নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ নির্বাচনে বাঙালি জাতি ৫৪ সালের পর দ্বিতীয় বার ঐক্যবদ্ধ হতে স্ব-শাসনের পক্ষে রায় প্রদান করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ১৯নং দফা ছিলো নিম্নরূপে :
লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে এবং দেশরক্ষা, পরারাষ্ট্র ও মুদ্রণ ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় (অবশিষ্ট ক্ষমতাসমূহ) পূর্ববঙ্গ সরকারের আনয়ন করা হবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থলবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌবাহিনী হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণ করে পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে।
১২ বছর পর আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচিতে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচির প্রতিফলন ঘটে। বিশেষত ১৯নং দফাটি যা উপরে বর্ণিত হয়েছে, তা আংশিক পরিবর্তন করে ৬ দফা কর্মসূচিতে গৃহীত হয়। আওয়ামী লীগের ৬ দফার জোর দিয়ে বলা হয় যে, মাত্র দুটি বিষয়Ñ দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকবে এবং অন্য সকল বিষয়, যেমন মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর ও রাজস্ব সংগ্রহ থাকবে প্রদেশগুলির এখতিয়ারে। ৬ দফা কর্মসূচি অনুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, এর মধ্যে তিনটি দফা অর্থাৎ ৩, ৪ ও ৫ নং দফা স্থায়ীভাবে বৈষম্য দূর করার জন্য আঞ্চলিক সরকার কর্তৃক অর্থনৈতিক বিষয় প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত। উল্লেখ্য, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী মেনিফেস্টো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ প্রদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একইভাবে ৬ দফা কর্মসূচির মূল দাবিও ছিল পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। ২১ দফা কর্মসূচির মতো ৬ দফা কর্মসূচিও বাঙালি জনগণের প্রাণের দাবি হয়ে দাঁড়ায়, তা এখানকার উদ্যোক্তা শ্রেণীর পূর্ণ সমর্থন লাভ করে এবং পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। শেখ মুজিব ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনকে ৬ দফার উপর গণভোট বলে ঘোষণা করেন এবং নির্বাচনে জয়লাভের পর তিনি ৬ দফা দাবি থেকে একচুল পরিমাণও সরে দাঁড়ান নি, কেননা ৬ দফার প্রশ্নে কোনো আপোসরফা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। অন্য দিকে জেনারেল আইয়ুব খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতৃবর্গ ৬ দফা কর্মসূচির বিরুদ্ধে তীব্র পতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। জেনারেল আইয়ুব ৬ দফা উত্থাপনকারী নেতৃবর্গকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিহ্নিত করেন এবং বলেন যে, এরা বৃহত্তর সার্বভৌম বাংলার প্রশ্ন দেখছে। আইয়ুব খান এ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে, ৬ দফা একটি নিতান্ত অনিষ্টকর অভিসন্ধি এবং এটি দেশের ধ্বংস ডেকে আনবে। পাকিস্তানের এলিট শাসকরা ৬ দফাকে কেবল তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ নয়, দেশের সামাজিক কাঠামোর স্থায়িত্বের প্রতি হুমকি বলে মনে করেছিল, যার উপর তাদের ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা পুরোপুরি নির্ভর করত।
১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে আওয়ামী লীগের ৬ দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত হয়। এ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগের এ বিস্ময়কর বিজয় পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিক, সামরিক জেনারেল এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের হতবাক করে দেয়। এমনকি শেখ মুজিব নিজেও এমন বিপুল বিজয় আশা করেন নি। স্পষ্টতই এ বিজয়ের ফলে আওয়ামী লীগের ভেতরে ও বাইরে ৬ দফা বাস্তবায়নের জন্য প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয়। ইতোমধ্যে মাওলানা ভাসানীও শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করার আহ্বান জানান। ভুট্টো জোর দিয়ে বলেন যে, তাঁর দলের নিকট “দুই বিষয়ভিত্তিক কেন্দ্র” ও “মুদ্রা” নীতি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরও ঘোষণা করেন যে, আওয়ামী লীঘ ৬ দফা সম্পর্কে আপোস করার সুনির্দিষ্ট নিশ্চয়তা না দিলে তাঁর দল জাতীয় পরিষদের ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় অধিবেশনে যোগদান করবে না। ভুট্টো এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের সঙ্গে আপোসমীমাংসা করতে অস্বীকৃতি জানান। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবর্গের এ বিরোধ ও মতানৈক্য জেনারেল ইয়াহিয়াকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি করার অজুহাত যোগালো। এভাবে বাংলাদেশের পক্ষে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে ৬ দফার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণের শেষ আশাটুকু নস্যাৎ হয়ে গেল। যে ৬ দফা আন্দোলন মূলত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল, তা এখন বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করল।
