১৯৬৬ সাল জাফর আহমদের জীবনে একটি টার্নিং পয়েন্ট। সেবছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে প্রথম ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এরপর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি ৬ দফাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। ৬ দফায় শোষিত-বঞ্চিত বাংলার মানুষ তাদের বাঁচার পথ খুঁজে পেয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু ৬ দফায় যে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিলেন, তা থেকে ক্রমান্বয়ে বাঙালি জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়; বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার ভিত্তিতে বাঙালি জাতিসত্তা গড়ে উঠে, যা থেকে স্বাধীনতা অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক ছাত্র-যুবক জাতির বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। জাফর আহমদও এসময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে দীক্ষা নেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন বলিষ্ঠ, নিবেদিতপ্রাণ, ত্যাগী সংগঠক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। সেসময় থেকে ৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলন পর্যন্ত সকল আন্দোলন সংগ্রামের পুরোভাগে দেখা যেত একটি সাহসী মুখ, তিনি জাফর আহমদ।
৬৬ সাল থেকে কিছু কিছু ছাত্রনেতার নাম শহরে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। বাগ্মিতার জন্য আশরাফ খান, ইদরিস আলম ও এসএম ইউসুফ এবং সাহস ও শক্তিমত্তার জন্য গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, সুলতান উল কবির চৌধুরীর নাম, আইয়ুব-মোনায়েম যখন এনএসএফ নামক একটি দৈত্য সৃষ্টি করে ছুরি, চাপাতি, লাঠি, লোহার রড, হকি স্টিক দিয়ে বিরোধী ছাত্র নেতাকর্মীদের মেরে তক্তা বানিয়ে শিক্ষাঙ্গন দখলের পাঁয়তারা শুরু করেছিলেন, তখন প্রথমদিকে গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, অব্যবহিত পরে সুলতান উল কবির চৌধুরী প্রভৃতি অসমসাহসী ছাত্রনেতা এনএসএফ-কে রুখে দাঁড়িয়ে প্রথমত সিটি কলেজে ছাত্রলীগের দুর্গ আটকিয়েছিলেন। ক্রমান্বয়ে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন হাজি কামাল, মো. ইদরিস, জাহাঙ্গীর চৌধুরী, জাফর আহমদ, খালেকুজ্জামানসহ আরো অনেক ছাত্রনেতা।
৬ দফা আন্দোলন সরকারী পেটোয়া বাহিনী ও পুলিশের ব্যাপক বাধার সম্মুখিন হলে সিটি কলেজের উপর্যুক্ত ছাত্রনেতারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন এবং তাঁরা ৬ দফার আন্দোলনকে ছাত্রজনতার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে জাফর আহমদের সাহসিকতার আরেকটি পরিচয় পাওয়া যায়। সিটি কলেজের ছাত্রনেতাদের মধ্যে সুলতান, হাজি কামাল, ইদরিস, জাফর, জাহাঙ্গীর প্রমুখ বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। সুলতান কাদের সিদ্দিকীর ন্যায় ভারতে না গিয়ে তাঁর জন্মস্থান বাঁশখালীতে গিয়ে ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে একটি বিরাট মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেছিলেন এবং কখনো গেরিলা কায়দায়, কখনো সম্মুখ সমরে লিপ্ত হয়ে পাকবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিলেন। হাজি কামাল, জাহাঙ্গীর ও জাফর সি-ইন-সি স্পেশাল ট্রেনিং নেন এবং কামাল হাটহাজারী, জাফর মিরসরাই, জাহাঙ্গীর শহরে গেরিলা গ্রুপের কমান্ডার হয়ে যুদ্ধ করে তাঁদের নাম রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে শুধুমাত্র সাহসী এবং বলিষ্ঠ দৈহিক গঠনের অধিকারী ছাত্রদেরকেই প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর নামে গঠিত বাহিনী ‘সি-ইন-সি স্পেশাল’- ফোর্সের সদস্য করা হয়েছিলো। জাফর আহমদ এই বিবেচনায় উৎরে গিয়েছিলেন এবং যুদ্ধকালে মিরসরাইতে মুক্তিযুদ্ধের সম্মিলিত বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে অমিত বিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন।
জাফর আহমদ মোগল আমলের নিজামপুর পরগণা, যা বর্তমানে মিরসরাই উপজেলা নামে পরিচিতি লাভ করেছে, তারই করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম জোয়ার গ্রামে ১৯৪৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত অলি আহমদ ভূঁইয়া ও মাতা মৃত রহিমুন নেছা।
তিনি ১৯৬৩ সালে জোরালগঞ্জ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৬৫ সালে ফেনী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। তিনি চট্টগ্রাম শহরে চলে এসে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ভর্তি হন। চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে গ্র্যাজুয়েশন করেন। তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নির্বাচনী দল ‘অভিযাত্রিক’-এর মনোনয়ন নিয়ে কলেজ ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। সিটি কলেজকে ছাত্রলীগের দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেন।
স্বাধীনতা-উত্তর তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ও সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশ গ্রহণ করেন। উচ্চতর সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য ভারতে চলে যান এবং সেখানে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি চাকলালা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে সি-ইন-সি স্পেশাল ট্রেনিং সম্পন্ন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মিরেরসরাইতে মুক্তিযুদ্ধের সম্মিলিত বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ (সি-ইন-সি) হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক শাহাদাতের পর শহীদ মৌলভী সৈয়দ, মহিউদ্দিন চৌধুরী, এসএম ইউসুফের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ছাত্র-যুবকরা তুমুল প্রতিবাদে চট্টগ্রাম কাঁপিয়ে তুলেছিলেন। জাফর আহমেদও এই প্রতিরোধ যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বীরযোদ্ধা ছিলেন । পরবর্তীকালে তাঁকে হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। সে সময় কোন লোভ-প্রলোভন তাঁকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
১৯৮১ সালের পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যে অস্থির সময় অতিবাহিত হয়েছে তখনও তিনি আওয়ামী লীগের মূল দলের সাথেই ছিলেন। পরবর্তীকালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ও ৯০ এর সামপ্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনেও তিনি রাজপথে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে ১৫ দলীয় জনসভায় অংশগ্রহণের জন্য আগত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনা আইনজীবীদের আহবানে কোর্ট বিন্ডিং-এ উঠলে চাইলে তাঁকে লক্ষ করে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করেছিলো। পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণে প্রায় ২৪ জন মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। জাফর আহমেদও শেখ হাসিনাকে অনুগমণকারী মিছিলের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীকালে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সাথে নিয়ে জাফর আহমেদ তাদের জন্য একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছিলেন। স্মৃতিফলকটি নির্মাণ করতে গিয়ে তাঁকে বেশ বাদার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। পরে সেটিকে ভেঙে বড় পরিসরে স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়েছে।
জাফর আহমদ চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পরে সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব ও পরে কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।
জাফর আহমদ চট্টগ্রামের রাজনীতি ও ক্রীড়াঙ্গনের অগ্নিকন্যা জাহানারা আঙ্গুরের পাণি গ্রহণ করেন। আঙ্গুরও চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগ ও সিটি কলেজের ছাত্রলীগের একজন খ্যাতিমান নেত্রী ছিলেন। তিনি একজন কৃতী ক্রীড়াবিদ ছিলেন, রাজনৈতিক জীবনে অধিক খ্যাতি অর্জন করায় তাঁর ক্রীড়াঙ্গনের আবদান চাপা পড়ে গেছে। জাফর ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক