২০১২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত মুহাম্মদ নূরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু স্মারকগ্রন্থে আমার লেখায় আমি বলেছিলাম তিনি আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম মানুষ ছিলেন। আমরা মানে, যারা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বংলাদেশের বুকে জাসদ নামক ঝড়ের তান্ডব তুলে আছড়ে পড়েছিলাম, আমি সেই সময় চট্টগ্রামে জাসদের প্রধান নেতা অধ্যাপক নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জুর কথা বলছি ।
তিনিই চট্টগ্রামে জাসদ প্রতিষ্ঠার আসল নায়ক। এটা কারো স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির অপেক্ষা রাখেনা। তিনি উদ্যোগী ভূমিকা না নিলেও চট্টগ্রামে জাসদ হতো। কারণ সেটা ছিলো অনিবার্য সামাজিক বাস্তবতা। কিন্তু নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জুকে পাওয়া না গেলে সে সময় অন্তত চট্টগ্রামে জাসদের গোড়াপত্তন কঠিন হয়ে দাঁড়াত। মঞ্জুর যোগদানে কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিলো। কেননা তিনি এম এ আজিজের পুত্র।
চট্টগ্রামে তখন এম এ আজিজের অপ্রতিহত প্রভাব। তিনি শুধু চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীন, ৬দফা আন্দোলন, মুজিব ফান্ড গঠন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের অন্যতম স্থপতি এবং ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়ার গড়িমসিতে বাতাসে বারুদের গন্ধ পেয়ে একদফা আন্দোলন শুরুর হুঁশিয়ারি দিয়ে এম এ আজিজ রূপকথার নায়কে পরিণত হয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে সফল সৈনাপত্য করে বিপুল বিজয়ের বরমাল্য যখন তাঁর গলায় শোভা পাচ্ছিল, সেই সময় আকস্মিকভাবে একাত্তরের ১১ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন। তার দু’মাস পরে যখন তার এক দফার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলো এবং যখন তার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি, তখন তিনি অনন্তধামে। নয়মাস পরে যখন সত্যি সত্যি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেলে, তখন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের সবচেয়ে বেশি মনে পড়েছে এম এ আজিজের কথাই। মৃত এম এ আজিজ স্বাধীন চট্টগ্রামে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় আনত হয়েছিলো সমগ্র চট্টগ্রাম। নেতার অবর্তমানে তাঁর পরিবারের প্রতি ঝরে পড়েছিলো মমতার নির্ঝর। আওয়ামী লীগে যখন এম এ আজজ পরিবার থেকে তাঁর একজন উত্তরাধিকারি নির্বাচনের প্রত্যাশা করা হচ্ছিলো, ঠিক সেই সময় এম এ আজিজ পরিবার এসে দাঁড়িয়েছিলো বিরোধী রাজনীতির পাশে ।
এমএ আজিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র জাসদে যোগ দিয়েছেন, এটাই ছিলো স্বাধীনতা-উত্তর চট্টগ্রামের রাজনীতির সবচেয়ে বড় চমক। তাঁর যোগদানের ফলে বিপ্লবী রাজনীতিতে দীক্ষিত জাসদের ওপর সরকারি দলকে আক্রমণ শানাতে অনেক হিসেব নিকেশ করতে হয়েছিলো।
শিক্ষকতায় ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে তিনি হতে পারতেন দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ কিংবা নামি শিক্ষা প্রশাসক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও তিনি হেলায় ছুঁড়ে দিলেন অধ্যাপকের তকমা। মুখ ফুটে বললে তাঁর পায়ে গড়াগড়ি খেতো মন্ত্রিত্ব; কেননা তাঁর পিতৃবন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র জীবনের অভিভাবক এবং পিতার অবর্তমানে গোটা পরিবারেরও গার্জেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তখন দেশের কর্ণধার। বঙ্গবন্ধু নিজেই বাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্নেহের হাত; কিন্তু এমন সুযোগও লুফে নিতে তাঁর প্রবৃত্তি হলো না। যদি