১৯৭০ সালের ২৮ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান খবমধষ ঋৎধসবড়িৎশ ঙৎফবৎ (এলএফও)-আইনি কাঠামোর ঘোষণা দেন।
এলএফও-এর প্রধান দিকগুলো ছিলো :
১. জাতীয় পরিষদ ৩১৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এর মধ্যে ১৩ জন মহিলা থাকবেন।
২. শাসনতন্ত্র গণতান্ত্রিক হবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার থাকবে।
৩. শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য ১২০ দিন সময় দেয়া হবে। ১৯৭০ সালের ১ জুলাই থেকে এক ইউনিট বিলুপ্ত হবে।
৪. ১ জুলাই হতে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকীর কাজ শুরু হবে।
৫. ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ এলএফও জারি হবে। শাসনতন্ত্র হবে ইসলামী শাসনতন্ত্র।
পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে আসন সংখ্যা নিম্নরূপ হবে-
জাতীয় পরিষদ
পূর্ব পাকিস্তান ১৬৯
পুরুষ ১৬২
মহিলা ৭
পশ্চিম পাকিস্তান ১৪৪পাঞ্জাব
পুরুষ ৮২
মহিলা ৩
সিন্ধু পুরুষ ২৭
মহিলা ২
বেলুচিস্তান পুরুষ ৪
মহিলা ১
সীমান্ত প্রদেশ পুরুষ ১৮
মহিলা ১উপজাতি ৭
প্রাদেশিক আসন
পূর্ব পাকিস্তান ৩০০
পশ্চিম পাকিস্তান ৩১৩
নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন করে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ও ১৬ ডিসেম্বর করা হয়। নির্বাচন কমিশন ১৯৭০ সালের ৮ অক্টোবর দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করেÑ
১. পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নৌকা
২. পিডিপি ছাতা
৩. পিপলস পার্টি তরবারি
৪. জামায়াতে ইসলামী দাঁড়িপাল্লা
৫. মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) বাঘ
৬. কনভেনশন মুসলিম লীগ বাইসাইকেল
৭. ন্যাপ (ওয়ালী) কুঁড়েঘর
৮. ন্যাপ (ভাসানী) ধানের শীষ
৯. জমিয়াতে ওলামায়ে ইসলাম খেজুর গাছ
১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেতার-টিভিতে নির্বাচনী ভাষণ দেন। তিনি নির্বাচনে জয়লাভের জন্য নিম্নলিখিত ইশতেহার দেনÑ
১. ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান;
২. বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে হবে;
৩. শাসনতান্ত্রিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে;
৪. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের স্পষ্ট রূপরেখা;
৫. অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর;
৬. দুর্নীতি দমন;
৭. ভূমি সংস্কার-২৫ বিঘা পর্যন্ত ভূমির খাজনা মাফ;
৮. উভয় অঞ্চলে দ্রব্যমূল্যের সমতা। বর্তমানে করাচিতে সোনা প্রতিভরি ১৩৫ টাকা, ঢাকায় ১৫০ টাকা। ঢাকার চাল মণ ৫০ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে ২৫ টাকা;
৯. পাটের ন্যায্যমূল্য প্রদান;
১০. গ্যাসের সদ্ব্যবহার;
১১. যমুনা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার ওপর সেতু নির্মাণ;
১২. জনসংখ্যার ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগ;
১৩. প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন;
১৪. চাষীদের বহুমুখী সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা, ভূমিহীনদের ভূমি বণ্টন;
১৫. ৫ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা প্রদান;
১৬. প্রতি ইউনিয়নে একটি পল্লী চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা;
১৭. উপজাতীয় এলাকায় সর্বাত্মক উন্নয়ন;
১৮. সর্বনাশা ফারাক্কা বাঁধের ফলে যে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সর্বনাশ হবে তা মোকাবেলা করা।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার জনগণের মধ্যে সাড়া জাগায়। তারা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়।
নির্বাচনী প্রক্রিয়া
১৯৭০ সালের ৫ জুন পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ বিষয়ে সরকারের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসন আর জাতীয় পরিষদের জন্য ১৬২ আসন নির্দিষ্ট করা হয়। অধিবেশনে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করা হয়। পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মালেক উকিল, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এম.এ. আজিজ ও গৌরচন্দ্র বালা।
১৯৭০ সালের ৮ জুন রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের বিপুল জনসমাবেশ ঘটে। সমাবেশে একটাই স্লোগান : বাঙালির বাঁচার দাবি ৬ দফা কায়েম করতে হবে। বঙ্গবন্ধু এ জনসভায় সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যত সহজে সবকিছু হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে আসলে এসব তত সহজ নয়। সুতরাং প্রস্তুত থাকতে হবে যে-কোনো পরিস্থিতির জন্য। এ জনসভাতেই তিনি প্রথম ভাষণ শেষে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করেন। এর আগে ১৯৭০ সালের পূর্বে ছাত্রলীগ ‘জয় বাংলা, স্লোগান দেওয়া শুরু করে। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে অনুষ্ঠান করে। তবে ১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর মুখে উচ্চারিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগান জনগণ গ্রহণ করে এবং তা সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে এটা হয়ে যায় নির্বাচনের রণধ্বনি। পরবর্তীকালে এই শব্দজোড় স্বাধীনতার রণধ্বনিতেও পরিণত হয়ে যায়।
১৯৭০ জুলাই মাসে পূর্ব বাংলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেশ কয়েকদিন পরে মাত্র ২০ লাখ টাকা সহায্য মঞ্জুর করেন। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘যেখানে অগণিত বন্যার্তদের দুর্দশা লাঘবের জন্য কোটি কোটি টাকা দরকার, সেখানে এত অল্প টাকায় আমাদের প্রয়োজন মিটতে পারে না।’ এখানেও যে শোষণের চিত্র, বৈষম্যের চিত্র, অবহেলার চিত্র বিদ্যমান তা বুঝিয়ে দিতে বঙ্গবন্ধুকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।
৯ আগস্ট, ১৯৭০ পাকিস্তানি শাসক মহল বন্যার্তদের যথাযথ সাহায্য না করায় প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এ সময় পূর্ব বাংলা সফর করছিলেন। কিছু কায়েমী স্বার্থবাদী দল ও রাজনীতিকগণ বন্যার জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দিতে তাঁকে পরামর্শ দেন। ইয়াহিয়া খানকে উদ্দেশ করে শেখ মুজিব বলেন, বন্যার অজুহাতে তারিখ পিছিয়ে দেশের সাধারণ নির্বাচন বানচালের কোনো চক্রান্ত আওয়ামী লীগ বরদাশত করবে না।
এতদ্সত্ত্বেও ১৯৭০ সালের ১৫ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় ও প্রদেশিক পরিষদ নির্বাচন পিছিয়ে দেন যতাক্রমে ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর। অথচ ২৮ এপ্রিল, ১৯৭০ ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, নির্বাচনের তারিখ অপরিবর্তিত থাকবে।
টঙ্গীর জনসভায় ২০ আগস্ট, ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘নির্বাচন পিছানো আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু ডিসেম্বরের নির্দিষ্ট তারিখে যদি নির্বাচন হতে দেওয়া না হয়, তাহলে সারাদেশে তিনি এক দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তুলবেন’।
বঙ্গবন্ধু ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭০ কুষ্টিয়ায় বলেন, বন্যার দরুন নয়, গণ-দুশমনদের পূর্ব পরিকল্পিত চক্রান্তের জন্যই নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে গেছে। সেদিন উদাত্ত কণ্ঠে বলেন, শোষক ও গণ-দুশমনদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলার জনগণকে সব সময় বৃহত্তর সংগ্রাম ও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
বঙ্গবন্ধু ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭০ নারয়ণগঞ্জে বলেন,… এইবার আমরা ষড়যন্ত্রকারীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, নির্বাচন হোক আর না হোক, আমরা আমাদের দাবি আদায়ের সংগ্রামে আর শহীদ হবো না, গাজী হবো।
ইত্যেমধ্যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য পদের প্রার্থী মনোনয়নের আবেদনপত্র আহ্বান করে। বিপুলসংখ্যক প্রার্থী আবেদন করেন। উভয় আসনের জন্য প্রার্থী মনোনীত করা হয়। বঙ্গবন্ধু পুরাতন ঢাকায় ১টি ও তেজগাঁও টঙ্গীর এলাকায় ১টিÑ এই ২টি জাতীয় পরিষদ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসে ততই সাধারণ মানুষের মধ্যে গণজাগরণ দেখা যেতে থাকে। সে সময়েই স্পষ্ট হয় শেখ মুজিবের কোনো বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগকে ‘নৌকা’ প্রতীক বরাদ্দ করে। ৮ অক্টোবর, ১৯৭০ ইসলামাবাদ থেকে ১৯টি রাজনৈতিক দলের প্রতীক ঘোষণা করা হয়। স্মরণীয় যে, ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল নৌকা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের আবহমান প্রতীক নৌকা।
