বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫, ৭ কার্তিক, ১৪৩২, ৩০ রবিউস সানি, ১৪৪৭

আগরতলা মামলার আসামী মানিক চৌধুরী ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্য নায়ক

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

ভূপতিভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরীর কথা উঠলেই মনে পড়ে তিনি আগরতলা মামলার আসামী ছিলেন। কিন্তু তাতে একথাটা চাপা পড়ে যায়, যে মানিক চৌধুরী স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্য নায়ক ছিলেন। কারণ আগরতলা মামলাই যে স্বাধীনতা সংগ্রামকে দৃষ্টিগোচর এবং নিকটবর্তী করে তুলেছিলো সে কথা আমরা ক’জনই বা মনে রাখি। আগরতলা মামলা না হলে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান হতো না; গণঅভ্যুত্থান না হলে আইয়ুবের পতন ঘটতো না। আইয়ুবের পতন না হলে ৭০-এ নির্বাচন হতো না। নির্বাচন না হলে ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন হতো না। অসহযোগ আন্দোলন না হলে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হয়তো ২৫ মার্চ গণহত্যা চালাতো না এবং তা’ না হলে বঙ্গবন্ধু তখন স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা না করলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না এবং মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হতো না।
মানিক চৌধুরী সম্পর্কে আমি বহুদিন ধরে লিখে আসছি। প্রতি বছর মানিক চৌধুরীর মৃত্যুবাষিকীতে আমি কিছু না কিছু লেখার চেষ্টা করি। আমার লেখার মধ্যে যে কথাটা আমি বলার চেষ্টা করি সেটা হলো স্বাধীনতা সংগ্রামে মানিক চৌধুরীর প্রকৃত অবদান আজো আমরা নির্ণয় করতে পারিনি। মানিক চৌধুরী নিজেও এর জন্য কম দায়ী নন। যদিও তিনি বামপন্থী রাজনীতিক ছিলেন না, তথাপি বামপন্থী কমিউনিস্টদের মতো আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতিও তিনি করতেন। তিনি র‌্যাডিক্যাল ছিলেন। কেন না বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে তিনি রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি কার কাছে স্বাধীনতার মন্ত্রগুপ্তি নিয়েছিলেন অনেক অনুসন্ধান করেও আমি তার হদিস বের করতে পারিনি। আমরা শুধু এটুকু জানি বঙ্গবসী কলেজে পড়ার সময় তিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রতিষ্ঠিত দল ফরওয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিলো এবং ফ ব’র সংগঠন তিনি করতেন। মানিক চৌধুরীর চরিত্রে যে বিপ্লবী উপাদানের সমাবেশ দেখা যায় তার উৎস হয়তো এই ফ ব-ই। এখন আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি কেন মানিক চৌধুরী র‌্যাডিক্যাল হয়ে উঠেছিলেন।
জমিদার নন্দন মানিক চৌধুরী নাদুস নুসুস শরীরের সুন্দর চেহারার একজন আকর্ষণীয় পুরুষ ছিলেন। জন্মাবধি প্রাচুর্য্যরে মধ্যে লালিত মানিক চৌধুরীর গৌরকান্তি দেহাবয়ব থেকে ঐশ্বর্যের দীপ্তি ফুটে বের হত। কিন্তু এই আপাত দেহাভ্যন্তরেই যে স্বদেশপ্রেমের একটি আগ্নেয়গিরি প্রজ্জ্বলন্ত ছিলো, সেকথা আমাকে বলেছিলেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেছিলেন মানিক চৌধুরী ছিলেন ্আগুনের মতো নেতা। পূর্ব পাকিস্তানের প্রকাশ্য রাজনীতির তলে তলে মানিক চৌধুরী স্বাধীনতার আগুন উস্কে দিচ্ছিলেন। সেটা অনেক পরে সরকার টের পায়। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে তাঁকে মামলায় ৩নং আসামী করা হয়েছিলো। লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ১নং, বঙ্গবন্ধু ২ এবং মানিক চৌধুরী ৩নং আসামী। পরে বঙ্গবন্ধুকে ১নং এবং কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে ২নং আসামী করে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ নামে নতুন মামলা দায়ের করা হয়। এবার মানিক চৌধুরী হলেন ১২নং আসামী। মানিক চৌধুরী বেআব্রু হয়ে পড়লেন, তাঁর আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি ওপেন হয়ে গেল। সেই রাজনীতি ছিলো স্বাধীনতার রাজনীতি।
