আওয়ামী লীগের রাজনীতি, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই লেখা লিখতে লিখতে আমার চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, কলামিস্ট, কবি, তার্কিক ইদরিস আলমের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলতেন রসুলের মক্কা বিজয়ের আগের ও পরের মুসলমানের মধ্যে অনেক তফাৎ। মক্কা বিজয়ের আগে যাঁরা রসুলের কথায় ঈমান এনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিলেন, তাঁরা সাচ্চা মুসলমান। তখন পরিস্থিতি এত প্রতিকূল ছিলো যে, কাফেরদের অত্যাচারে রসুলকে হিজরত করে মদিনা চলে যেতে হয়েছিলো। অনেক যুদ্ধে কাফেরদের পরাজিত করে রসুল যখন চূড়ান্ত আঘাত হেনে বিজয়ীর বেশে বীরদর্পে মক্কা প্রবেশ করলেন তখন ইসলামের জয়জয়কার। তখন অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে এগিয়ে আসলো। এদের ইসলাম ধর্ম কবুল করার মধ্যে যেটা ফাঁকি সেটা হচ্ছে এরা ইসলামের বিজয়কালের মুসলমান। অনুকূল পরিবেশে মুসলমান শিবির যোগ দিয়েছিলো। আওয়ামী লীগে যারা ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর, স্বাধীনতার পর ৭২-এ এবং ৯৬ ও ২০০৮-এর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ভরা জোয়ারের সময় দলে যোগ দিয়েছিলো, তাদেরকে মক্কা বিজয়ের পরের মুসলমাদের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। পঞ্চাশের দশককে ৪৯-এ জন্ম নেয়া আওয়ামী লীগের শৈশব-কৈশোরকাল বলা যেতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় যাঁরা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অভিযাত্রায় আস্থা জ্ঞাপন করে দলের সদস্য হয়েছিলেন, তাঁদের ক্ষেত্রে মক্কা বিজয়ের পূর্বের মুসলমানের উদাহরণ প্রযোজ্য হতে পারে। ৫৮ থেকে ৬১ পর্যন্ত আইয়ুবের সামরিক শাসনকাল। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ অফিসের সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেলে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিলো। গ্রেফতার ছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতাদের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। সেই দুর্দিনে যাঁরা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন, তাঁরাই প্রকৃত আওয়ামী লিগার। আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত অনুসারী। ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দেয়ার পর আওয়ামী লীগের ওপর চরম বিপদ নেমে এসেছিলো। সেই সময় যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ওপর ঈমান এনে বা বিশ্বাস স্থাপন করে আওয়ামী লীগ করেছেন এবং ৬ দফাকে জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাঠে ময়দানে সভা, রাজপথে মিছিল করে স্লোগানে গলা ফাটিয়ে ৬ দফার প্রচার চালিয়েছিলেন, তাঁরাই আওয়ামী লীগের সত্যিকার নেতা, কমী। অর্থা মক্কা বিজয়ের আগের মুসলমানের সঙ্গে তুলনীয়। সেইসব সোনার মানুষদের কিছুু নাম এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ঢাকায় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচ এম কামরুজ্জামান; মিজানুর রহমান চৌধুরী, আমেনা বেগম, সিএমপি রুহুল কুদ্দুস, আহমেদ ফজলুর রহমান ও ড. জনসন-খ্যাত শামসুর রহমান খান, নারায়ণগঞ্জে খান সাহেব ওসমান আলীর পরিবারের শামসুজোহা, মোস্তফা সরোয়ার ছাড়াও খসরু, পুরান ঢাকার নিজাম, ফজলুর রহমান ফান্টোমাস, হাফেজ মুসা, জিজি অর্থাৎ গাজী গোলাম মোস্তফা, আলী হোসেন, গাজীপুরের শামসুল হক সাহেব (যিনি পরে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন) অবিভক্ত কমলাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়েজউদ্দিন সাহেব। (মেহের আফরোজ চুমকির পিতা), বিশিষ্ট সাংবাদিক বাহাউদ্দিন চৌধুরী ও আবদুল গাফফার চৌধুরী, কেরানীগঞ্জের হামিদ সাহেব (নসরুল হামিদ বিপুর পিতা), পোস্টার নুরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন (চলচ্চিত্র প্রযোজক), আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ফজলুল রহমান, বলিয়াদীর জমিদার পরিবারের আরহাম সিদ্দিকী, কাবাডি এসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী আনিস, অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র হানিফের ভাই সুলতান, হাজিগঞ্জের বাদশা। বাহাউদ্দিন চৌধুরী শুধু সাংবাদিক ছিলেন না, তিনি একজন পলিটিক্যাল একটিভিস্ট ছিলেন। তিনি এক সময় ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই তো আওয়ামী লীগ। ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া, বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন, প্রথিতযশা সাংবাদিক, কলামিস্ট, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি”র গানের রচয়িতা, কবি আবদুল গাফফার চৌধুরী, কে জি মুস্তাফা, এবিএম মুসা, এম আর আখতার মুকুল ছিলেন আওয়ামী লীগের শক্তি ও সাহসের উৎস।