বেতার ও টেলিভিশনে ২৮ অক্টোবর, ১৯৭০ বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী ভাষণ দেন। তিনি বলেন,… প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেই আওয়ামী লীগের জন্ম। আর সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই আওয়ামী লীগের বিকাশ। এতে বঙ্গবন্ধু অর্থনীতি, সমাজনীতিসহ সকল সম্ভাব্য কর্মসূচি তুলে ধরেন।
একদিকে যখন বেতার ও টেলিভিশনে, অপরদিকে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতা দানের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা এগিয়ে যাচ্ছিল; তখনই ১২ নভেম্বর ১৯৭০ পূর্ব বাংলার ভাগ্যাকাশে নেমে আসে সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসÑযাতে ১০/১২ লাখ মানুষ মারা যায় ও বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হলো। মানব ইতিহাসে এরূপ ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ খুব কমই সংঘটিত হয়। বাংলার সর্বস্তরের মানুষসহ বিশ্ববাসী জানলো পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি ও সম্পদ নষ্টের সময়ে ইয়াহিয়া সরকার উদাসীন ছিল। স্বৈরাচারী সরকার পূর্ব বাংলাকে চিরদিন ‘কলোনি’ করে রেখেছে। তাই তারা আর্ত-মানবতার সেবায় কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
মার্কিন আবহাওয়া দপ্তর ৫ নভেম্বর ঝড়ের পূর্বাভাস জানালে পাকিস্তান সরকার কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান চিন সফর থেকে ফিরে এলে বাংলার জনগণ মনে করলো এই ভয়াবহ দুর্যোগে প্রেসিডেন্ট হয়তো দুর্গতদের পাশে এসে দাঁড়াবেন, কিন্তু হলো উল্টো। তিনি হেলিকপ্টারে ঘুরে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিধ্বস্ত এলাকা সফর শেষে ২৬ নভেম্বর এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। এতে ৭০ জন বিদেশি ও প্রায় দ্বিগুণ দেশি সাংবাদিককে তিনি বলেন, ত্রাণকার্যে ব্যর্থ তার জন্য সরকার দায়ী। তিনি বলেন, বিপর্যয়ের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার ও রিলিফ কাজ করলে অনেক মানুষ বেঁচে যেতো তিনি এটাকে সরকারের ক্ষমাহীন অপরাধ বলে জানান। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে ১০ দিন সময় লাগার সমালোচনা করেন। কেন্দ্রীয় সরকার ও আমলাদের নিষ্ঠুর অবহেলা ও বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য তিনি তাদের দায়ী করেন।
বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার প্রতি শাসকশ্রেণির অবহেলার নির্মম শোষণের চিত্র তুলে ধরেন বিভিন্ন জনসভায়। নির্বাচনী প্রচারের সময় একটি পোস্টারে পাকিস্তানি শাসনের অধীনে বাঙালির দুর্গতি, তাদের শোষণ ও বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। এই পোস্টারটি আওয়ামী লীগের প্রতি জনসমর্থন আরও নিশ্চিত করে। পোস্টারটির শিরোনাম ছিল :
সোনার বাংলা শ্মশান কেন
এই পোস্টারে পূর্ব বাংলাকে শোষণের একটি তথ্যচিত্র দেওয়া হয় যা নিম্নরূপ :
বিষয় পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান
রাজস্ব ব্যয় -১৫০০ কোটি টাকা ৫০০০ কোটি টাকা
উন্নয়ন খরচ -৩০০০ কোটি টাকা ৬০০০ কোটি টাকা
বৈদেশিক সাহায্য -২০% ৮০%
আমদানি -২৫% ৭৫%
কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি -১৫% ৮৫%
সামরিক বাহিনী -১০% ৯০%
চাউল (প্রতি মণ) -৫০ টাকা ২৫ টাকা
আটা (প্রতি মণ) -৩০ টাকা ১৫ টাকা
সরিষার তেল (প্রতি সের) -৫ টাকা ২.৫০ টাকা
সোনা (প্রতি তোলা) -১৭৫ টাকা ১৩৫ টাকা প্রলয়ঙ্করী সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পরও পূর্ব-ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৭০-এর ৭ ও ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করা হয়। শুধুমাত্র দুর্গত এলাকায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনের নির্বাচন ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ৯টি বাদে ১৫৩টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দুটি ব্যতীত সকল আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। দুটির একটি আসনে পিডিপি’র নুরুল আমিন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় অপর আসনে নির্বাচিত হন। ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় পরিষদে নির্বাচনের বিজয়ীদের ফলাফল নিম্নরূপ ছিল-
জাতীয় পরিষদের আসন ৩১৩
পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৬৭
