এক সময় সমগ্র চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে পটিয়া থানা ছিলো সর্বদিক দিয়ে সর্বাপেক্ষা অগ্রগণ্য স্থান। ঢাকা জেলার মধ্যে বিক্রমপুর যেমন সর্বদিক দিয়ে একদা সর্বাধিক অগ্রগণ্য ছিল, সেইরূপ পটিয়ার বৈশিষ্ট্যের জন্যে পটিয়াকে এক সময়ে বল হতোÑ ‘চট্টগ্রামের বিক্রমপুর’।
ও মলি-কৃত চিটাগাং ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারে বলা হয়েে “Patiya is the most highly educated part of the district and the centre of the greatest mental activity’1
‘…সেখানে সমগ্র জেলার মধ্যে পটিয়া থানার স্থান ছিল সবার শীর্ষে। লোকে বলত পটিয়ায় ‘লক্ষ্মী-সরস্বতী’ একত্রে বিরাজ করেন। বাস্তবিক পক্ষে বিদ্বান ও বিত্তবানদের এরকম একত্র সমাবেশ দেখা যেত আর কেবল ঢাকা জেলার বিক্রমপুর অঞ্চলে।…..পটিয়াকে বলা হত চট্টগ্রামের বিক্রমপুর’।২
শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে চট্টগ্রামকে নেতৃত্ব দিয়েছে পটিয়া। দু’ একটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে পটিয়ার যাত্রা মোহন সেন ও তাঁর পুত্র দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার শুধু চট্টগ্রাম নয়, নিখিল বঙ্গে সমাদৃত হয়েছিলেন; শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সৈয়দ সুলতান, মাগন ঠাকুর, মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের রচয়িতা শ্রীকর নন্দী, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ (সুচক্রদ-ী), শরচ্চন্দ্র দাশ (আলামপুর), কবি গুনাকর নবীন চন্দ্র দাশ (আলামপুর), কবি ভাস্কর শশাঙ্ক মোহান সেন (ধলঘাট), আস্কর আলী প-িত (শোভনদ-ী), ড. আহমদ শরীফ (সুচক্রদ-ী), সোমনাথ হোর (বরমা), আহমদ ছফা (গাছবাড়িয়া), রুনু বিশ্বাস (ছনহরা), বর্তমান চন্দনাইশের কবিয়াল করিম বক্স ও মনীন্দ্র সরকার, শিল্পী লক্ষ্মীপদ আচার্য, আবদুল গফুর হালির সৃষ্টি ও সাধনা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির অমূল্য স্থায়ী সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বিপিন নন্দী (জঙ্গলখাইন), আবদুর রহমান (পটিয়া), কবি আলাদীন আলীনূর (সাতবাড়িয়া), কবি নূর মুহম্মদ চৌধুরী সাহিত্যরতœ ও আবদুস সাত্তার চৌধুরী (হুলাইন) চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও গবেষক। ভাষা আন্দোলন ও বাংলা কলেজের জন্য অধ্যক্ষ আবুল কাশেম স্মরণীয়। রাষ্ট্রদূত কে এম শিহাবুদ্দিন একাত্তরের ৬ এপ্রিল দিল্লিতে হাই কমিশনে কর্মরত অবস্থায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কূটনৈতিক ফ্রন্টে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন। অর্থনীতিবিদ ড. নুরুল ইসলাম (পটিয়া) ও সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন (ধলঘাট)-আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী। ষাটের দশকের প্রথম দিকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে ড. নুরুল ইসলামের গবেষণা বাঙালির স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের তাত্ত্বিক জমি প্রস্তুত করতে বিশেষ অবদান রাখে। আগরতলা মামলার পর থেকে তিনি ৬ দফার পক্ষে কাজ করেন। সত্তরে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অর্থনৈতিক নীতিমালা রচনা ও সে সবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দান করার জন্য আওয়ামী লীগের যে টিম ছিলো ড. নুরুল ইসলাম তার একজন সদস্য ছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ের পর ৬-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে সংবিধানের খসড়া তৈরির সঙ্গে একজন পেশাজীবী বিশেষজ্ঞ হিসেবে জড়িত ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাঁকে প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস-চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন।
চিকিৎসার কিংবদন্তী সুচক্রদ-ীর ষষ্ঠী বৈদ্য ও ডা. অন্নদা চরণ খাস্তগীরের সার্থক উত্তরসূরী পটিয়ার মোহাম্মদপুরের জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম।
শিক্ষা ক্ষেত্রে পটিয়ার আরো কয়েকজন কীর্তিমান পুরুষ হলেনÑকলকাতা ভেটেরিনারি কলেজের প্রথম বাঙালি অধ্যক্ষ আবদুল লতিফ ও তাঁর ভাই অঙ্কের যাদুকর, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের অধ্যাপক ড. আতাউল হাকিম, কবি সৈয়দ সুলতানের নাতি চট্টগ্রামে আরবি শিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ, আধ্যত্মিক পুরুষ হযরত শাহ গদী, পটিয়া হাইস্কুলের কিংবদন্তী প্রধান শিক্ষক গৈড়লা গ্রাম নিবাসী সূর্যকুমার সেন, হাবিলাসদ্বীপ হাইস্কুলের প্রথিতযশা প্রধান শিক্ষক বৈলতলী গ্রাম নিবাসী সফদর মিয়া, দোহাজারী হাইস্কুল-খ্যাত শিক্ষক মোহাম্মদ গ্রাম নিবাসী ইদ্রিস মাস্টার, মনসা গ্রাম নিবাসী আবদুল হক, কর্তালা গ্রাম নিবাসী নির্মল বড়–য়া, লাখেরা গ্রাম নিবাসী অশ্বিনী বড়–য়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. ললিত মোহন নাথ, কুমিল্লা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মনসা গ্রাম নিবাসী মোহাম্মদ নুরুস সাফা, চট্টগ্রাম সরকারী কমার্স কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুর রহিম, চট্টগ্রাম কলেজের সাবেক অধ্যাপক ড. আবদুস সবুর, অধ্যাপক আবু তৈয়ব প্রমুখ।
বার আউলিয়া-খ্যাত দু’জন আউলিয়া হযরত ইয়াসিন আউলিয়া ও হযরত শাহচান্দ আউলিয়া অধ্যাত্ম সাধনা পটিয়াকে খ্যাতিমান করে তুলেছে।
সিএসপি অফিসার সাবেক কে এম আহসান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এয়াকুবদ-ী নিবাসী এজেডএম নাসির উদ্দিন, পুলিশের সাবেক এডিশনাল আইজি নসরুল্লাহ খান, ড. আবদুল মাবুদ, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ড. কেএম ফরিদ উদ্দিন, পটিয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রের খ্যাতিমান পুরুষ। মহিম চন্দ্র গুহ, কামিনীকুমার দাশ, সিআইই, এমএলসি, এডভোকেট আহমদ সোবহান, বিচারপতি ফজলুল করিম (সাবেক প্রধান বিচারপতি) এডভোকেট বদরুল হক খান, এডভোকেট মোতাহের আলী, এডভোকেট বদিউল আলম, এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ আইনপেশার কিংবদন্তী পুরুষ।
সাংবাদিকতায় পটিয়ার সুচক্রদ-ী গ্রামের কালী শংকর চক্রবর্তী ১৯২১ সালে বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে পটিয়ার নাম অমর করে রেখেছেন। পটিয়ার আরো ক’জন সাংবাদিক হলেনÑআজাদ-খ্যাত নুরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান খান ও মোহাম্মদ ইউসুফ। প্রখ্যাত সমাজকর্মী যোগেন্দ্র চন্দ্র গুহ (জে সি গুহ)Ñতিনি সুদীর্ঘকাল চট্টগ্রাম পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করেছিলেন; চট্টগ্রাম শহরে নন্দন কানন বোস ব্রাদার্স থেকে রাইফেল ক্লাব পর্যন্ত সড়কটি তাঁর নামের গৌরব বহন করছে।
অন্য প্রসঙ্গ বাদ রেখে শুধু রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামেই যদি উদাহরণ হিসেবে নেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে এক্ষেত্রেও পটিয়া যে অমূল্য অবদান রেখেছে তা শুধু চট্টগ্রাম কেন, অবিভক্ত বাংলার ইতিহাসেও বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। পটিয়ার ধলঘাট গ্রামের আইনজীবী দুর্গাদাস দস্তিদার ও গুয়াতলী গ্রামের প্যারীমোহন চৌধুরী ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্বোধক। দুর্গাদাস দস্তিদার চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ‘ত্রিমুকুট’ শিরোপাধারী দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে (সাকিন বরমা, বর্তমানে চন্দনাইশ উপজেলার অন্তর্ভুুক্ত) অবিভক্ত ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চের একজন বিশিষ্ট কুশীলব বললেও অত্যুক্তি হবে না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের (সি.আর দাশ) ঘনিষ্ঠ সহকর্মী দেশপ্রিয় জে এম সেনগুপ্ত তৎকালীন বঙ্গীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর পিতা যাত্রামোহন সেন, বরমারই আরেক শ্রেষ্ঠ সন্তান মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীও বাংলার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মওলানা যৌবনে দেশপ্রিয়’র সিনিয়র সহকর্মী এবং বৃদ্ধ বয়সে নেতাজী সুভাষ বসু’র সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের ‘সেনাপতি’ হয়েছিলেন। দেশপ্রিয় ও মওলানার প্রায় সমকালে পটিয়া থেকে আরেকজন যিনি চট্টগ্রামের রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তিনি হলেন ভাটিখাইনের মহিমচন্দ্র দাশ। তিনি এবং তাঁর যমজ ভাই বেনীমাধব দাশ আরবান কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানে আন্দরকিল্লা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সম্মুখে এই ব্যাংকের নামে এবং স্থানে আরবান সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মহিমচন্দ্র দাশ চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার জন্যও স্মরণীয় ব্যক্তি। বহুখ্যাত ‘পাঞ্চজন্য’ পত্রিকার তিনি উদ্যোক্তা ও সম্পাদক ছিলেন। চট্টগ্রামবাসী তাঁকে ভালোবেসে ‘চট্টল গৌরব’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