পার্লামেন্টের মেম্বার হওয়ার সাধ জাগতো, তাহলে সেটাও তাঁর সাধ্যায়ত্ত ছিলো। এমপি তো তিনি সেই তিয়াত্তরেই হয়ে গিয়েছিলেন, আনুষ্ঠানিক ঘোষণাই ছিলো বাকি। সরকারি হস্তক্ষেপ সেই ঘোষণা কোনোদিনই আর আসেনি। কিন্তু তিনি না অধ্যাপক, না উপাচার্য, না সাংসদ, না মন্ত্রী- সেসব কিছুই হলেন না। সহজ সরল সাধারণ স্বাভাবিক জীবনের মাপে কেমন মানিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। এই সাধারণ জীবনের মাঝেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন অসাধারণত্বের মহিমা। বাড়তে চেয়েছিলেন মনে, ধনে নয়।
জাসদ পরিবারকে নিঃসীম শূন্যতায় নিক্ষেপ করে অনন্তের পানে চলে গেছেন তিনি- আমাদের মঞ্জু ডাই, অধ্যাপক নূরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু। তাঁর অকস্মাৎ অকাল অন্তর্ধানে আমরা রিক্ত, নিঃস্ব হয়ে গেলাম । প্রিয় মানুষটির বিয়োগ ব্যথায় আমরা কাঁদছি, ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি অন্তরে, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে। তিনি জন্মেছিলেন সাতচল্লিশে, এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে, বৈরি সময়ের বিপ্রতীপে। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে বধ করবার জন্যই যেন তারই সমসময়ে জন্ম নিয়ে গোকুলে বেড়ে উঠেছিলেন। এই বৈপরিত্যের সমানুপাত একাত্তর পর্যন্ত আমাদের কৌতূহল জাগিয়ে রাখে। অতঃপর গণজাগরণে পাকিস্তান বধে তার নিরাকরণ ।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ অক্টোবর হালিশহর পৈত্রিক নিবাসে মঞ্জু ভাই’র জন্ম। পিতা এম.এ আজিজ। পিতামহ মহব্বত আলী সরকার। তিনি একটি ব্যবসায়িক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন পরিবারকে। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র এমএ আজিজ রাজনীতিতে যোগ দিলে এবং অনুজরাও অগ্রজের অনুবর্তী হলে, হালিশহরের এই পরিবারটি চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক পরিবার হয়ে ওঠে।
যে পরিবেশে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন, হালিশহরের পৈত্রিক বাড়িতে; সেই বাড়িটি ছিলো চট্টগ্রামের রাজনীতির এক তীর্থক্ষেত্র। শুধু চট্টগ্রামের নেতা কর্মী নয়, চট্টগ্রামে আসলে জাতীয় নেতাদেরও গন্তব্য ছিলো এম এ আজিজের বাড়ি। মওলানা ভাসানীর প্রিয় পাত্র ছিলেন, ৫৪ সালে তাঁকে যুক্তফ্রন্ট মনোনয়ন না দিলে মওলানা নিজেই তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। হুজুরের এত ভক্ত ছিলেন যে, তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তিনি আগ্রাবাদ ও হালিশহরের নতুন নাম দিয়েছিলেন ভাসানী নগর। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁর সমবয়সী, রাজনীতির সূত্রে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হন।
তো মওলানা আর বঙ্গবন্ধুকে ছোটবেলা থেকেই তাঁদের হালিশহরের বাড়িতে আসা যাওয়া করতে দেখেছেন মঞ্জু ভাই। পাকিস্তানের নামজাদা রাজনৈতিক নেতাদের ঘরোয়া পরিবেশে অতি কাছ থেকে দেখতে দেখতে, তাঁদের কথোপকথন শুনতে শুনতে মনে মনে হয়ে ওঠেন ক্ষুদে রাজনীতিক। তিনি ব্যক্তি এম এ আজিজের জ্যেষ্ঠ সন্তানই শুধু ছিলেন না, তিনি ছিলেন রাজনীতিক এম এ আজিজের রাজনৈতিক সন্তান, মানসপুত্র। পিতা তাঁর রাজনীতি দেখে যেতে পারেন নি সত্য, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক মন তৈরি করে দিয়েছিলেন।
এম এ আজিজ বেঁচে থাকলে, স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর ভূমিকা কী হতো, তিনি কি ক্ষমতার অংশিদার হতেন, না বিরোধী দলীয় রাজনীতির নেতৃপদ গ্রহণ করতেন, তা নিয়ে এখন অনুমান নির্ভর তর্কবিতর্ক করা যেতে পারে কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। তবে বঙ্গবন্ধু’র সাতই মার্চের ভাষণ কিংবা পঁচিশে মার্চের ঘোষণার বেশ আগে তিনি যেভাবে এক দফা তথা স্বাধীনতা’র উচ্চারণ এবং বক্তৃতা- বিবৃতিতে বারবার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিলেন, তাতে এটাই মনে