পাকিস্তান পিপলস পার্টি ৮৮
কাইয়ুম মুসলিম লীগ ৯
কাউন্সিল মুসলিম লীগ ৭
কনভেনশন মুসলিম লীগ ২
ন্যাপ (ওয়ালী) ৭
জামায়াতে ইসলাম ১
মারকাজ জমিয়াতুল ইসলাম ৭
হাজারভি গ্র“প-
থানভি গ্র“প ১৪
নির্দলীয় ১৪
মোট- ৩১৩
প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮ আসনে জয় লাভ করে। অবশিষ্ট আসনে পিডিপি ২, নেজামে ইসলাম ১, জামায়াতে ইসলামী ১, ন্যাপ-১, স্বতন্ত্র-৭। স্বতন্ত্র সদস্যগণ আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। আওয়ামী লীগের আসন দাঁড়ায় ২৯৫টি।
ভাসানী ন্যাপ নির্বাচন বর্জন করে। পরোক্ষভাবে মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দেন।
আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদে মোট ভোটের ৭৫.১০% এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৭০.৪৮% ভোট লাভ করে।
শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঘনিষ্ঠজনদের বলতেন, গু ধরস রং ঃড় বংঃধনষরংয ইধহমষধফবংয. ও রিষষ ঃবধৎ ঃযব খঋঙ রহঃড় ঢ়রবপবং ধং ংড়ড়হ ধং ঃযব বষবপঃরড়হং ধৎব ড়াবৎ.
আমার লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। নির্বাচন শেষ হলে আমি এলএফও ছিঁড়ে ফেলব। শেখ মুজিব ধীরগতিতে চলছেন। তিনি আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। এরপরেও নিজে নির্বাচন করেছেন। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবেন না।
নির্বাচিত সদস্যদের শপথ ৩ জানুয়ারি ১৯৭১
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সকল এমএনএ ও এমপিদের শপথ পড়ান। সদস্যরা ৬ দফা বাস্তবায়নের জন্য অঙ্গীকার করেন।
১৯৭০ সালে নির্বাচিত চট্টগ্রামের জাতীয় পরিষদ সদস্যবৃন্দ (এমএনএ)
ভোটগ্রহণ : ৭ ডিসেম্বর ’৭০
আসন নির্বাচিত এমএনএ/দল
এনই-১৫৩, চট্টগ্রাম-১ মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী
(সীতাকুণ্ড-সন্দ্বীপ) (এম আর সিদ্দিকী)
এনই-১৫৪, চট্টগ্রাম-২ এম এ আজিজ (এম এ মজিদ)
(চট্টগ্রাম শহর-চান্দগাঁও ব্যতীত)
এনই-১৫৪৫, চট্টগ্রাম-৩ মো. ইদ্রিস
(চান্দগাঁও-বোয়ালখালী)
এনই-১৫৬, চট্টগ্রাম-৪ সৈয়দ মো. ফজলুল হক, বিএসসি
(মিরসরাই-ফটিকছড়ি)
এনই-১৫৭, চট্টগ্রাম-৫ মোহাম্মদ খালেদ (অধ্যাপক)
(হাটহাজারী-রাউজান)
এনই-১৫৮, চট্টগ্রাম-৬ নুরুল ইসলাম চৌধুরী (অধ্যাপক)
(পটিয়া-চন্দনাইশ আংশিক)
এনই-১৫৯, চট্টগ্রাম-৭ আতাউর রহমান খান (কায়সার)
(আনোয়ারা-বাঁশখালী-কুতুবদিয়া)
এনই-১৬০, চট্টগ্রাম-৮ আবু সালেহ
(সাতকানিয়া-লোহাগাড়া)
এনই-১৬১, চট্টগ্রাম-৯ নুর আহমদ
(কক্সবাজার)
এনই-১৬২, চট্টগ্রাম-১০ মেজর রাজা ত্রিদিব রায়
(পার্বত্য চট্টগ্রাম) স্বতন্ত্র
১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যবৃন্দ (এমপি)
ভোটগ্রহণ ১৭ ডিসেম্বর ’৭০
পি-ই-২৮১, চট্টগ্রাম-১ মোশাররফ হোসেন (ইঞ্জিনিয়ার) আওয়ামী লীগ
(মিরসরাই)
পি-ই-২৮২, চট্টগ্রাম-২ অধ্যাপক শামসুল হক ”
(সীতাকুণ্ড) (মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সহযোগী)
পি-ই-২৮৩, চট্টগ্রাম-৩ মৌলভী ওবায়দুল হক ”
(সন্দ্বীপ)
পি-ই-২৮৪, চট্টগ্রাম-৪ মির্জা আবু মনসুর ”
(ফটিকছড়ি)
পি-ই-২৮৫, চট্টগ্রাম-৫ আবদুল ওহাব (এমএ ওহাব) ”
পি-ই-২৮৬, চট্টগ্রাম-৬ আবদুল্লাহ আল হারুন ”
(রাউজান)
পি-ই-২৮৭, চট্টগ্রাম-৭ মোহাম্মদ ইসহাক (ইসহাক মিয়া) ”
(বর্তমান ডবলমুরিং, পাহাড়তলী, বন্দর)
পি-ই-২৮৮, চট্টগ্রাম-৮ জহুর আহমদ চৌধুরী ”
(কোতোয়ালী, বাকলিয়া, পাঁচলাইশ)
পি-ই-২৮৯, চট্টগ্রাম-৯ ডা. এম এ মান্নান ”
(বোয়ালখালী)
পি-ই-২৯০, চট্টগ্রাম-১০ ডা. আবুল কাশেম (ক্যাপ্টেন) ”
(রাঙ্গুনিয়া)
পি-ই-২৯১, চট্টগ্রাম-১১ সুলতান আহমদ (কুসুমপুরী) ”
পি-ই-২৯২, চট্টগ্রাম-১২ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ”
পি-ই-২৯৩, চট্টগ্রাম-১৩ ডা. বি.এম. ফয়েজুর রহমান ”
(বর্তমান চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া/ আংশিক)
পি-ই-২৯৪, চট্টগ্রাম-১৪ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
(সাতকানিয়া)
পি-ই-২৯৫, চট্টগ্রাম-১৫ আহমদ ছগীর শাহজাদা এমএ নেজামে ইসলাম
(সাতকানিয়া ও বাঁশখালী আংশিক)
পি-ই-২৯৬, চট্টগ্রাম-১৬ জহিরুল ইসলাম (এডভোকেট) আওয়ামী লীগ
(চকরিয়া)
পি-ই-২৯৭, চট্টগ্রাম-১৭ মোস্তাক আহমদ চৌধুরী স্বতন্ত্র
(কক্সবাজার)
পি-ই-২৯৮, চট্টগ্রাম-১৮ ওসমান সরওয়ার আলম চৌং আওয়ামী লীগ
পি-ই-২৯৯, চট্টগ্রাম-১৯ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্বতন্ত্র
পি-ই-৩০০, চট্টগ্রাম-২০ অং শুয়ে প্র“ চৌধুরী স্বতন্ত্র