সেই প্রথম সারাদেশের মানুষ মানিক চৌধুরীর কথা জানতে পেরেছিলো। তাঁর জন্মস্থান চট্টগ্রামে তিনি মোটামুটি পরিচিত ছিলেন। অন্তত আওয়ামী লীগ পরিম-লে তাঁর নাম অজানা ছিলো না। আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম জেলা কমিটিতে তাঁর একটা পদও ছিলো। শহীদ শেখ মোজাফফর ও এমএ আজিকের কমিটিতে তিনি কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। ব্যবসায়ী মহলে তিনি বেশি পরিচিতি ছিলেন। খাতুনগঞ্জে পোস্ট অফিস গলির মুখে রামজয় মহাজন লেনে তাঁদের পরিবারের একটি ব্যবসায়িক গদি ছিলো। পারিবারিক সূত্রে ব্যবসায়ী পরিচয়টা তাঁর গায়ে ছাপমারা থাকলেও ব্যবসা তিনি তেমন করতেন না, রাজনীতি নিয়েই মেতে থাকতেন।
মানিক চৌধুরী চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের দুই প্রধান নেতা এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে রাজনীতি করতেন। তবে এম এ আজিজের সঙ্গেই তাঁর চিন্তার নৈকট্য ছিলো বেশি। এম এ আজিজও তাঁর মতো স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত ‘এক দফা’-র কথা স্মরণ করা যেতে পারে।
তবে মানিক চৌধুরীর রাজনীতি চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ ছিলো না। নানা ঘটনার অভিঘাতে মানিক চৌধুরীর চিন্তাজগত প্রসারিত হচ্ছিলো। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তির উপায় খুঁজতে খুঁজতে তিনি স্বাধীনতার প্রান্তরে উপনীত হয়েছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুকে পেলেন সহযাত্রী হিসেবে। বঙ্গবন্ধু ভবিষ্যতে যে কঠিন সংগ্রামের ছক তৈরি করেছিলেন, সেখানে মানিক চৌধুরীকে তাঁর যাত্রাপথের সঙ্গী হিসেবে পেয়ে তাঁকে ¯েœহের উষ্ণ বন্ধনে জড়িয়ে নিলেন।
পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় আওয়ামী লীগ তেমন বড় কোন দল ছিলো না। এই সময় যাদের ত্যাগ, নিষ্ঠা ও শ্রমে আওয়ামী লীগ ঢাকার বুকে শক্ত ঘাঁটি খুঁজে পেয়েছিলো, তাদের মধ্যে এই দলের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, টাঙ্গাইলের শামসুল হক, ইয়ার মোহাম্মদ খান, মহল্লা সর্দার হাফেজ মুসার ছাড়াও যাদের নাম উল্লেখের দাবি রাখে তাঁরা হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, সাবেক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত শামসুল হক, গাজী গোলাম মোস্তফা, কমলাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, স্বাধীনতার পর রেডক্রসের ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিবার পরিকল্পনা সমিতির সেক্রেটারি জেনারেল ময়েজউদ্দিন আহমদ, প্রবীণ সাংবাদিক বাহাউদ্দিন চৌধুরী, ঢাকার সাবেক মেয়র হানিফের ভাই সুলতান, খসরু, নিজাম, ফ্যান্টোমাস, আলী হোসেন প্রমুখ। শামসুল হক ও ময়েজউদ্দিন যথাক্রমে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বাহাউদ্দিন চৌধুরী ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন সম্ভবত হাফেজ মুসার পরে বা আগেও হতে পারেন, আমার সঠিক জানা নেই। মাণিক চৌধুরী এই সময় চট্টগ্রামের এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রসারে ও সাংগঠনিক বিস্তারে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ঢাকার পূর্বোক্ত নেতাদের সাথে সাংগঠনিক কাজকর্মে নিজেকে নিবেদিত করতেন। ঢাকায় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্নের যেসব নেতার নাম উল্লেখ করা হলো, তাঁরা পরে সবাই মাণিক চৌধুরীর বন্ধু হয়ে যান। বিশেষ করে শামসুল হক, গাজী গোলাম মোস্তফা, ময়েজউদ্দিনের সাথে তাঁর গাঢ় বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। তাজউদ্দিনের সাথেও তাঁর শ্রদ্ধাপূর্ণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এই জাতীয় নেতা