জেএম সেনগুপ্ত, ইসলামাবাদী, মহিম দাশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির আড়ালে মাস্টারদা সূর্য সেন, চারু বিকাশ দত্ত, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র বিপ্লবী রাজনীতির ধারা বেগবান হয়ে উঠছিলো, ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণে যা প্রচ- গর্জনে বিস্ফোরিত হয় এবং চারদিন চট্টগ্রামকে স্বাধীন রেখে ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে পরাক্রান্ত ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করে আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষকে কাঁপিয়ে দেয়। ১৯৩৪ সাল অব্দি মাস্টারদা’র বিপ্লব-যজ্ঞে সামিল হয়েছিলেন পটিয়ার ২৮ জন বিপ্লবী যুবক। তাঁরা হচ্ছেন : ১. শহীদ জিতেন দাশগুপ্ত (গৈড়লা)-জালালাবাদের যুদ্ধের শহীদ। ২. শহীদ শশাঙ্ক দত্ত (ডেঙ্গাপাড়া)-জালালাবাদের যুদ্ধের শহীদ। ৩. অর্দ্ধেন্দু দস্তিদার (ধলঘাট)-জালালাবাদের যুদ্ধের শহীদ। ৪. অমরেন্দ্র নন্দী (দক্ষিণ ভূর্ষি)-পুলিশ কর্তৃক অবরুদ্ধ অবস্থায় আত্মাহুতি। ৫. হিমাংশু চক্রবর্তী (হাবিলাসদ্বীপ)-পল্টন মাঠে শ্বেতাঙ্গ সমাজের বিশেষ ক্রিকেট খোলায় আক্রমণÑসংঘর্ষে শহীদ। ৬. মনোরঞ্জন দাশগুপ্ত (ছনদ-ী)- ১৯ মে ১৯৩৩ সালে গহিরা যুদ্ধে শহীদ। ৭. হরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (বাগদ-ী)-ফাঁসিতে আত্মদান। ৮. ফনীন্দ্র নন্দী (দক্ষিণ ভূর্ষি)Ñজেলে যক্ষারোগে মৃত্যু। অস্ত্রাগার আক্রমণ ও জালালবাদ যুদ্ধের সৈনিক। ৯. শহীদ রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী (ধলঘাট)-১৩ মে ১৯৩২ সালে ধলঘাট যুদ্ধে অংশ নেন। সাবিত্রী দেবীর পুত্র। ১০. সহায় সম্পদ চৌধুরী (দক্ষিণ ভূর্ষি)-বন্দী অবস্থায় বিনা বিচারে মৃত্যু। ১১. সুখেন্দু দস্তিদার (ধলঘাট)। ১২. কিরণ সেন (হাবিলাসদ্বীপ)-৯ জানুয়ারি ১৯৩৪ মাস্টারদাকে যিনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন সেই বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেনকে হত্যা করেন। ১৩. অর্দ্ধেদু শেখর গুহ (দক্ষিণ ভূর্ষি)-যুব বিদ্রোহে অংশগ্রহণ, জেল থেকে বন্দী মুক্তি পরিকল্পনাÑডিনমাইট ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী ১৪. মনীন্দ্র লাল গুহ (ভাটিখাইন)-যুব বিদ্রোহে অংশগ্রহণ। ১৫. হেমেন্দু বিকাশ দস্তিদার (ধলঘাট)। ১৬. দীনেশ চক্রবর্তী (ধলঘাট)-যুদ্ধ বিদ্রোহে অংশগ্রহণ। ১৭. ব্রজেন সেন (গৈড়লা)। ১৮. সুধীন্দ্র নাথ দাশ (ভাটিখাইন)। ১৯. ক্ষীরোদ প্রভা বিশ্বাস (গৈড়লা)। ২০. অরুণ দস্তিদার (টুলু) । ২১. দীনেশ দাশগুপ্ত (ধলঘাট)। ২২. প্রশান্ত দাশগুপ্ত (সুচিয়া)। ২৩. শ্রীমতি আরতি রক্ষিত (সিংহ)-(জোয়ারা)। ২৪. শ্রীমতি নিবেদিতা গুহ (চৌধুরী)-দক্ষিণ ভূর্ষি। ২৫. শান্তিরঞ্জন সেন (গৈড়লা) ২৬. রবীন্দ্র নন্দী (খোকা)- হাবিলাসদ্বীপ। ২৭. শহীদ প্রমোদ চৌধুরী (কেলিশহর)। ২৮. শহীদ কৃষ্ণ চৌধুরী (কেলিশহর)।
স্বদেশী যুগের এক নায়ক কেদারনাথ দাশগুপ্ত ব্রিটিশ পুলিশের তাড়া খেয়ে লন্ডনে গিয়ে আন্তর্জাতিক বিদ্বজ্জনম-লির মধ্যে স্থান করে নিয়ে তাঁর গ্রাম ভাটিখাইন ও থানা পটিয়াকে গৌরবান্বিত করেছিলেন। কেদারনাথ দাশগুপ্ত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের (১৯০৫) সময় স্বদেশী সামগ্রী বিক্রির জন্য ‘লক্ষ্মীর ভা-ার’ নামে দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময়ে তিনি ‘ভা-ার’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর বিশেষ অনুরোধে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বাউল ও স্বদেশী গানগুলি প্রথমে ‘ভা-ার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিত্তরঞ্জন দাশ, স্বদেশী আন্দোলনখ্যাত যোগেশচন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ।
পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রাম নিবাসী প্রাণকুমার দস্তিদারের পরিবার থেকে তিনজন শহীদ অর্দ্ধেন্দু দস্তিদার, সুখেন্দু দস্তিদার ও হেমেন্দু দস্তিদার-সরাসরি যুব বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন। এঁরা তাঁর পৌত্র। অর্দ্ধেন্দু দস্তিদার জালালাবাদ যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁর আরো দু’ পৌত্র-পূর্ণেন্দু দস্তিদার ও শরবিন্দু দস্তিদার পরোক্ষভাবে অগ্নিযুগের বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। কোনো একটি পরিবারের পাঁচ সদস্যের একই সময়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতার যজ্ঞে জড়িত হওয়ার এটিই একমাত্র দৃষ্টান্ত; সম্ভবত বাংলাদেশেও এটি একটি অনন্য ঘটনা। ধলঘাটের দস্তিদার পরিবারের মহিমা এখানেই শেষ নয়। পূর্ণেন্দু দস্তিদার, সুখেন্দু দস্তিদার ও শরবিন্দু দস্তিদার বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতিতে তিনটি ধারার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। পূর্ণেন্দু দস্তিদার চট্টগ্রাম জেলা কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ) ও কমিউনিস্ট গ্রুপের নেতা ছিলেন। প্রাণকুমারের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র এবং হেমেন্দু দস্তিদার ও শরদিন্দু দস্তিদারের পিতা ডা. অক্ষয় কুমার দস্তিদারও উড়িষ্যা কটক মেডিকেল স্কুলে পড়ার সময় শহীদ ক্ষুদিরাম গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি মহাত্মা গান্ধীর অনুপ্রেরণায় সরকারী চাকরি ত্যাগ করে চট্টগ্রাম প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। সে সময় তিনি চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের একজন নেতা ছিলেন। ১৯২৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
সুখেন্দু দস্তিদার-যিনি আন্ডাগ্রাউন্ডে থাকাকালে ‘বশীর ভাই’ নামে পরিচিত ছিলেনÑতিনি চট্টগ্রাম ‘অস্ত্রাগার-লণ্ঠন-মামলার’ অন্যতম আসামি ছিলেন; তাঁর যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার এক বছর পর তাঁকে ‘কালাপানি দ্বীপান্তর’ অর্থাৎ আন্দামান সেলুলার জেলে স্থানান্তর করা হয়। আন্দামানে থাকতেই তাঁর জীবনে বিরাট পরিবর্তন আসে; তিনি মার্সকবাদে দীক্ষিত হন। ষোল বছর কারা-নিগ্রহের পর মুক্তিলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম জেলা কমিউনিস্ট পার্টিতে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৪৬-৪৭ সালে চট্টগ্রাম-তেভাঙ্গা আন্দোলনের সময় তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। দু’বছর পর তিনি গ্রেফতার হন। এক বছরের মধ্যে কোনো রকমে জামিন লাভে সক্ষম হয়ে আবার আত্মগোপনে চলে যান। দু’বছর পরই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির সদস্য হন। পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় কমিটির সভ্য নির্বাচিত হন। মস্কো-পিকিং (বেইজিং) মতাদর্শগত বিরোধে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন দু’ শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়লে তার প্রভাবে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিও ভেঙে যায়। সুখেন্দু দস্তিদার ও মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। এই পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন সুখেন্দু দস্তিদার। ১৯৭২ সালে পার্টি পুনরায় বিভক্ত হলে তিনি সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন হন। ধলঘাট গ্রামের আরেকজন বিশিষ্ট রা নৈতিক নেতা হলেন অধ্যাপক পুলিন দে, তিনি ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সোস্যলিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি আওয়ামী লীগ যোগ দেন এবং মৃত্যুর পূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন।
চট্টগ্রামের বাম ধারার রাজনীতিতে আরো দু’জন বিশিষ্ট নেতা ছিলেন পটিয়ার কেলিশহরের কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো ও হাবিলাসদ্বীপের কৃষক নেতা ধীরেন দাশ। উভয়ই চট্টগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির শাখা গঠনের পর প্রথম দিকে এই পার্টির সভ্য হন এবং ক্রমান্বয়ে নেতৃত্বের স্তরে উন্নীত হন। পূর্ণেন্দু কানুনগো দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ছিলেন।
এঁদের পরেই তিনজন বামপন্থী রাজনীতিকের নাম উল্লেখ করতে হয়; যাঁরা কাছাকাছি বয়সের মানুষÑ গত শতকের ত্রিশের দশকারম্ভের অনতিপূর্বে বা অনতিপরে যাঁদের জন্ম। এই তিন নেতা হলেন মনসা গ্রামের চৌধুরী হারুনুর রশিদ, উজিরপুরের এম এ মালেক ও আলমাদারপাড়ার বদিউল আলম চৌধুরী। চৌধুরী হারুন একাধারে সাংস্কৃতিক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন এবং জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব করেছেন।
তিনি ১৯৫১ সালে হরিখোলা মাঠে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সংস্কৃতি সম্মেলনের অন্যতম সংগঠক, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহবায়ক, ২৩ ফেব্র“য়ারি ’৫২ লালদিঘি ময়দানে মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসি নি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি, পাঠ করেন; সেজন্যে চৌধুরী হারুনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পারোয়ান জারি করা হয়। ১৯৮৬ সালে অসুস্থ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য হন।
এম এ মালেক বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা এবং বামপন্থী রাজনীতির অন্যতম সংগঠক ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হওয়ার পর তিনি পিকিংপন্থী পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজনীতি করেন।
বদিউল আলম চৌধুরী আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ৫৭ সালে ন্যাপ গঠিত হওয়ার পর তিনি সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ন্যাপে যোগদান করেন। তিনি কৃষকদের মধ্যে তাঁর কর্মক্ষেত্র নির্বাচন করে মাকর্সবাদী রাজনীতির অনুশীলনে প্রবৃত্ত হন। চট্টগ্রামের একজন বিশিষ্ট কৃষক নেতা হিসেবে ব্যাপক পরিচিত লাভ করেন বদিউল আলম। এম এ মালেকের মতো তিনিও পার্টির বিভক্তির পর পিকিং লাইনের অনুসারী পার্টির সঙ্গে কাজ করেন। স্বাধীনতার পর বদিউল আলম ‘লাল পতাকা’ একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন।
বাম রাজনীতির বিপরীতে ছিলো কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী ও মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। চল্লিশের দশকে ছাত্রদের মধ্যে কাজ করতো কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন-ছাত্র ফেডারেশন, মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনÑমুসলিম ছাত্রলীগ। বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস বা অল বেঙ্গল ছাত্র কংগ্রেস-এর চট্টগ্রামে শাখা ছিলো কিনা, থাকলেও কারা তার নেতা ছিলেন, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য আমরা পাই নি।
ফটিকছড়ির চিত্ত বিশ্বাস ও চিরেন সরকার, হালিশহরের মোহাম্মদ সেকান্দার, রাউজানের মাহবুব উল আলম চৌধুরী (ভাষা সৈনিক)Ñএঁরা ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের নেতা। ফজলুল কাদের চৌধুরী, এম এ আজিজ, আজিজুর রহমান (গোরা আজিজ), আবুল খায়ের সিদ্দিকী, নুরুল আনোয়ার চৌধুরী, মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী, মওলানা আবু তাহের, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এঁরা ছিলেনÑ মুসলিম ছাত্রলীগের প্রধান নেতা। চল্লিমের দশকের শেষদিকে কলকাতায় বঙ্গীয় মুসলিম লীগ দু’টি উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে খাজা নাজিমুদ্দিন ও মওলানা আকরম খাঁ, অন্যদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম-এর গ্রুপ; এর প্রভাবে ছাত্রলীগও দু’টি দল হয়ে যায়।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ উদার চিন্তাধারার অনুসারী,৩
‘তবে মুসলিম ছাত্রলীগ প্রথম থেকেই বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত ছিল এবং তারা সংগঠনের ক্ষমতা দখলের জন্য পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকত। মুসলমান রাজনৈতিক নেতারাও এক্ষেত্রে তাদের ব্যবহার করতেন। ১৯৩৬ সারেই জিন্নাহ এবং শেরে বাংলা ফজলুল হকের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল।৪
শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবীতে এই দলাদলির বর্ণনা আছে। তিনি লিখেছেন, “…মুসলিম ছাত্রলীগ দুই দলে ভাগ হয়ে গেল, একদল পরিচিত হত শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবের দল বলে, আরেক দল পরিচিত হত খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব এবং মওলানা আকরাম খাঁ সাহেবের দল বলে’।৫
এ সময় সোহরাওয়ার্দী-হাশিম অনুসারী ছাত্রলীগ নেতাদের যে নাম পাওয়া যায়, শেখ মুজিবের আত্মজীবনীতে, তাঁরা হলেন, ‘নূরুদ্দিন, বর্ধমানের খন্দকার নুরুল আলম ও শরফুদ্দিন, সিলেটের মোয়াজ্জেম আহমদ চৌধুরী, খুলনার একরামুল হক, চট্টগ্রামের মাহবুব আলম (সম্ভবত তিনি বাঁশখালী নিবাসী মাহবুব আনোয়ার-সম্পাদক), নূরুদ্দিনের চাচাতো ভাই এস.এ. সালেহ অন্যতম ছিল’।৬
ফজলুল কাদের চৌধুরীও কলকাতায় সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের৭ অন্যতম নেতা ছিলেন; কিন্তু১৯৪৪ সালের ডিসেম্বরে কুষ্টিয়ায় আহূত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের বার্ষিক কাউন্সিল৮ নিয়ে যখন এই দ্বিমুখী মেরুকরণ শুরু হয় এবং ৪৭’Ñএ গিয়ে যখন বিভাজন সম্পূর্ণ হয়, তখন ফজলুল কাদের চট্টগ্রামের চলে এসেছেন।
আনোয়ার হোসেন, শামসুল হুদা চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ ছিলেন নাজিমুদ্দীন-আকরম খাঁ গ্রুপের নেতা।
চল্লিশের দশকের শেষদিকে পটিয়ার অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীও মুসলিম ছাত্রলীগের একজন নেতা ছিলেন; কিন্তু তিনি সোহরাওয়ার্দী না খাজা নাজিমুদ্দীনের সমর্থক ছিলেনÑএ সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। নুরুল ইসলাম চৌধুরী পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি পটিয়া থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পটিয়া আসন থেকে এম.এন.এ নির্বাচিত হন।
তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক এবং মুজিবনগর সরকারের অধীনে গঠিত জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল, সাউথ ইস্ট জোন-১-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি পূর্বাঞ্চলীয় যুব শিবিরেরও প্রধান ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর সরকারের অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীর সমসাময়িক অথবা কিছুটা পরবর্তী পটিয়ার আরো চারজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা, যাঁদের নাম এতক্ষণ আমরা উল্লেখ করি নি, তাঁরাও চট্টগ্রামের রাজনীতিতে স্মরণীয় অবদান রেখেছেন। এই চার নেতা হলেনÑ হাবিলাসদ্বীপের ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, বরমার এ কে এম আবদুল মান্নান, ফতেনগরের অ্যাডভোকেট বদিউল আলম ও কচুয়াই’র মিঞা আবু মোহাম্মদ ফারুকী। মানিক চৌধুরী, শেখ মুজিব, এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর বিশেষ আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠ নেতা ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আগরতলা মামলার অবদান প্রত্যক্ষÑমানিক চৌধুরী এই সশস্ত্র স্বাধীনতা প্রচেষ্টায় শেখ মুজিব ও লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের পরেই মুখ্য ব্যক্তি এবং ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে এক নম্বর ব্যক্তি ছিলেন।
চট্টগ্রামে প্রথমাবধি যাঁরা আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করে দৃঢ় ভিত্তির ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত করেন, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই এ কে এম আবদুল মান্নান একটি বিশিষ্ট এবং শ্রদ্ধেয় নাম।
১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার পর পরই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দলটির সঙ্গে জড়িত হন এবং চট্টগ্রাম সদর দক্ষিণ মহকুমা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন।
চট্টগ্রামের প্রথিতযশা আইনজীবী অ্যাডভোকেট বদিউল আলম এক সময় পটিয়া তথা দক্ষিণ মহকুমার আওয়ামী রাজনীতি প্রধান নেতা ছিলেন। তিনি ১৯৫৩ সালে চট্টগ্রাম সদর দক্ষিণ মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং অনেক দিন সে দায়িত্ব পালন করেন। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন এস্তেফাজুল হকÑ তিনি কী বাঁশখালী নিবাসী? আমরা নিশ্চিত নই। ১৯৫৩ সালে অ্যাডাভোকেট বদিউল আলমকে সভাপতি করে মহমুকা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠিত হলে এ কে এম আবদুল মান্নানই আবার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
মিঞা আবু মোহাম্মদ ফারুকী ষাটের দশকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের একজন বিশিষ্ট নেতা এবং বৃহত্তর জেলা আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির প্রথমে দপ্তর সম্পাদক ও সম্ভবত এ কে এম আবদুল মান্নানের পরে প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আন্দরকিল্লায় তাঁর চট্টল লাইব্রেরিতে প্রতিদিন এম এ আজিজের উপস্থিতি ছিলো অপরিহার্য এবং সেটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের যোগাযোগ কেন্দ্র বা মিলনস্থল ছিলো বললে বাড়িয়ে বলা হয় না।
গোরনখাইনের সুলতান আহমদ কুসুমপুরীও চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের একজন উল্লেখযোগ্য নেতা ছিলেন। তিনি এম এ আজিজের বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে তিনি পটিয়ার প্রাদেশিক পরিষদের আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান এবং চট্টগ্রামে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নেতা ও ৫৪ সালের নির্বাচিত এমএনএ, জনপ্রিয় জননেতা পূর্ণেন্দু দস্তিদারকে পরাজিত করে এমপিএ নির্বাচিত হন। ব্রিটিশ সেনাবিাহিনীর সদস্য সুলতান কুসুমপুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় ধোপাছড়িতে বিশাল এক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন এবং গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি দেমাগ্রীতে গিয়ে একটি নিয়মিত সেনা দল নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেন।
ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জনপদ বরমা থেকেই ষাটের দশকের আরেকজন নেতার আবির্ভাব ঘটেÑতিনি হচ্ছেন শহীদ মুরিদুল আলম। তিনি ১৯৬০-৬১ চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদের জি.এস ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো। এই আন্দোলনের অন্যতম পরিকল্পনা ও সংগঠক ছিলেন শহীদ মুরিদুল আলম। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনেরও তিনি অন্যতম শীর্ষনেতা। চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের প্রকৃত সংগ্রামী অভিযাত্রা শুরু হয় বাষট্টিতে; সামরিক শাসনাবসানের পর ছাত্রলীগকে যারা পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্গঠিত করেন, তাঁদের অগ্রভাগেই ছিলেন শহীদ মুরিদুল আলম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠশেষে তিনি চট্টগ্রামে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক মেধা ও সাংগঠনিক ক্ষমতা দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি একজন মেধাবী রাজনীতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধে নিজে জীবন বিসর্জন করে তিনি দেশের জন্য চরম ত্যাগ স্বীকার করেন।
পটিয়ার আর একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হচ্ছেন এসএম ইউসুফ; তিনি ষাটের দশকে চট্টগ্রামে মেধাবী ছাত্রনেতা, বাগ্মী হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন বিশিষ্ট সংগঠক এবং বিএলএফ-এর জেলা কমান্ডার ছিলেন। আশির দশকে তিনি ঢাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে জড়িত হয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে পটিয়া সদর ছিলো দক্ষিণ চট্টগ্রামের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। দক্ষিণ চট্টগ্রাম বলতে বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, সাতকানিয়া এবং বাঁশখালী। এই সরলীকরণের বিপজ্জনক ঝোঁকের মধ্যে এই নির্মম সত্য ও রূঢ় বাস্তবটা ঢাকা থাকে যে, শহরের নিকটবর্তী বোয়ালখালী এবং প্রান্তবর্তী আনোয়ারা ও বাঁশখালী কেন্দ্রাভিমুখী নয়, বরং শহরের সঙ্গেই নৈকট্য বোধ করতো।
এক ও অখ- পটিয়ার মধ্যে ছিলো আবার অনেক পটিয়ার বসবাস-দক্ষিণ, পশ্চিম ও মধ্য পটিয়া। মধ্য ছিলো সদর পটিয়ার সঙ্গেই জুড়ে; দক্ষিণ পটিয়া স্বাধীনতার পরে চন্দনাইশ নামে প্রথমে পৃথক থানা ও পরে উপজেলা হলো। পশ্চিম, পটিয়ার গৌরব নিয়েই, আজো পটিয়ার সঙ্গে লীন হয়েই আছে। তবে সেই সময়ের অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় দুরধিগম্য পশ্চিম পটিয়ার রাজনীতিটা কেন্দ্রের সঙ্গে শিথিল সম্পর্কে বজায় রেখে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবেই বিকশিত হয়েছিলো। পশ্চিম পটিয়াও আবার বরকল খাল বা চানখালী খাল দ্বারা বিভাজিত হয়ে খালের পশ্চিম পাশে পাঁচ ইউনিয়ন, যা এখন কর্ণফুলী থানা নামে পরিচিত এবং পূর্ব পাশে জিরি, কুসুমপুরা, কোলাগাঁও, আশিয়া, আংশিক বরলিয়া এবং হাবিলাসদ্বীপ-পরস্পর সংলগ্ন এই ইউনিয়নসমূহ নিয়ে পশ্চিম পটিয়ার আরেক ভাগ। ৬৯ সালে হুলাইন সালেহ-নূর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পশ্চিম পটিয়ার রাজনীতির কয়েকটি কেন্দ্র ছিলো; তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑপাঁচরিয়া দিঘিরপাড়, বুুধপুরাহাট, ফকিরা মসজিদ, মিঞার হাট, কালারপোল, ফকিরনীরহাট ইত্যাদি।
একাত্তর সালে পটিয়া ছিলো এক বিশাল থানা। সত্তরের নির্বাচনে চট্টগ্রাম জেলায একমাত্র পটিয়া থানাকে নিয়েই জাতীয় পরিষদের একটি আসন গঠিত হয়েছিলো; অন্য কথায় পটিয়াই ছিলো এককভাবে একজন এম.এন.এ’র আসন। মিরসরাই ও ফটিকছড়ি দুই থানা মিলিয়ে এমএনএ সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি’র আসন; সীতাকু–সন্দ্বীপ নিয়ে এম আর সিদ্দিকীর আসন; ডবলমুরিং, কোতোয়ালী ও পাঁচলাইশ (আংশিক) নিয়ে এম এ আজিজ। এম এ মজিদের আসন; পাঁচলাইশ (আংশিক), বোয়ালখালী ও রাঙ্গুনিয়া নিয়ে ইদ্রিস বিএসসির আসন; হাটহাজারী ও রাউজান নিয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের আসন; পটিয়া থানা নিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীর আসন; সাতকানিয়া-চকরিয়া (আংশিক) নিয়ে আবু সালেহ’র আসন; আনোয়ারা-বাঁশখালী-কুতুবদিয়া নিয়ে আতাউর রহমান খান কায়সারের আসন এবং বর্তমান কক্সবাজার জেলার চকরিয়া (আংশিক), রামু, উখিয়া টেকনাফ, মহেশখালী উপজেলা এবং কক্সবাজার সদর নিয়ে গঠিত আসন থেকে নুর আহমদ এম.এন.এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। তৎকালীন বৃহত্তর চট্টগ্রামের জাতীয় পরিষদের আসন বিন্যাস থেকে আমরা দেখলাম একমাত্র পটিয়া থানারই একটি এম,এন.এ আসনের গৌরব ছিলো। প্রাদেশিক পরিষদে পটিয়ার অংশ নিয়ে দু’টি আসন ছিলো, যার একটিতে আনোয়ারা-পশ্চিম পটিয়া থেকে এমপিএ নির্বাচিত হয়েছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী; অপরটি দক্ষিণ পটিয়া-সাতকানিয়া (আংশিক) থেকে এমপিএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ডা. বি. এম. ফয়েজুর রহমান। আশির দশকে দেশের কতগুলো থানাকে মান উন্নীত করে উপজেলা গঠন করা হলে চন্দনাইশ উপজেলা গঠিত হয়। পশ্চিম পটিয়াও একটি উপজেলা হলে অসুবিধা ছিলো না।
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পটিয়া : পাঁচরিয়াÑসালেহ-নূর কলেজ কেন্দ্র
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বছরে পটিয়া থানার দ্বিতীয় কলেজটা স্থাপিত হয় হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের হুলাইন গ্রামে। হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নটা পটিয়া থানার সীমান্তবর্তী একটি ইউনিয়ন। কর্ণফুলী নদী থেকে পূর্বাভিমুখে প্রবাহিত একটি খাল পটিয়া ও বোয়ালখালী থানার সীমান্ত রচনা করেছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক উত্তরে কালুরঘাটের দিক থেকে এসে মিলিটারির পোল থেকে হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের বুক চিরে দক্ষিণ সীমান্ত রচনা করে পটিয়া সদর অভিমুখে চলে গেছে।
তো একটা আগুনে সময়ে ওই যে কলেজটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, যার নাম হুলাইন ছালেহ-নূর কলেজ, সেটি পটিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে তো বটেই, রাজনৈতিক চেতনার বিকাশেও বিরাট ভূমিকা রেখেছিলো।
কলেজ থেকে বড়জোর তিনশো গজ পশ্চিমে পাঁচরিয়া দিঘির পাড়, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন থেকে পশ্চিম পটিয়ার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন মেনন-মতিয়া উভয় গ্রুপ ঐক্যবদ্ধভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। বছরের শুরুতে গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব শাহীর পতন ঘটে। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার প্রত্যাহৃত হয় এবং বঙ্গবন্ধুসহ ঐ মামলার সকল আসামি মুক্তি লাভ করেন। আগরতলা মামলার দু’জন আসামি ছিলেন পটিয়া ও বোয়ালখালী থানার অধিবাসী। তাঁরা হলেন পটিয়া থানার হাবিলাসদ্বীপ গ্রামের ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী ও বোয়ালখালীর সারোয়াতলী গ্রামের বিধান কৃষ্ণ সেন। কারামুক্তির পর পাঁচরিয়া দিঘির পাড়ে তাঁদের বিরাট সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। কিছু আগে পরে চট্টগ্রামের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ কারামুক্ত হলে, তাঁদেরকেও পাঁচরিয়া দিঘির পাড়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সে সময় পাঁচরিয়া দিঘির উত্তর পাড়ে অনুষ্ঠিত ছাত্র সমাবেশে আগত ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে এসএম ইউসুফ, আবু তাহের মাসুদ, শাহ আলম ও সুবীর বাবুর (যিনি পরে হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা হয়েছিলেন) কথা মনে পড়ছে।
ঊনসত্তরের আন্দোলনে পশ্চিম পটিয়া আঞ্চলিক ছাত্রলীগ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। ছাত্রনেতা আবদুল হক এই কমিটির সভাপতি ও নূরুল ইসলাম ছিলেন সম্পাদক। চরকানাই হাইস্কুল ছিল ছাত্রলীগের বড় ঘাঁটি। এ স্কুলে যারা ছাত্রলীগ করতেন তারা হলেনÑ নুরুল ইসলাম (মনসা), আবু তৈয়ব, আবু তাহের ও ইউসুফ এস্কারী (বিনিনেহারা), নাসিরুদ্দিন চৌধুরী (হুলাইন), মোহাম্মদ রফিক, নুরুল ইমান চৌধুরী ও মাহমুদুর রহমান (চরকানাই)।
কলেজ প্রতিষ্ঠার পর, বছর গড়িয়ে যেতে না যেতেই সত্তর সালে, প্রাপ্ত বয়স্কের সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন (৫৪ তেও হয়েছিলো; কিন্তু তখন ছিলো পৃথক নির্বাচন প্রথা) অনুষ্ঠিত হলো। এই নির্বাচনে পটিয়া থেকে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন পটিয়া সদরের বাসিন্দা অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আর প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন পশ্চিম পটিয়ার কুসুমপুরা ইউনিয়নের গোরনখাইন গ্রামের অধিবাসী সুলতান আহমদ কুসুমপুরী। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে একক ও নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং পাকিস্তানে সরকার গঠনের দাবিদার হয়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করলে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঙালিদের স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ৭ মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক জনসভায় বজ্রকণ্ঠে প্রকারান্তরে প্রত্যাশিত স্বাধীনতার ঘোষণাই দিয়ে ফেলেন। সেদিন থেকে আরো পিছিয়ে ১ মার্চ, যেদিন ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চের পূর্ব নির্ধারিত সংসদ অধিবেশন আকস্মিকভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন, সেদিন থেকেই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রকাশ্যে শুরু হয়ে যায়।
পটিয়ায় সত্তরের নির্বাচনে, বলা বাহুল্য, আওয়ামী লীগের দু’প্রার্থীই বিজয় লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণার পর সারাদেশের ন্যায় পটিয়ায়ও স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পশ্চিম পটিয়ার বিভিন্ন স্থান যেমন মনসার টেক, পাঁচরিয়া দীঘির পাড়, চরকানাই ফুলতল, জিরি ফকিরা মসজিদ, কালারপোল প্রভৃতি স্থানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পটিয়া থানায় প্রথম ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় পশ্চিম পটিয়ায়। হুলাইন ছালেহ নূর কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত এক ছাত্র সমাবেশে পশ্চিম পটিয়া ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ছাত্রনেতা নুরুল ইসলাম (মনসা) সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক এবং ফরিদ বাঙালি (জিরি) ও আলী নূর (মনসা) যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। পরিষদের সদস্য ছিলেন নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ আসলাম ও রফিক আহমদ খান (হুলাইন), নুরুল আলম (গোরনখাইন), ফজল আহমদ ও আবু তাহের বাঙালি (জিরি), আবুল হাশেম (লড়িহরা), হামিদুল হক (সাদারপাড়া), হারুনুর রশিদ (এয়াকুবদ-ী, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), ফেরদৌস চৌধুরী (মোহাম্মদ নগর), নুরুল আমিন, রফিকুল আলম চৌধুরী ও মোহাম্মদ রফিক (চরকানাই), নুরুল আফসার (নাইখাইন), মুক্তিমান বড়–য়া (পাঁচরিয়া), এমএন ইসলাম (বর্তমান জুলধা), রশিদ আহমদ (চর পাথরঘাটা), আবু তাহের বাঙালি (দৌলতপুর), ইউনুস ও এয়াকুব (চরলক্ষ্যা) এবং কামাল (শাহমীরপুর) প্রমুখ।
অসহযোগ আন্দোলনে ৫নং হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন আহমদ, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নূর মোহাম্মদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আবু সৈয়দ। নুর মোহাম্মদ চৌধুরী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও হুলাইন ছালেহ- নূর কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
কালারপোল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন ছাত্রনেতা ফেরদৌস চৌধুরী ও সম্পাদক নুর হোসেন। এছাড়া এখানে একটি চেক পোস্ট ছিল, যাকে কেন্দ্র করে সক্রিয় ছিলেন অধ্যাপক জাফর আহমদ মোস্তফা, আলী আহমদ, অ্যাডভোকেট নূর মোহাম্মদ, আবুল কাশেম, জালাল প্রমুখ।
এ সময় কালারপোলে এমন একটি ঘটনা ঘটে, যা’ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধু’র সাতই মার্চের ভাষণের পর কালারপোল ফাঁড়ির সমস্ত পুলিশ ওসি রাজ্জাকের নেতৃত্বে ছাত্রদের সাথে একাত্ম হয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করে। তাদের অস্ত্র দিয়ে পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত স্থানীয় ছাত্র যুবকদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়।
জিরি ফকিরা মসজিদ এলাকায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন আবুল বশর চৌধুরী, ফরিদ উদ্দিন খান, ফজল আহমদ, ইসহাক, ফরিদুল আলম, আবু তাহের বাঙালি, এমদাদ, ফজলুল হক, আবদুল হাকিম, ফরিদ ও রুহুল আমিন (জিরি), এনামুল হক সিকদার, আবুল বশর, একরামুল হক ও জুলফিকার (গোরনখাইন), আবু তৈয়ব ও ইউসুফ এস্কারী (বিনিনেহারা), নুরুল আলম (গোরনখাইন) প্রমুখ।
ফকিরা মসজিদের সন্নিহিত গ্রাম গোরনখাইনে নবনির্বিাচিত এমপিএ সুলতান আহমদ কুসুমপুরীর বাড়ি হওয়ায় তাঁর নির্বাচন থেকে জিরি, বুধপুরা, সাঁইদাইর, দ্বারক, আশিয়া, কর্ত্তালা বেলখাইন, কাশিয়াইশ, মহিরা, মহিরা হিখাইন, গোরনখাইন, বিনিনেহারা প্রভৃতি এলাকা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দুর্গ হয়ে উঠেছিল। সুলতান আহমদ কুসুমপুরীকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক পরিম-ল গড়ে উঠেছিল তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন আবদুস সবুর চেয়ারম্যান, আহমদ নবী সওদাগর, ইমাম শরীফ, ডা. মুসলিম উদ্দিন, নুরুল ইসলাম খান, সালেহ আহমদ, ডা. আবদুল হক, মধুসূদন নাথ, খলিলুর রহমান (বর্তমানে বিশিষ্ট শিল্পপতি-কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান), আলতাফ মাস্টার, আবুল হোসেন মাস্টার, ব্রজেন্দ্র লাল বর্দ্ধন (দ্বারক পেরপেরা), আহমদ ছফা (দ্বারক), সুলতান আহমদ (বুধপুরা), আহমদ শরিফ মনীর (সাঁইদাইর), মাস্টার রফিকুল আলম চৌধুরী, জামালউদ্দিন ইয়াহিয়া, শামসুল হক ও আবুল বশর (কৈয়গ্রাম), মুসা (কুসুমপুরা), ফরিদ চেয়ারম্যান, মোজাহেরুল হক চৌধুরী (বরলিয়া), অমিয় চৌধুরী (কর্তালা), আবদুস সবুর ও আহমদ নবী (আশিয়া), ডা. শৈবাল দাশ, মাহমুদুল হক ইঞ্জিনিয়ার, আলী আহমদ (শিকলবাহা), মোহাম্মদ মিয়া (মাস্টারহাট), আবুল বশর চৌধুরী, ইসহাক, ফরিদ, ফেরদৌস চৌধুরী, ফজল আহমদ প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে উল্লেখিত এলাকাসমূহ মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হয়ে উঠে এবং বুধপুরা বাজার পশ্চিম পটিয়ার মুক্তিযুদ্ধে অঘোষিত হেডকোয়ার্টার এবং মুক্ত এলাকায় পরিণত হয়। বাজারের বসন্ত বাবুর চায়ের দোকান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আড্ডাস্থল। ক্যাপ্টেন করিম বুধপুরায় অবস্থান করে বহুদিন দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। অসহযোগ আন্দোলনকে সফল করে তুলতে যারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন ডা. নুরুল হাছান চৌধুরী, কামাল উদ্দিন চৌধুরী, আবদুল হক, মোহাম্মদ রফিক, রফিকুল আলম চৌধুরী, আবু তাহের (১), আবু তাহের (২), মফিজুর রহমান, আবদুস সালাম মুন্সি, মোহাম্মদ সৈয়দ, মোহাম্মদ মহসিন, নুরুজ্জমা ড্রাইভার ও নুরুল হক ফকির (চরকানাই), মোহাম্মদ ইউসুফ, আবদুস সবুর ও নুরুন্নবী (পূর্ব পাঁচরিয়া), সাধন মহাজন, অমর কৃষ্ণ চৌধুরী, সুধীর দাশ, নুরুল হক, স্বপন কুমার চৌধুরী ও তপু চৌধুরী (হাবিলাসদ্বীপ) প্রমুখ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা। চরকানাই ফুলতলে একটি শক্তিশালী সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সেখানে একটি চেক পোস্ট ও প্রাথমিক ট্রেনিং সেন্টার ছিল। আনসার কমান্ডার শওকত আলী ও ফজল আহমদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেন।
মনসার টেকে ন্যাপ নেতা এএনএম নূর উন নবীকে সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাশেম মাস্টারকে সাধারণ সম্পাদক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা চৌধুরী হারুনুর রশিদ। সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন, কামাল উদ্দিন খান, আবদুল মালেক, আবু সৈয়দ মাস্টার, ডা. নুরুল ইসলাম ও পেটান শীল (মনসা), ডা. জাফর ও ডা. নুরুন্নবী (এয়াকুবদ-ী) খোরশেদ (দক্ষিণ হুলাইন)। অসহযোগ আন্দোলনে হাবিলাসদ্বীপ, হুলাইন, পাঁচরিয়া ও মনসা গ্রামের কমিউনিস্ট পার্টি, মোজাফফর ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা হলেন, ব্যাংকার মফজল ও শাহজাহান (মনসা), মুক্তিমান বড়–য়া, শক্তিমান বড়–য়া, মধুসূদন নাথ ও দুলাল নাথ (পাঁচরিয়া), ধীরেন দাশ, বিমল দাশ, দেবেন্দ্র মহাজন, ননীগোপাল রায়, নৃপতি পাল, চারু বিশ্বাস, গৌরাঙ্গ নন্দী, অরুণ দত্ত ও বরুণ চৌধুরী (হাবিলাসদ্বীপ), মৌলভী আহমদ ছফা, মদিন উল্লাহ ও মামুনুর রশিদ (হুলাইন), শীলব্রত তালুকদার, নুরুল আনোয়ার, ইসহাক, কমরু ও বিভূতি বড়–য়া (চরকানাই)।
ভাসানী ন্যাপ-পন্থী পূর্ব বাংলা ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরাও নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখেন। যাঁদের নাম মনে পড়ছে তাঁরা হলেন আবু তৈয়ব (মনসা নিবাসী, বর্তমানে টি.কে শিল্পগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান), নুরুল আনোয়ার, আনোয়ার হোসেন খান, নুরুল আমিন, আবুল কাশেম, নুরুল আলম (১), নুরুল আলম (২) ও রফিক (হুলাইন)।
বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক এমন এক উন্মাদনা সৃষ্টি করলো যে, সমগ্র বাঙালি জাতি যেন রাজপথে নেমে আসলো। নিতান্ত অবোধ শিশু, অক্ষম বৃদ্ধ, পঙ্গু-রুগ্ন মানুষ, নিতান্ত পর্দানশীন নারী ছাড়া আর কেউ ঘরে বসে থাকলো না। ঘর ঘর হয়ে উঠলো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত দুর্গ। শহর-বন্দর-গ্রামে, মাঠে-ঘাটে-প্রান্তরে, অলি-গলি-রাজপথে লাঠি-সড়কি-বল্লম, লগি-বৈঠা হাতে মানুষ পাহারা দিতে শুরু করে। আক্ষরিক অর্থেই গোটা বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিলো দুর্ভেদ্য দুর্গ। প্রতিটি জাতির জীবনে এমন মুহূর্ত আসে, যখন সেই জাতির অন্তর্গত ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত জীবন জাতীয় জীবনের অঙ্গীভূত হয়ে একাকার হয়ে যায়। পরিবারকেন্দ্রিক ঘরোয়া জীবনের ছন্দ কেটে গিয়ে তা মহাজীবনে বিলীন হয়ে যায়। বাঙালি জাতির জীবনে একাত্তরের মার্চ মাস তেমনই একটা সময় ছিলো।
কূলপ্লাবী সেই জনবিস্ফোরণে আমারও ঘরে থাকার উপায় ছিলোনা। পাঁচরিয়া দীঘির পাড় ও ছালেহ-নূর কলেজকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পটিয়ায় যে সংগ্রাম, অসহযোগ আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিলো, সেই আন্দোলন-সংগ্রামের ঘনীভূত আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে আমিও ভেসে গিয়েছিলাম। মিটিং-মিছিল, আড্ডায়-আলোচনায়, জনরব-কলরবে জীবন খুঁজে পেত প্রাণস্পন্দন, মহাজীবনের স্ফূর্তির মাঝে আশ্রিত হয়ে ব্যক্তি জীবনের উদ্ভাস মিলে মিশে যেত। ঢাকা থেকে, চট্টগ্রাম শহর থেকে এক একটি খবর আসে, উত্তেজনার পারদ চড়তে যাকে; ফুঁসে উঠে জনতা। পাঁচরিয়া দীঘি থেকে কখনো পটিয়া, কখনো নিমতল, মনসার টেক, কখনো চরকানাই ফুলতলে ছুটে ছুটে যায়। অদৃশ্য শত্র“র উদ্দেশে লাঠি উঁচিয়ে সগর্জনে ধেয়ে যায়। বন্দর থেকে পাকিস্তানি অস্ত্র বোঝাই সোয়াত জাহাজ অবরোধের খবর আসে, ছুটে যাই শহর পানে। চরকানাইর আবদুল হক, নুরুল আমিন, মোহাম্মদ রফিক, রফিকুল আলম চৌধুরী, মফিজুর রহমান, নুরুল আনোয়ার, শীলব্রত বড়–য়া, মোহাম্মদ সৈয়দ, মোহাম্মদ মহসিন, মোহাম্মদ ইসহাক ও হাশেম; মনসার আবু তৈয়ব, নুরুল ইসলাম, মো. ইব্রাহিম, মো. ইউসুফ, সিরাজুল হক, আবুল কাশেম, নাজিমুল হক, আলীনুর ও আহমদ নুর; জিরির আবু তাহের বাঙালি, এমদাদুল হক, ফজলুল হক ও মো. ইউসুফ; ভেল্লাপাড়ার মোজাম্মেল হক, থানামহিরার এখলাস, মোহাম্মদ নগরের এজহারুল হক, সাততথৈয়ার নাজিমুদ্দিন, গোরনখাইনের নুরুল আলম ও জুলফিকার হায়দার, নাইখাইনের নুরুল আফসার, আর্যমিত্র বড়–য়া, প্রদীপ বড়–য়া ও নুর মোহাম্মদ; অসিত বর্ধন (দ্বারক পেরপেরা), আবদুল হাকিম ও আবদুর রহিম (মোহরা), মনোজ বড়–য়া (উনাইনপুরা), হুলাইনের নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, আসলাম, রফিক আহমদ খান (দুলাল), মাহফুজুর রহমান খান, রফিক আহমদ, নুরুল আলম, আবুল কাশেম, শফিকুর রহমান চৌধুরী ও মো. রফিক; দক্ষিণ হুলাইনের নুরুল আমিন ও নুরুল আলম; হাবিলাসদ্বীপের অমর চৌধুরী, সমীরণ চৌধুরী, গৌরাঙ্গ নন্দী, মৃদুল নন্দী, স্বপন দত্ত, স্বপন চৌধুরী, নুরুল হক, ত্রিদিব দত্ত, অরুণ দত্ত, বরুণ চৌধুরী, বরুণ দত্ত, আশীষ সেন, সুধীর দাশ, পারুল, মাহবুবুর রহমান, শান্তি চৌধুরী, কাজল চৌধুরী, পাঁচরিয়ার স্বদেশ বড়–য়া, মুক্তিমান বড়–য়া ও হরিপদ, করনখাইনের অধ্যাপক শামসুল ইসলাম ও মোজাম্মেল, মুকুট নাইটের রোকেয়া আকতার মিনু, শাকপুরার স্বপন মহাজন ও স্মৃতি চৌধুরী, এয়াকুবদ-ীর মো. ইসহাক, লাখেরার লক্ষ্মী চৌধুরী, শান্তি বড়–য়া ও আবুল হোসেন, পাইরোলের মোজাহেরুল ইসলাম; পূর্ব পাঁচরিয়ার মো. ইউসুফ, মো. নুরুন্নবী ও মো. সবুর, খায়রুল বশর (কধুরখিল), আবু জহুর ও নজরুল ইসলাম (গোমদ-ী), লড়িহরার আবুল হাশেম, সাদারপাড়ার হামিদুল হক, মাহবুব, আফসার প্রমুখ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ পাঁচরিয়া ও ছালেহ-নূর কলেজ-কেন্দ্রিক স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতার সংগঠন ও আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে হুলাইন নিবাসী অ্যাডভোকেট জালালউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, নুর মোহাম্মদ চৌধুরী, মাস্টার আ জ ম নুরুল আলম, আবু সৈয়দ, ইউসুফ খান, সিদ্দিক আনোয়ার, আবুল হাশেম মাস্টার ও খোরশেদ আলম, হাবিলাসদ্বীপ নিবাসী সাধন মহাজন, ডিএল চৌধুরী, ,অশোক চৌধুরী, তমাল দাশ, চরকানাই নিবাসী কামালউদ্দিন চৌধুরী, আবু তাহের (১), আবু তাহের (২), ডা. নুরুল হাছান চৌধুরী, বিএসসি শামসুদ্দিন, নুরুল হক ফকির, ফয়েজ আহমদ, আবদুল মান্নান, মমতাজ উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতা সত্তরের নির্বাচন থেকে সক্রিয় ছিলেন।