বিপুল বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমাদের জনগণ এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেছে। তারা এক অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের এ রায় প্রদানের অধিকার অর্জন করেছে।’
রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৩ জানুয়ারি, ১৯৭১ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সকল সংসদ সদস্য ৬-দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন তথা ৬-দফা বাস্তবায়নের শপথ গ্রহণ করেন। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’-পূর্ব বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঊল সুরে রবীন্দ্রনাথের বাণী সম্বলিত গানটি দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হয়। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে স্লোগান দেন -আমার দেশ- তোমার দেশ, বাংলাদেশ-বাংলাদেশ, জাগো- জাগো বাঙালি- জাগো, জয় বাংলা।
তিনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রামের সংকল্প ব্যক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদর্শিতার প্রমাণ ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণের মধ্যে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার কৌশলের প্রয়োজনীয়তার উপর তিনি জোর দিয়েছেন। তাই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সঙ্গীতের পর ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি পরিবেশন করা হয়। যে গান ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘সিগনেচার টিউন’।
ইয়াহিয়া খানের অভিসন্ধি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সচেতন ছিলেন। তিনি ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সে ৬ দফার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার জন্য নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথগ্রহণ অন্ষ্ঠুানে যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, তিনি পরবর্তী সরকারের পরিণতি সম্পর্কে তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তিনি বলেছিলেন নির্বাচনে নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের উদ্দেশ্য ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আঁচ করতে পেরেছিলেন। নির্বাচনের সম্ভাব্য জয়লাভ করলেই দাবি আদায় হয় না, আরও সংগ্রাম করতে হবে, রক্তদানের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু বক্তব্য দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি। বঙ্গবন্ধু ওই দিনের ভাষণে, আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতি বাংলার প্রতিটি ইউনিয়ন ও মহল্লায় দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আগেই।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধু ৩ জানুয়ারি (১৯৭১) রেসকোর্স ময়দানে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র ৬-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে প্রণয়ন করা হবে।
এক সরকারি ঘোষণায় ১৩ ফেব্র“য়ারি বলা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় ৩ মার্চ, ১৯৭১ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেছেন। পিডিপি নেতা নূরুল আমীন ঘোষণাটি অভিনন্দিত করে বলেন, আরও আগে এই ঘোষণা দিলে ভালো হতো। মোজাফফর ন্যাপ ঘোষণাটিকে স্বাগত জানায়। আওয়ামী লীগ কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য প্রকাশ করেনি। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোও নীরব ছিলেন।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ১৫ ফেব্র“য়ারি থেকে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বৈঠকে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ ছাড়াও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কার্যনির্বাহী সদস্যরাও অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে শেখ মুজিব বলেন, গণতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন সবাই মেনে চলে। পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কারণে তা এ যাবৎ হয়নি। তিনি অস্ত্রের মুখেও ছয়দফা থেকে এক চুল নড়বেন না বলে ঘোষণা করেন। ১৬ ফেব্র“য়ারি সংসদীয় দলের বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচন করা হয়। প্রাদেশিক পরিষদের পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি পার্টির সহকারী নেতা নির্বাচিত করা হয়।
স্বাধীনতা আন্দোলনের বীরসন্তান সূর্যসেন। এই অগ্নিপুরুষই সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের বুকে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি যদি আমরা শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন না করি, তাহলে ভবিষ্যৎ বংশধরগণ আমাদের কখনো সম্মান করবে না।… আমাদের কবি, শিল্পী ও সাহিত্যিকগণ এখনো তাঁদের ন্যায্য মর্যাদা পাচ্ছেন না। আমি আশ্বাস দিচ্ছি-যদি আমরা ৬ ও ১১-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন লাভে সক্ষম হই, তাহলে শিল্পী ও সাহিত্যিকরা সবকিছু পাবেন।… ৬-দফা ও ১১-দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের অর্থই হচ্ছে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক স্বাধিকার। জয় বাংলা স্লোগানেরও লক্ষ্য এই সামগ্রিক স্বাধিকার অর্জন। … লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয় নাই। চরম সংগ্রামের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। সেদিনের জন্যে প্রস্তুত হোন। আপনাদের সমস্যা শুধু আপনাদেরই নয়-এ সমস্যা সারা জাতির। শিল্পীদের স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতিই এগিয়ে আসবে।
১. ‘বাংলাদেশ’ নাম : এই নাম তাঁরই দেয়া। তিনি ড. মুহাম্মদ এনামূল হক, আবুল ফজল প্রমুখ খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীকে পূর্ববাংলার একটি নাম ঠিক করার অনুরোধ জানান। তাঁরা ঐতিহাসিক দিক বিচার-বিবেচনা করে কেউ বলেন, ‘বঙ্গদেশ’, কেউ বলেন, ‘বাংলা’, কেউ ‘বঙ্গ’। সেই সঙ্গে তাঁরা বলেন, আদি বঙ্গদেশ বলতে পূর্ব বাংলাকেই বুঝায়। ১৯৬৯-এর ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনায় বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন : ‘শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের পক্ষে থেকে ঘোষণা করছি, আজ থেকে বাঙালি জাতির এই আবাসভূমির নাম হবে ‘বাংলাদেশ’।
২১ দফা
নীতি
কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতির প্রতিকুল কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারনের ব্যবস্থা করা হবে।
১। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে।
২। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হবে এবং উচ্চহারের খাজনা ন্যায়সঙ্গতভাবে হ্রাস করা হবে এবং সার্টিফিকেটযোগে খাজনা আদায়ের প্রথা রহিত করা হবে।
৩। পাট ব্যবসায়কে জাতীয়করণ করার উদ্দেশ্যে তাকে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে আনয়ন করে পাটচাষিদের পাটের মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে এবং লীগ মন্ত্রিসভার আমাদের পাট কেলেঙ্কারির তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাদের অসদুপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
৪। কৃষির উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে ও সরকারি সাহায্যে সকল প্রকার কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করা হবে।
৫। পূর্ববঙ্গকে লবণশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য সমুদ্র-উপকূলে কুটির শিল্পের ও বৃহৎ শিল্পের লবণ তৈরির কারখানা স্থাপন করা হবে এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলে লবণ কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে ও তাদের অসদুপায়ে অর্জিত যাবতীয় অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হবে।
৬। শিল্প ও কারিগরি শ্রেণীর গরিব মোহাজেরদের আশু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
৭। খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করে দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হবে।
৮। পূর্ববঙ্গকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করে ও কৃষিকে আধুনিক যুগোপযোগী করে শিল্প ও খাদ্য দেশকে স্বাবলম্বী করা হবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রমসংঘের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং সব ধরনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হবে।
৯। দেশের সর্বত্র একযোগে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা হবে এবং শিক্ষকদের নায়সঙ্গত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।
১০। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকর করে কেবল মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হবে এবং সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহের বর্তমান ভেদাভেদ উঠিয়ে দিয়ে একই পর্যায়ভুক্ত করে সব বিদ্যালয়সমূহকে সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।
১১। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল কানুন বাতিল ও রহিত করে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে উচ্চ শিক্ষাকে সস্তা ও সহজলভ্য করা হবে এবং অল্প ব্যয়সাপেক্ষ ও সুবিধাজনক ছাত্রাবাসের বন্দোবস্ত করা হবে।