হওয়া স্বাভাবিক যে স্বাধীন বাংলাদেশে আশাভঙ্গের পটভূমিকায় জনগণকে ফেলে নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করতেন না। এই দিক থেকে ভেবে দেখলে মঞ্জু ভাইকে তাঁর পিতা এম এ আজিজের যথার্থ রাজনৈতিক উত্তরসূরী বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। স্বাধীনতার পর বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ প্রতিষ্ঠায় তিনি যে সিরাজুল আলম খান, নূরে আলম জিকু, কাজী আরেফ আহমদ, আ.স.ম. আবুদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, মোহাম্মদ শাহজাহান, মার্শাল মণি, হাসানুল হক ইনু, আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক, শরীফ নুরুল আম্বিয়া প্রমুখের সহযাত্রী হয়েছিলেন, এটাই তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে। হঠাৎ করে তিনি মার্কসবাদী হয়ে যান নি, সেজন্যে পিতৃ সান্নিধ্যে আগেই প্রস্তুত হয়ে ছিলো জমি। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শ্রেণী সংগ্রাম একটি ধ্রুব সত্য একথা বুঝতে পেরে মেনহতী মানুষের সারিতে সামিল হয়েছিলেন। যেখানে শ্রেণীশোষণ চলছে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে, সেখানে শোষণ যন্ত্রের অংশ না হয়ে শ্রেণীচ্যুত হওয়ার সাধনায় নিয়োজিত হয়েছিলেন।
৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলন, ৫৮ সালে আইয়ুবের মার্শাল ল, ৬২ সালে ছাত্র আন্দোলন, ৬৪ সালে আবার ছাত্র আন্দোলন ও ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচন- এসব ঘটনার ঘনঘটায় পাকিস্তানের রাজনীতি যখন বারুদে ঠাসা হয়ে ৬৯-এর বিস্ফোরণের জন্য ধূমায়িত হচ্ছিলো, ঠিক সেই সময়টাতে ঢাকায় অবস্থানের কারণে মঞ্জু ভাই ইতিহাসে অন্তর্লীন হয়ে বিসুভিয়াসের আগ্নেয়গিরির অগ্নি উদগীরণের সাক্ষী হতে পেরেছিলেন। সেটা ছিলো বাঙালির চৈতন্যোদয়ের কাল, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় জাগ্রত হবার সময়। আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে জাতির স্বাধিকার চেতনা দানা বাঁধতে থাকে।
এর মধ্যে মঞ্জু ভাই ১৯৫৭ সালে উত্তর হালিশহর চৌধুরী পাড়া মডেল প্রাইমারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণী, ১৯৬৩ সালে কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৫ সালে কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে সে বছরই পড়তে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মঞ্জু ভাই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত হন। কলেজে পড়ার সময় চট্টগ্রাম সিটি ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন
প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট পাননি; তাই কিছুদিন থাকতে হয়েছিলো ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। বত্রিশ নম্বর তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির হৃৎপিন্ড। সেখানে ক্ষণকালের অধিষ্ঠান তাঁর রাজনৈতিক চেতনাকে শাণিত করে তোলে। পরে সিট পেলেন ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)। সেটি এমন এক হল, যেখানে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে বিকাশমান বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির চাঞ্চল্য ও মুখরতা ছিলো সবচেয়ে বেশি। মেধাবী ছাত্র মঞ্জু ভাই’র সংবেদনশীল সচেতন মানসকে তা’ সহজেই নাড়া দিয়ে যায়। রাজনীতির টান রক্তেই ছিলো। এখন অনুকূল হাওয়ায় তা তাঁর অন্তর্গত সত্তায় তীব্র আলোড়ন তুলে প্রকাশের প্রবল তাড়নায় পাখা ঝাপটাতে থাকে। রাজনীতির সাথে একাত্ম হয়ে সভা মিছিলে যোগ দিতে দিতে পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিস্ট হয়ে গেলেন শান্ত, শিষ্ট, ক্লাসের ভালো ছেলেটি। সেদিনই জন্ম হলো রাজনৈতিক নেতা নূরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জুর। ইকবাল হল ছাত্রলীগের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে তিনি ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। পড়াশোনা, রাজনীতি পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চললো। সিরিয়াস মানুষ, যখন যা করেন তখন তা অখন্ড মনোযোগে, একাগ্র অভিনিবেশে, সমস্ত সত্তা দিয়ে এবং অন্তর দিয়ে করেন।
১৯৬৭ সালে ইকবাল হল থেকে মহসিন হলে স্থানান্তরিত হলেন। এই হলে এসে তিনি ছাত্রলীগের অন্যতম নীতি-নির্ধারক ও মুখ্য কর্মকর্তা হয়ে উঠলেন। হল সংসদের নির্বাচন, দলীয় কমিটি গঠন, রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন, আন্দোলন সংগঠিত করা ইত্যাদি যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুরোভাবে অবস্থান নিয়ে ভূমিকা রাখতে থাকলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে। ৬৯ সালে নির্বাচিত হলেন ছাত্রলীগ মহসিন হল শাখার সাধারণ সম্পাদক। ওদিকে পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে থাকলেন সমান তালে। আটষট্টিতে অনার্স ফাইন্যাল পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত ছিলো। রাজনীতির কারণে পরীক্ষার প্রস্তুতিতে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিলেন। রেজাল্ট আশানুরূপ হবে না মনে হওয়ায় এক বছর ড্রপ দিয়ে পরীক্ষা দিলেন উনসত্তরে। এবং প্রত্যাশিত ফল পেলেন। সত্তরে প্রথম শ্রেণী নিয়ে মাস্টার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে এম. কম. পাস করা চাট্টিখানি কথা নয়। মঞ্জু ভাই যে প্রতিভাবান ছিলেন এই রেজাল্ট তারই প্রমাণ বহন করে।
মঞ্জু ভাই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১১ দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে কুতুবদিয়ায় সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন । স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং ১৯৭৩ সালে রাজনীতিতে যোগদানের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান তৎকালিন সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হবার পর তাঁর পিতা এম.এ. আজিজের স্বপ্ন এবং মুক্তিযুদ্ধের আকাংখা বাস্তবায়ন করার প্রত্যয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রতিষ্ঠায় তিনি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাসদের প্রার্থী হিসাবে ডবলমুরিং এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম জাসদের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৮০ সালে একই শাখার সভাপতি এবং ১৯৮৩ সালে জাতীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন ।
১৯৮৩ সালে থেকে সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী গণআন্দোলনে তিনি ১৫ দলের প্রভাবশালী নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সাল থেকে ৫ দলের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা হিসেবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংগ্রামী জনতার আন্দোলন সংগঠিত ও পরিচালিত করতে সার্বক্ষণিকভাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। বিশেষ করে ৮, ৭ ও ৫ দলের ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সফল ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর তিন জোটের ঐতিহাসিক রূপরেখা প্রণয়নে জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যুক্ত হয় মঞ্জু ভাই’র প্রজ্ঞা ও শ্রমনিষ্ঠা ।
