার ও চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধের নায়ক ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (পরে মেজর, বীর উত্তম) ত্রিপুরা থেকে ভারতীয় অস্ত্র শস্ত্রের সরবরাহ পান।
রফিকুল ইসলাম যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কথা বলেছেন, তাঁরাই হচ্ছেন জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ আল হারুন ও আতাউর রহমান খান কায়সার।
শুধু ভারতে প্রথম যোগাযোগ নয়, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যার সংবাদও প্রথম মিডিয়ার কাছে তুলে ধরেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং জাতিসংঘ মহাসচিবকে গণহত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান। তাঁরা আগরতলায় আকাশবাণী ও অমৃতবাজার পত্রিকার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য, যার কথা ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর সহায়তায় তাৎক্ষণিক এক সংবাদ সম্মেলন করে পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার বর্ণনা দেন। এই সংবাদ সম্মেলন ভারত এবং সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব উথান্টের কাছে পাঠানোর জন্য ঝঃড়ঢ় ঃযব মবহড়পরফব শিরোনামে ইংরেজিতে একটি যৌথ বিবৃতি তৈরি করা হয়। এই বিবৃতি তৈরি করেছিলেন আবদুল্লাহ আল হারুন। বিবৃতি তৈরিতে তাকে সহায়তা করেন ভারতীয় সাংবাদিক সুভাষ চক্রবর্তী।
সাংবাদিক হারুন হাবীব, যিনি সে সময় আগরতলা ছিলেন এবং রণাঙ্গনের সংবাদ পরিবেশন করে খ্যাতিমান হন, তিনি লিখেছেন,
“সম্ভবত তারিখটি ছিলো ’৭১ সালের এপ্রিলের ২। খেলার (মেলার-সম্পাদক) মাঠে সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যের টিনের বাড়িটি দেশত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রভাবশালী কর্মীতে ঠাসা। বাড়িটিকে অনিলের না বলে তাঁর সহধর্মিনী সুনন্দা ভট্টাচার্যের সরকারি বাসভবন বলাটাই ঠিক হবে। কারণ বাড়িটি রাজ্য স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা মিসেস ভট্টাচার্যের নামে বরাদ্দ ছিলো। আওয়ামী লীগের ৩৫ জন এম.এন.এ ও এম.পি.এ- সহ বেশ ক’জন ছাত্রলীগ নেতা এবং কিছু বাঙালি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বিশ্ববাসীর কাছে সর্বপ্রথম একটি যৌথ বিবৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো এই সভায়। ঝঃড়ঢ় ঃযব মবহড়পরফব-বন্ধ কর এই গণহত্যা-এই শিরোনামে ইংরেজিতে তৈরি হলো ওই যৌথ বিবৃতির খসড়া। চট্টগ্রামের আবদুল্লাহ আল হারুন যোগ্য ভূমিকা রাখলেন এই বিবৃতি তৈরিতে। তাঁকে সহায়তা করলেন প্রখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক সুভাষ চক্রবর্তী। প্রবীণ জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভা থেকেই বাংলার জনপ্রতিনিধিদের যে যৌথ বিবৃতি প্রচারিত হলো, সেটাই বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্তানি গণহত্যা বন্ধের লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রথম আবেদন। সারা পৃথিবীতে তা প্রচারিত হয়েছিলো”।
জহুর আহমদ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে ১০ এপ্রিল আগরতলায় এমএনএ ও এমপিএদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং সে বৈঠকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এ সরকারই ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে এবং সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য লিবারেশন কাউন্সিল ইস্টার্ন জোন গঠিত হয়। জহুর আহমদ চৌধুরী এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এর থেকে জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলের ধারণা গড়ে ওঠে, যা’ মুজিবনগর সরকার গ্রহণ করে। যুব শিবিরও প্রথম আগরতলায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতাদের দ্বারা গঠিত হয়। পরে এই মডেল সারাদেশে অনুসরণ করা হয়। জহুর আহমদ চৌধুরী ও এমআর সিদ্দিকীর অফিস ছিলো আগরতলায়। জহুর আহমদ চৌধুরীকে প্রধানমন্ত্রী ও এমআর সিদ্দিকীকে প্রাদেশিক গভর্ণরের পদমর্যাদা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
২ মে রামগড়ের পতন হলে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সীমান্ত পার হয়ে হরিণা নামক একটি পাহাড়ি এলাকায় ক্যাম্প তৈরি করেন। সেখানে একদিকে সেনাবাহিনী ও আরেকদিকে ছাত্র-যুবকদের জন্য ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। পরে ১নং সেক্টর হেডকোয়ার্টারও হরিণাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আবদুল্লাহ আল হারুন, মির্জা আবু মনসুর, এসএম ফারুক, বাদশা আলম, এসএম জামাল উদ্দিন, ছাত্রনেতা এসএম ইউসুফ, ছাবের আহমদ আসগরী, আবু মোহাম্মদ হাশেম, স্বপন চৌধুরী, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, এবিএম নিজামুল হক, জালালউদ্দিন আহমদ, আনোয়ারুল আজিম, কাজী মনিরুজ্জামান মন্টু প্রমুখ হরিণা ক্যাম্প স্থাপনে দিনরাত পরিশ্রম করেন। আবদুল্লাহ আল হারুন উদয়পুরে দু’টি যুবশিবির সংগঠিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সীতাকু-ের শিক্ষাবিদ এমএ মামুন, পটিয়ার অধ্যক্ষ নুর মোহাম্মদ, মিরসরাইর নুরুল আবছার মুক্তিযোদ্ধাদের পলিটিক্যাল মোটিভেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সীতাকু-ের ডা. এখলাস উদ্দিন ছিলেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।
সাব্রুমে একটি অভ্যর্থনা শিবির স্থাপন করা হয়, যার প্রধান ছিলেন হাটহাজারীর এমপিএ এমএ ওহাব। সেখানে রাউজানের আওয়ামী লীগ নেতা ডা. জাকেরিয়া চৌধুরী ও হাটহাজারীর আওয়ামী লীগ নেতা ডা. মাহমুদুল হক দেশ থেকে আগত ছাত্র-যুবক ও শরণার্থীদের রিসিভ করতেন এবং তাদের নাম তালিকাভুক্ত করে শরণার্থীদের শরণার্থী শিবিরে এবং ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য হরিণা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিতেন। এপ্রিলের প্রথমদিকে বগাফা নামক স্থানে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়।