৬ দফার জন্য ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া এবং বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে কপের বৈঠকে ৬ দফার দেওয়ার পর সে সংবাদ প্রথম ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয় ১১ ফেব্রুয়ারি। আর ৬ দফার পক্ষে ইত্তেফাকের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি মঈনুল আলমকে দিয়ে চট্টগ্রামের ৫জন রাজনৈতিক নেতার একটি বিবৃতি আনিয়ে সেটি ইত্তেফাকে প্রকাশ করেছিলেন সিরাজুদ্দিন হোসেন সাহেব।
আলী হোসেন আওয়ামী লীগের একেবারে প্রথম দিকের কর্মী। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে বঙ্গবন্ধু তাঁকে রিক্রুট করেছিলেন। ধানমণ্ডী শঙ্করের দিকে কোথাও থাকতেন তিনি। পরে ইস্কাটনে চলে আসেন। প্রায় আশি-উত্তীর্ণ বয়সে তিনি প্রয়াত হন। মৃত্যুর বছর দু’তিন আগে তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম, তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম ঢাকায় প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের অবস্থা কেমন ছিলো। তিনি তখন এ কথাগুলো বলেছিলেনÑ“ঢাকায় আওয়ামী লীগের প্রথম দিকের কর্মী আমরা- মানে আমি, গাজী গোলাম মোস্তফা, সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ভাই সুলতান, নিজাম, খসরু, নোয়াখালীর শফি (চট্টগ্রামের আশরাফ খানের মামা শ্বশুর), নাসের উল্লাহ, আনোয়ার চৌধুরী। মহল্লা সর্দার কমিটির সভাপতি হাফিজ মুসা ছিলেন ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি। হাফিজ মুসাকে সবাই নানা বলে সম্বোধন করতো।
আওয়ামী লীগ তখনো ছোট দল। হাতে গোনা নেতা-কর্মী, সেই হাতেগোনা মানুষের মধ্যে আরো ছিলেন শামসুল হক, ময়েজউদ্দিন, আরহাম সিদ্দিকী প্রমুখ। চট্টগ্রাম থেকে মাণিকদা কিভাবে যেন এঁদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে যান। মাঝে মাঝে তিনি ঢাকা আসতেন। পরিবাগে নবাব আসকারির বাড়ির পাশে একটি হোটেলে থাকতেন। কখনো বা হোটেলে বসতেন, আড্ডা জমাতেন আমাদেরকে নিয়ে। তাঁর আরেকটা প্রিয় অভ্যাস ছিলো আমাদেরকে নিয়ে রমনা পার্কে বসা। ঢাকা তখন এতো বড় শহর হয়নি, মহানগর তো নয়ই। সেই ছোট শহরের কোলে মনোরম বিকেলে মাণিকদার পিছু নিয়ে আমরা ক’জন আওয়ামী লীগ কর্মী প্রকৃতির নির্জনতায় চুপটি করে এসে পাটি কাঁথা বিছিয়ে বসতাম রমনা লেকের পাড়ে। সূর্য তখন হেলে পড়েছে পশ্চিম পাটে, সবুজ নিঃসর্গের ছায়া পড়েছে লেকে। সেই মন উদাস করা প্রকৃতির রাজ্যে আমরা কাঁচা হলুদের মতো গাত্রবর্ণের এক চট্টল সন্তানের তাম্বুল রসে রাঙা মুখ নিঃসৃত গল্পে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে কান পেতে আছি। গল্পের ফাঁকে এসে পড়তো রাজনীতি। এমনি করে প্রথম যুগে অনেক নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালের মধ্যে নানা কৌশলে আওয়ামী লীগকে গড়ে তুলতে হয়েছে। সিনেমার রিহার্সালের নামেও আমরা রাজনৈতিক বৈঠক করে ফেলতাম।
রমনা পার্কের সেই বৈকালিক আড্ডায় ময়েজউদ্দিন সাহেব, গাজী গোলাম মোস্তফা, বিধান সেন, খসরু, নিজাম ও আমি ছিলাম নিয়মিত আড্ডারু। কাজী আনিসুজ্জামান আসতেন কখনো সখনো।”
যখন খুব লোকই আওয়ামী লীগ করতেন, তখন উপরে উল্লেখিত নেতারা আওয়ামী লীগের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিয়েছিলেন এবং পুলিশ ও সরকারের পেটোয়া বাহিনীর আক্রমণ, নির্যাতন এবং অসচেতন মানুষের কটূক্তি, তিরস্কার হাসিমুখে মাথা পেতে নিয়ে নির্ভীক চিত্তে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়েছিলন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে তাঁদেরকে সপরিবারে সম্মান জানানো বর্তমান দলীয় নেতৃবৃন্দের দায়িত্ব বলে মনে করি। তাঁদেরকে ক্রেস্ট, সম্মাননা, মাল্যভূষিত করে ঢাকঢোল পিটিয়ে রাজপথে শোভাযাত্রা করা দরকার। এমনকি নগদ অর্থও দেয়া যেতে পারে।
পঁচাত্তরে আওয়ামী লীগ সীমাহীন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে কিছু গ্রেফতার হন, অন্যেরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এই সময় অন্ধকারের শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে; রাজাকার, আলবদর, আল শামস, শান্তি কমিটি, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলমী গর্ত থেকে বের হয়ে এসে আস্ফালন শুরু করে। আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা সুযোগ সন্ধানীরা সুযোগ বুঝে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের সাথে হাত মেলায়। এদের দেখেই ইদরিস আলম বলেছিলন ‘মক্কা বিজয়ের পরের মুসলমান’।