ভদ্রলোক রাজনীতিবিদ বলেই অধ্যাপক মঞ্জু নষ্ট সময়ের নষ্ট রাজনীতিতে মিসফিট হয়েছিলেন। ৭৩ সালের নির্বাচনে তাঁকে জয়লাভ করেও জিততে দেয়া হয়নি। অন্য মানুষ হলে যা হতো, তাঁর মধ্যে তেমন কোনো ভয়ংকর, ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি। চল্লিশ বছরে রাজনীতিতে কত ভাঙাগড়ার খেলা হয়েছে। রাতারাতি অনেকের ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়ে, যখন যে পাত্র সে পাত্রের রং ধারণ করে, বোল ও ভোল পাল্টে আদর্শের নামাবলী ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আখের গুছিয়ে নিয়েছেন এমন নজির ভুরিভুরি। মঞ্জু ভাই সুবিধাবাদকে মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন, নীতি ও আদর্শ বিসর্জন দেয়াকে সস্তা বারবনিতার চেয়েও নিকৃষ্ট কাজ বলে মনে করতেন। তাই বিগত চল্লিশ বছরে দেশের অনেক পরিবর্তন হলেও মঞ্জু ভাই কি কথায়, কি আচরণে, কি বেশভুষায় বদলেছেন, তেমন দুর্ণাম তাঁর অতি বড় শত্রুও দিতে পারবে না। এটি কথার কথা বলা। কারণ মঞ্জু ভাই’র কোনো শত্রুই ছিলো না, অজাতশত্রু ছিলেন তিনি।
রাজনীতিতে সততা, আদর্শনিষ্ঠা ও সত্যবাদিতার ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত ছিলেন মঞ্জু ভাই। আদর্শের আগুনে পুড়ে পুড়ে তিনি অঙ্গার হয়েছেন, অবশেষে অভিমানে অকালে পাড়ি দিলেন অজানার পানে। চট্টগ্রামবাসী এখন বুঝতেই পারবেন না কি অমূল্য সম্পদ তারা হারিয়েছেন। এমন অপরিমেয় সম্ভাবনার এমন অনাকাঙ্খিত বিপুল অপচয়ে কার না দুঃখ হয়, বুক চাপড়াতে ইচ্ছা করে। বস্তুত মঞ্জু ভাই’র নেতৃত্বের কোন পরীক্ষাই হলো না, এটাই সবচেয়ে বেশি বুকে বাজে। তিনি রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মূল্যবোধের সর্বনাশা ও সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের যুগে, ঘুণেধরা সমাজে তিনি যে আদর্শের রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন, তা হালে পানি পেল না। হিংসা, হানাহানি, অসহিষ্ণুতা, অসৌজন্য, ভিন্ন মতাদর্শকে গলা টিপে হত্যা করার রাজনীতির বিপরীতে নুরুদ্দিন জাহেদ মঞ্জু ভিন্ন রাজনীতি ও আদর্শকে পরিচ্ছন্ন রাজনীতি ও আদর্শ দিয়ে মোকাবেলা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন ও শক্তিকে যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে পরাজিত করার এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর জীবন সে রাজনীতিরই উপমা ।
গণতন্ত্রের লড়াইয়ে, শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার বৈপ্লবিক নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে তিনি কখনো আপস করেন নি। প্রতিটি সরকার তাঁকে মন্ত্রী ও এমপি বানানোর মত টোপ দিলেও তিনি তা নিঃশঙ্ক চিত্তে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এজন্য বারবার তিনি স্বৈরাচারের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ১৯৭৬ সালে প্রায় তিনি মাস, ১৯৮৩ সালে ১ মাস, ১৯৮৭ সালে নভেম্বর থেকে ৮৮ সালের মে মাস পর্যন্ত দীর্ঘ সময় বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁকে কারাগারে বন্দী জীবন যাপন করতে হয়। আদর্শের ক্ষেত্রে হিমাদ্রির মতো অটল, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, নীতিনিষ্ঠ কঠিন মানুষ ছিলেন মঞ্জু ভাই। শীর্ণদেহে কী আগুন ছাইচাপা দিয়ে রেখেছিলেন, সেটা যাঁরা তাঁর কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন, একমাত্র তাদের পক্ষেই বুঝা সম্ভব ছিলো। পরম পরিতাপের বিষয় ওই শীর্ণ দেহেই একদিন রোগ বাসা বাঁধলো এবং কুরে কুরে খেয়ে আরো জীর্ণ করে ফেললো। বারবার স্ট্রোকে আক্রান্ত শরীর নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে হাল সাল পর্যন্ত জীবনের সংগ্রামী ইনিংস টেনে এনেছিলেন ক্রিকেটামোদী মঞ্জু ভাই। ২৫ অক্টোবর মৃত্যুর কাছে হার মেনে উইকেট ছেড়ে দিলেন। মৃত্যুতে তাঁর জীবন শেষ হয়ে যায়নি; বরং তা আরো প্রসারিত হয়ে তাঁকে মৃত্যুঞ্জয়ী করে তুলেছে।