কারাগারে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অটুট ছিলো। আরো দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি বলিয়াদির জমিদার পরিবারের সন্তান আরহাম সিদ্দিকী ও কাবাডি ফেডারেশনের কাজি আনিস মাণিক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এরাই আবার বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় মাণিক চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর কত কাছের মানুষ ছিলেন। চট্টগ্রামে অবস্থান ও রাজনীতি করলেও তিনি কেন্দ্রের হার্ডকোর নেতাই ছিলেন। কার্যত তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। কিন্তু এই পদটি দিয়ে তাঁর নেতৃত্বের পরিমাপ করা যাবে না। পদ নয়, ক্ষমতা নয়, আদর্শই ছিলো তাঁর আরাধ্য। ক্ষমতালোভী, আত্মপ্রতিষ্ঠাকামী প্রচারমুখী নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন আদর্শবাদী রাজনীতিক। বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর এই চিন্তার ঐক্যই মাণিক চৌধুরীকে তাঁর অনুরাগী ও অনুগামী করে তোলে। তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের নেতা এম এ আজিজ ও সিটি আওয়ামী লীগের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী উভয়ের বিশ্বাসের পাত্র ও সেতুবন্ধ ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু, এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী ও মাণিক চৌধুরীকে নিয়ে একটি চতুর্ভুজ সত্য ঘটনাই ছিলো।
স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার আরম্ভ ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের মার্শাল ল থেকে। সে সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তিনি স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোতে বাঙালির মুক্তি সম্ভব নয়। সেজন্য বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং এক্ষেত্রে প্রতিবেশি রাষ্ট্্র ভারতই একমাত্র সহায়ক শক্তি হতে পারে।
ভারতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন মানিক চৌধুরী। ঢাকায় ইত্তেফাক অফিসের পাশে ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যে যোগাযোগ রাখতেন, তারও উৎস মানিক চৌধুরী। কারণ মানিক চৌধুরী ভারতের আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিলেন এবং ভারত সরকার ও ‘র’Ñএর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো মানিক চৌধুরীরই। ভারতীয় হাই কমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি পিএন ওঝা, যাঁকে আগরতলা মামলা দায়ের করার সময় বহিষ্কার করা হয়েছিলো, মানিক চৌধুরীর মধ্যস্থতায় তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ হয়। পিএন ওঝার মাধ্যমে অস্ত্রশস্ত্র আনার চেষ্টা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু ৬২ সালে আগরতলা গিয়েছিলেন মানিক চৌধুরীর মাধ্যমে। আগরতলার মাধ্যমে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলেন মাণিক চৌধুরী। সেজন্য গ্রেফতারের পর তাঁর ওপরই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন চালানো হয়েছিলো। মানিক চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র দীপংকর চৌধুরী কাজলসহ নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে আমার দিল্লি সফরকালে চিত্তরঞ্জন পার্কে অবসর জীবন যাপনকারী একাত্তরে সাউথ ব্লকের বাংলাদেশ ডেস্কে কর্মরত একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছেন, পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য আরো একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। সেবারও মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মাণিক চৌধুরী। তাঁর কাছ থেকেই জানা গেল, মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সহায়তার পেছনে বড়ো ভূমিকা রেখেছেন মাণিক চৌধুরী।
আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত মাহফুজুল বারী জানিয়েছেন, ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই চট্টগ্রামের মানিক চৌধুরী এবং বরিশালের চিত্তরঞ্জন সুতারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ভারতে অবস্থান নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক কাজ করবার। সে সময় দক্ষিণ কলকাতায় একটি বাড়িও ভাড়া করা হয়েছিলো দাপ্তরিক কাজের জন্য।
মানিক চৌধুরীর জীবনের আরেকটি অজানা কাহিনী হলো তাজউদ্দিন সাহেব ও তিনি যখন পঁচাত্তরের পনের আগস্টের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দুঃসহ বন্দিজীবন অতিবাহিত করছিলেন, তখন ম্যাডাম গান্ধীর উদ্দেশ্যে তাজউদ্দিন সাহেব জেলখানা থেকে মানিক চৌধুরীর কাছে একটি চিরকুট পাঠিয়েছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশ্যে লেখা ঐ চিঠিতে তাজউদ্দিন পঁচাত্তরের গোলযোগপূর্ণ ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে ভারতের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন।
কিন্তু জেলখানার কোনো সিপাইর মাধ্যম পাঠানো সেই চিঠি মানিক চৌধুরীর কাছে পৌঁছেনি। তবুও মানিক চৌধুরী ও শামসুল হক দিল্লিতে গিয়ে ম্যাডাম গান্ধীর সাথে দেখা করার জন্য ভারতে গিয়েছিলেন। কিন্তু যেদিন তাদের যাওয়ার কথা তার আগে রাতে মানিক চৌধুরী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁরা দিল্লি যেতে পারলে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তো অন্যখাতে প্রবাহিত হতো।
মানিক চরিত্রের আর যেসব গুণ দাগ কাটে, সেগুলি হলো তিনি ছিলেন একজন দিলখোলা, স্পষ্টভাষী মানুষ। আড্ডাবাজ, খোশ মেজাজের আমুদে লোক। অমিতব্যয়ী, বেহিসেবী, পটিয়ার একটি জমিদার ও খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়িক পরিবারের সান হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালোই বুঝতেন। কিন্তু যা উপার্জন করতেন, তা দুই হাতে বিলিয়ো দিতেন দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে। সঞ্চয়োর কোনো মনোবৃত্তি ছিলো ১০ না। সেজন্য তাঁর মৃত্যুর পরে দেখা গেলো স্ত্রী, পুত্র-কন্যার ভরণপোষণের জন্যও কিছু রেখে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি তিনি। দলের ব্যয় নির্বাহের জন্য আয় করতে হবে এটাই ছিলো তাঁর নীতি । পাকিস্তানি জামানায় চট্টগ্রাম জেলা ও সিটি আওয়ামী লীগ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ, এমনকি বঙ্গবন্ধুরও যখনই টাকা পয়সার প্রয়োজন হয়োছে, পাশে গিয়ো দাঁড়িয়েছিলো মাণিক চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়ার আকদ্ অনুষ্ঠানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন মাণিক চৌধুরী। আমি যে এসব কথা লিখছি, মাণিক চৌধুরী শুনলে লজ্জিত হতেন। কারণ তিনি দান করে দানের কথা কাউকে বলতেন না।
দল চালানোর জন্যই ষাটের দশকে তাদের খাতুনগঞ্জের গদিতে ‘নতুন এজেন্সি’ নামে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চালু করেন। বঙ্গবন্ধুও নাকি সেই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার ছিলেন। তারা একটি স্টিল মিলও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়োছিলেন। এখন বুঝতে পারছি আগরতলার ঘটনার প্রাক-প্রস্তুতি ছিলো এই ‘নতুন এজেন্সি’।
সাম্প্রদায়িক পরিবেশে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক মানুষ। হিন্দু -মুসলমান ভেদাভেদ ছিলো না তাঁর কাছে । এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁর চরিত্রে দুটি ছাপ ফেলেছিলো ।
এক, তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী হলেন এবং বাংলাদেশ কায়োমের জন্য নিজের সমস্ত জীবন দিয়ো আত্মনিয়োাগ করলেন। পরিবার হলো উপেক্ষিত। এমন আদর্শবান, নিবেদিতপ্রাণ, আপাদমস্তক রাজনীতিক আজকের দিনে খুঁজে পাওয়া যাবে না ।