২৩ মার্চ ছিলো পাকিস্তান দিবস। এদিনটিতে বঙ্গবন্ধু ছুটি ঘোষণা করেছিলেন। ঢাকায় ভোর পাঁচটায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ৩২ নম্বর ধানম-ির বাসভবনে নিজ হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল সবুজ পতাকা উড়িয়ে দেন। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দিনটিকে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। সেই ঘোষণা অনুযায়ী আমরা ছালেহ নূর কলেজ ও পাঁচরিয়া দিঘীর পাড়ে পতাকা উত্তোলন, সভা-মিছিলের মাধ্যমে প্রতিরোধ দিবস পালন করি। কলেজের মাঠ থেকে সন্ধ্যায় একটি মশাল মিছিল নিয়ে বোয়ালখালী থানায় গিয়ে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে দিই। কালারপোল পুলিশ ফাঁড়িতে আগেই বাংলাদেশের পতাকা উড়েছিলো, এবার বোয়ালখালী থানায় উড়লো। এর ফলে পশ্চিম পটিয়া ও বোয়ালখালী কার্যত ২৩ মার্চ স্বাধীন হয়ে যায়। বোয়ালখালী থানায় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন নাসিরুদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ আসলাম, রফিক আহমদ খাঁন, রফিক আহমদ (হুলাইন), আমিনুর রহমান, আবদুল হক, মোহাম্মদ রফিক, মফিজুর রহমান (চরকানাই), আবু তাহের বাঙালি, এমদাদ (জিরি), নুরুল আলম, জুলফিকার হায়দার (গোরনখাইন), ইউসুফ এস্কারী (বিনিনেহারা), নুরুল ইসলাম (মনসা), স্বপন চৌধুরী, নুরুল হক (হাবিলাসদ্বীপ), অসিত বর্ধন (পেরপেরা), মোহাম্মদ ইউসুফ (পূর্ব পাঁচরিয়া), আবদুল হাকিম, মহিউদ্দিন (মোহরা), মনজ বড়–য়া (উনাইনপুরা), আফসার ও আর্য মিত্র বড়–য়া (নাইখাইন)।
২৪ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আগত ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে বাঙালি শ্রমিকরা ঐ অস্ত্র খালাসে অস্বীকৃতি জানালে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বেধে যায়। শ্রমিকদের সাথে স্থানীয় ছাত্র-জনতা যোগ দিয়ে জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোর স্থানে অবরোধ সৃষ্টি করে, পথে পথে ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ ব্যুহ রচনা করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি চালালে বহু সংখ্যক মানুষ হতাহত হয়। এই ঘটনা দাবাগ্নির মতো ছড়িয়ে পড়লে চারিদিক থেকে দলে দলে মানুষ বন্দর অভিমুখে ছুটে যেতে থাকে। এই অস্ত্র খালাসের জন্য চট্টগ্রাম সেনানিবাসের দায়িত্বে থাকা বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে কৌশলে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এই সংবাদ চাউর হয়ে পড়লে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়।
এমনি এক চরম উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে, ২৪ মার্চ আমি বাড়িতে কিছু না জানিয়ে পাঁচরিয়া দিঘির পাড় হতে চট্টগ্রাম শহরে আসি। উদ্দেশ্য বন্দরে সংগ্রামী জনতার সাথে একাত্ম হয়ে সংগ্রামে অংশগ্রহণ এবং শহরের নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া। ২৪ মার্চ আমি শহরেই রাত্রিযাপন করি। তার পরদিন তো পঁচিশে মার্চ। ঢাকায় ইয়াহিয়ার সাথে বঙ্গবন্ধুর আলোচনার শেষ দিন। আলোচনার ফলাফল কি হয় তা’ জানার জন্য বাঙালি জাতির রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। ভীতিকর চাপা উত্তেজনার মধ্যে শহরময় ছুটোছুটি করে কেটে গেল দিনটি। ওদিকে ঢাকায় অপরাহ্নে ইয়াহিয়া খান গোপনে শহরে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান। আলোচনা ভেঙে দিয়ে ইয়াহিয়ার পলায়নের এই সংবাদ চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দে যখন পান তখন দিবাবসানে রাত নেমে এসেছে। তারপর মধ্যযামে বাংলাদেশে পাকিস্তানিরা মানবেতিহাসের বর্বরতম ও নৃশংসতম গণহত্যা শুরু করে। ‘বাবর’ জাহাজের অগ্নি উদগীরণ এবং প্রচ- গোলাগুলির শব্দের বিভীষিকার মধ্যে সে রাতও অতিবাহিত করি শহরে। এর মধ্যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, রাতের শেষ প্রহরে চট্টগ্রামে এই ঘোষণা মাইকে এবং সাইক্লোস্টাইল কপি করে প্রচার ও বিতরণ শুরু হয়।
২৬ মার্চ পাকিস্তানি হানার সংবাদ জানাজানি হয়ে গেলে আমার পিতা নূর মুহম্মদ চৌধুরী সাহিত্যরতœ উদ্বেগাকুল হয়ে চাচা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি নুর মোহাম্মদ চৌধুরীকে নিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। এবং ২৭ মার্চ বিকেলে স্টেশন রোডে তারা আমাকে খুঁজে বের করেন। আমি রেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে নিউ মার্কেটের দিকে যাচ্ছিলাম। তাঁরা আমাকে জোর করে চাচার গাড়িতে উঠিয়ে একেবারে হুলাইনে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যান। তারপর আমি যাতে বাড়ি থেকে বের হতে না পারি সেজন্য কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয়। আমার সমস্ত কাপড় চোপড় লুকিয়ে রাখা হয়। আমি মনে মনে পালিয়ে রাঙ্গুনীয়া যাবার সিদ্ধান্ত নিই এবং ঘর থেকে বের হবার উপায় খুঁজতে থাকি। রাঙ্গুনিয়ার ইছামতি গ্রামে ছিল আমার শিক্ষক অধ্যাপক বিপ্রদাশ বড়–য়ার বাড়ি। মার্চ মাস শেষ হয়ে যায়। এপ্রিলের এক কি দুই তারিখে আমি পালানোর একটা সুযোগ পেয়ে যাই। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমি একটা শার্ট খুঁজে পেতে সমর্থ হই এবং শার্টটি লুঙ্গির ভিতরে গুঁজে নিয়ে ওপরে একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে পুকুর পাড়ে যাওয়ার ভান করে ঘর থেকে বের হয়ে যাই। আমাদের বাড়ির সামনে জোড়া পুকুর। প্রথম পুকুর পার হয়ে আমি দ্বিতীয় পুকুরের পাড় ধরে হাঁটতে থাকি। সেই পুকুরের পশ্চিম পাড় দিয়ে উত্তর দিকে আমাদের পাড়া থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ। পাড়া পার হয়ে আমি লুঙ্গির ভিতর থেকে শার্টটা বের করে গায়ে দিই এবং জোরে জোরে হেঁটে আমাদের গ্রামের ত্রিসীমানা পেরিয়ে যাই। আমি হাবিলাসদ্বীপ গ্রাম ও সেই গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে পূর্ব-পশ্চিম বয়ে যাওয়া খাল পার হয়ে বোয়ালখালী থানায় প্রবেশ করি। আমার গন্তব্য ছিলো বোয়ালখালী থানার কানুনগোপাড়া গ্রাম। সেখানে ছিলো আমার মরিয়ম ফুফুর বাড়ি। তাঁর ছেলে আলম, হায়দারের সাথে ছিলো আমার ভীষণ ভাব। ফুফুর বাড়িতে একরাত থেকে আমি ফুফাত ভাই আলমের কাছ থেকে সাম্পান ভাড়া নিয়ে তার সাহায্যে কর্ণফুলী নদী পার হই। তাদের বাড়ির কাছেই ছিলো নদী। ইতিপূর্বে আমি কখনো রাঙ্গুনিয়া যাইনি। আলম আমাকে রাঙ্গুনিয়ার পথঘাট বাতলে দেয়। আমি নদী পার হয়ে খুঁজে খুঁজে ইছামতিতে বিপ্রদাশ স্যারের বাড়িতে পৌঁছে যাই। তিনি আমাকে দেখে অবাক হয়ে যান, আবার খুশিও হন। রাঙ্গুনিয়া তখনো মুক্ত এলাকা। বিপ্রদাশ স্যার শুধু আমার শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমার ফ্রেন্ডস গাইড ফিলোসফার। আমি আজ যা হয়েছি বা হতে সক্ষম হয়েছি, মনুষ্যত্বের তৌলে আমার এই অকিঞ্চিৎকর জীবন যদি কিঞ্চিৎ মূল্য প্রাপ্তির হকদার হয় তাহলে তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বিপ্রদাশ স্যারের।