১২। শাসন ব্যয় সর্বাত্মকভাবে হ্রাস করা হবে এবং তদুদ্দেশ্যে উচ্চ বেতনভোগীদের বেতন কমিয়ে ও নিম্ন বেতনভোগীদের বেতন বাড়িয়ে তাদের আয়ের মধ্যে একটি সুসংহত সামঞ্জস্য বিধান করা হবে। যুক্তফ্রন্টের কোনো মন্ত্রী এক হাজার টাকার বেশি বেতন গ্রহণ করবেন না।
১৩। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, ঘুষ-রিশওয়াত বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা করা হবে এবং এতদুদ্দেশ্যে সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি পদাধিকারি ও ব্যবসায়ীর ১৯৪০ সাল হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব নিকাশ নেওয়া হবে এবং সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ দিতে না পারলে তাদের সম্পত্তির বায়েয়াপ্ত করা হবে।
১৪। জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ ও রহিত করে বিনাবিচারে আটক বন্দীদের মুক্তি দেয়া হবে ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হবে এবং সংবাদপত্র ও সভা-সমিতি করার অধিকার অবাধ ও নিরঙ্কুশ করা হবে।
১৫। বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা হবে।
১৬। বর্ধমান হাউজকে আপাতত ছাত্রবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হবে।
১৭। বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যাঁরা মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার গুলিতে শহীদ হয়েছেন তাঁদের পবিত্র স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে এবং তাঁদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
১৮। ২১ ফেব্র“য়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা করে একে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হবে।
১৯। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় (অবশিষ্ট ক্ষমতাসমূহ) পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থলবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণ করে পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে।
২০। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা কোনো অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াবে না। আইন পরিষদের আয়ু শেষ হওয়ার ছয় মাস পূর্বেই মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে নির্বাচন কমিশন মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন।
২১। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার আমলে যখন যে আসন শূন্য হবে, তিন মাসের মধ্যে তা পূরণের জন্য উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে এবং পর পর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।
নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাবলী
আওয়ামী লীগের যুগান্তকারী নির্বাচনী বিজয় শেখ মুজিবকে বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করে। আর আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক বিজয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিচল অভিব্যক্তি হিসেবে গণ্য হয়। বাঙালির জাতীয় পরিচয়ের পুনরুজ্জীবিত ও সংকল্পদৃঢ় প্রেরণা এবং বাঙালি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি সারা বাঙলাদেশকে উদ্দীপ্ত করে। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, “কেউই আমাদেরকে ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নে বাধা দিতে পারবে না।” তিনি এখানে নব নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদেরকে ম্যানিফেস্টো বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকার জন্য শপথনামা পাঠ করেন। এ ব্যাপারে যেকোন সন্দেহ দূর করার জন্য শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে দৃঢ়কণ্ঠে বলেন যে, ছয় দফা আমাদের পবিত্রতম ধ্র“ব লক্ষ্য এবং আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন কার্যক্রমে কোনো দ্ব্যর্থকতা নেই, এবং অতীতের মতো পর্দার অন্তরালে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পশ্চিম পাকিস্তানি স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না অথবা দলত্যাগ করবে না। পরের দিন, ৪ জানুয়ারি শাসকগোষ্ঠীকে উদ্দেশ করে শেখ মুজিব পরিষ্কার ভাষায় বলেন যে, বাঙালিরা নির্বাচনে দ্ব্যর্থহীনভাবে তাদের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছে এবং ছয় দফা পরির্তনের কোনো কর্তৃত্ব জাতীয় পরিষদের থাকবে না।