 

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

আতাউর রহমান খান কায়সার : বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে আওয়ামী লীগকে সমৃদ্ধ করেছেন

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তিনি একজন Knowledgeable মানুষ ছিলেন। রাজনীতিকের বুদ্ধিজীবী হতে বাধা নেই। রাজনীতিওত এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা। যদিও বহুদিন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বুদ্ধিবৃত্তির পরিবর্তে

বিস্তারিত »

মুক্তিযুদ্ধে পটিয়ার বৃহৎ অপারেশন জিরি মাদ্রাসা, গুলিবিদ্ধ হন ইউসুফ

৭১ -এর মুক্তিযুদ্ধে পটিয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা একটি বড় ধরণের অপারেশন করেন জিরি মাদ্রাসায়। উক্ত মাদ্রাসা ছিলো মুজাহিদ বাহিনীর ঘাঁটি এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজাকার

বিস্তারিত »

রাজনীতির বরপুত্র, সফল নেতা মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী

চট্টগ্রামের রাজনীতির একটি বর্ণাঢ্য আকর্ষক চরিত্র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী। তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া, চট্টগ্রামের অভিভাবক সংস্থা পৌর কর্পোরেশনের একবার প্রশাসক ও একবার মেয়র, দেশে

বিস্তারিত »

ভারত আশ্রয় না দিলে, সাহায্য না করলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না

ভারত একটি জুজু, কিছুদিন পর পর এই জুজুর ভয় দেখিয়ে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। আগের দিনে যেমন পাড়া গাঁয়ের মা-বোনেরা বর্গীর ভয়

বিস্তারিত »

দেশের বর্তমান ক্রান্তিকাল উত্তরণে সিইউজের ঐতিহাসিক ভূমিকা স্মরণ

সাংবাদিকদের সমস্যা নিয়ে সংবাদপত্র মালিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা থেকে যে সংগঠনটি জন্ম লাভ করেছিলো ষাটের দশকে, তার নাম সিইউজে বা চিটাগাং

বিস্তারিত »

ত্রিশের যুববিদ্রোহে শ্বেতাঙ্গদের জাহাজে চড়ে সমুদ্রে পলায়নের অজানা কাহিনি

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহ, যা সিপাহী বিদ্রোহ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত, সেই বিদ্রোহে চট্টগ্রামের শ্বেতাঙ্গ নাগরিকেরা ভয়ে প্রাণ রক্ষার জন্য সমুদ্রে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইতিহাসে এটুকু তথ্যই পাওয়া

বিস্তারিত »

আহমদ শরীফ মনীর : রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

স্বাধীনতা-উত্তর পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভক্তি এবং একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করে; সেই দলের নাম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এটা বোধ হয় কারো অজানা

বিস্তারিত »

জান আলীকে নিয়ে মকবুলের কবিতা : তক দে মিয়া বকশিস দিবা আসলত্তুন হানি

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের পথিকৃৎ শিল্পপতি এ কে খানের পিতামহ জান আলী খান চৌধুরী ১৮ ও ১৯ একজন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার ও সমাজপতি ছিলেন। আঠার শতকে

বিস্তারিত »

ভালো মানুষের জন্য খারাপ সময়ে একজন ভালো মানুষের প্রস্থান

জীবন থেকে ছুটি নিলেন মোবারক ভাই। মোবারক ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে আমার মধ্য নানা রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন এটা সত্য

বিস্তারিত »