উনসত্তরে চরকানাই হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে যখন উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হলাম নবপ্রতিষ্ঠিত হুলাইন ছালেহ নূর কলেজে; তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য øাতকোত্তর ডিগ্রিপ্রাপ্ত একদল তরতাজা যুবক তাঁদের শিক্ষকতা জীবনের নবিশি করতে এসে জুটলেন সেই কলেজে। অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিলেন শিক্ষাভিজ্ঞ প্রবীণ জেএল দে ও উপাধ্যক্ষ বিভূতি ভূষণ ভট্টাচার্য। বাংলায় অধ্যাপক বিপ্রদাশ বড়–য়া, যুক্তিবিদ্যায় অধ্যাপক আকবর আহমদ, অর্থনীতিতে অধ্যাপক আওরঙ্গজেব চৌধুরী, ইসলামের ইতিহাসে অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, পদার্থবিদ্যায় অধ্যাপক দিলীপ চৌধুরী (তাঁর পদবি সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। দিলীপ বাবু মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন), রসায়নে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। আমি যদিও মানবিকের ছাত্র ছিলাম, তথাপি সকল বিভাগের, সকল শ্রেণীর শিক্ষকের ¯েœহ ও ভালোবাসায় সিক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তবে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলাম বিপ্রদাশ স্যারের। তিনি থাকতেন পাঁচরিয়া দিঘির পশ্চিম পাড়ে তাঁর মামা অশ্বিনি মাস্টারের বাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সে বাড়িতে ছিলো আমার নিত্য যাতায়াত। অশ্বিনি বাবু কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক এবং তাঁর ছেলে মুক্তিমান বড়–য়া তখন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। ফলে বিপ্রদাশ স্যারের আগমনের পূর্ব থেকেই বাড়িটিতে প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চার মুক্ত হাওয়া বিরাজমান ছিলো। বিপ্রদাশ স্যার আসার পর যেন ষোলকলা পূর্ণ হলো। মাটির ঘরের দোতলায় স্যারের কক্ষে, যার দরজার ওপরে লেখা ছিলো সুধীন্দ্র নাথ দত্তের একটি কবিতার লাইন ‘সহে না সহে না জনতার জঘন্য মিতালী, সেই কক্ষে আশ্চর্য বিপ্রতীপে দিনের পর দিন সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, বিজ্ঞানের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কে সময় কোথা দিয়ে অধিক রাত অবধি গড়িয়ে যেতো, তা টেরই পাওয়া যেতো না। কত রঙিন, স্বপ্নের জাল বোনা সেসব দিন। কোন কোনদিন আলোচনায় যোগ দিতেন স্বদেশ বাবু, সে গ্রামেরই এক অগ্রসর মানুষ। বিপ্রদাশ স্যারের সংস্পর্শে এসে হঠাৎ আমার মনের জানালাটা খুলে গিয়েছিলো। হুলাইন গ্রামের গ-িতে বাঁধা পাঠ্যপুস্তকে ঠাসা আমার ভাবনা চিন্তার ক্ষুদ্র জগতটা হঠাৎ প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে বড় হতে শুরু করেছিলো। পুরাতন বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা, সংস্কারের পাঁচিল ভেঙে পড়তে পড়তে একদিন আমি নিজেকে নতুনরূপে আবিষ্কার করেছিলাম। মার্কস, এঙ্গেলস, হেগেল, ডারউইন, ফ্রয়েড, নীটশে, কিয়ের্কেগার্ড, টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, পুশকিন, নেরুদা, খৈয়াম, সাদী, হাফিজ, রুমী, বালজাক, মঁপাসা, চেখভ, কাফকা, হুগো, পিকাসো, মিকালেঞ্জেলো, অবনীন্দ্র নাথ ঠাকুর, নন্দলান বসু, যামিন রায়, সার্ত্রে, রাসেল, দেকার্তে, সত্যজিৎ রায়Ñ প্রভৃতি নাম ও তাঁদের সৃষ্টিকর্মের কথা তাঁর মুখেই প্রথম শুনি। য়োরোপিয় রেনেসাঁ, ফরাসী বিপ্লব, আধুনিক কবিতার কথা, গ্রিক ট্র্যাজেডির আলোচনা শুনতে শুনতে; বোদলেয়র, টিএস এলিয়ট, এজরা পাউন্ড, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, অচিন্ত্যকুমার, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সমর সেন, সুকান্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু পত্রী, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সিকান্দর আবু জাফর, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী, ফজল শাহাবুদ্দিন, বিভূতি-মানিক-তারাশঙ্কর-সমরেশ- এমনি অজস্র নাম, তাদের সাহিত্যাদর্শে গড়ে ওঠে আমার সাহিত্য রুচি। বিপ্রদাশ স্যার এ সময় আমার যে মন তৈরি করেন, সেই মন ও প্রাণের টানেই আমি মুক্তিযুদ্ধের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে অনার্সে ভর্তি হই।
তো একাত্তরের এপ্রিলের শুরুতে রাঙ্গুনিয়ার ইছামতি গ্রামে বিপ্রদাশ স্যারের বাড়িতে পৌঁছার পর গুরু-শিষ্য আলোচনায় বসে গেলাম কি করা যায় সেটা স্থির করার জন্য। আমাদের সাথে আলোচনায় যোগ দিলেন স্যারের ভগ্নিপতি বি কে বড়–য়া। তিনি সিডিএ’র কর্মকর্তা ছিলেন। স্বাধীনতার বহু বছর পরে এস্টেট অফিসার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। দেশের খ্যাতিমান ব্যান্ড সঙ্গীত তারকা পার্থ বড়–য়া তাঁর পুত্র। অনেক আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হলো আমরা রামগড় দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে যাবো। স্যারের এক প্রতিবেশি, পায়ের অসুখের জন্য যিনি খুঁড়িয়ে হাঁটতেন, তাঁর নামটা আমি মনে করতে পারছি না, তিনিও আমাদের সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু যেদিন আমার রওনা হবো, সেদিন কাপ্তাই রাস্তায় পাকিস্তানি সেনা টহল থাকায় তিনি যেতে চাইলেন না। রুগ্ন পা নিয়ে দৌড়াতে পারবেন না ভেবেই হয়তো তিনি পিছিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা পিছিয়ে যাওয়াটা সমীচীন মনে করলাম না। তাই পূর্ব নির্ধারিত দিবসেই আমরা ইছাখালী সেতুর কাছাকাছি কোনো এক জায়গা দিয়ে কাপ্তাই রাস্তা পার হয়ে পাহাড়ি পথে রামগড় অভিমুখে যাত্রা করলাম। জোরে হেঁটেও আমাদের পক্ষে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব হয়নি। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেলে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে সত্যিই পথ চলা দুষ্কর হয়ে পড়ে। এক জায়গায় পাহাড় ঢালু হয়ে নেমে একটি সমতল উপত্যকার সৃষ্টি করেছে। সেখানে দেখতে পেলাম একটি মাচায় একটি আদিবাসী পরিবারের বসবাস। আশান্বিত হয়ে উঠলাম এই ভেবে যে, সেখানে হয়তো রাতটুকু কাটানোর জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবো। কিন্তু না, আমরা যখন সেই মাচায় উঠতে যাবো, তখনই বাধাপ্রাপ্ত হলাম। মাচা ঘর থেকে দু’তিনজন নারী-পুরুষ আমাদের দিকে দা নিয়ে তেড়ে এসে বললো, কি চাই। আমরা বললাম, আমরা রামগড় যাচ্ছি, রাত হয়ে গেছে, আর তো যাওয়া যাচ্ছে না। রাতের জন্য একটু আশ্রয় চাই। জবাবে তারা যা বললো, তাতে আমরা আরো ভয় পেয়ে গেলাম। তারা বললো আমাদেরকে থাকতে দিলে বাঙালিরা তাদেরকে মেরে ফেলবে। বাঙালি মানে তারা মুসলমানদেরকে বুঝাতে চাইলো। ভালো করে তারা বাংলায় কথা বলতে পারছিলো না। যেটুকু মর্ম উদ্ধার করা গেলো, তাতে বুঝতে পারলাম, রাউজান থেকে ফজলুল কাদের চৌধুরী দলবল নিয়ে জয় বাংলার লোকদের খুঁজতে বেরিয়েছে। তারা এদিকেও আসতে পারে এবং এসে যদি জানতে পারে আমরা তোমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছি, তাহলে আমাদেরকে মেরে ফেলবে। এরপর আর কথা চলে না। তবুও তারা দয়াপরবশ হয়ে বললো, তোমরা ইচ্ছা করলে আমাদের গোয়াল ঘরে থাকতে পারো। চারটে খেতেও দিলো। খেয়ে দেয়ে আমরা গোয়াল ঘরে ঢুকলাম এবং পশুর মলমূত্রের দুর্গন্ধের মধ্যে রাত কাটাতে গিয়ে এই ভেবে মনকে সান্ত¡না দিয়েছিলাম, যাক অন্তত পৈত্রিক প্রাণটা তো রক্ষা পেলো। সকালে আবার আমাদের ক্লান্তিহীন পথ চলা আরম্ভ হলো। পথে পড়লো মানিকছড়ি, সেখানে রাজবাড়ির আতিথ্য গ্রহণ করে সন্ধ্যায় রামগড় পৌঁছলাম। সেখানে ছাত্রনেতা এসএম ইউসুফের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমার পার্শ্ববর্তী মনসা গ্রামের বাসিন্দা। তাছাড়া, তিনি আমার রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু, আমি তাঁর ভাবশিষ্য। আমি চরকানাই হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হাই এবং অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলাম। এসএম ইউসুফের সাথে পরিচিত হয়ে নবম শ্রেণী থেকে ছাত্রলীগের কর্মী হয়ে যাই। সেই এসএম ইউসুফকে রামগড় দেখতে পেয়ে আমার এমন ভাব হলো আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। তিনি আমাকে বললেন, নাসির তুমি এসে ভালই করেছ। যাও, ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এসো। আমি বললাম, ইউসুফ ভাই, আমিও মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতেই এসেছি। বেশি কথা বলার সুযোগ পেলাম না। কারণ সেদিনই একটা গ্রুপ ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে যাচ্ছিলো। ইউসুফ ভাইয়ের সুপারিশে আমি সেই গ্রুপের সদস্য হলাম। স্যারের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলাম। তিনি বললেন, যাও, তুমি অস্ত্রের সৈনিক হও, আমি শব্দসৈনিক হবো। এই বলে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিতে গেলেন। আমি অস্ত্র ও ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে গেলাম।
অতঃপর আমি আমার গ্রুপের সাথে একত্রিত হলাম। মেজর জিয়াউর রহমান সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং দিয়ে আমাদেরকে ফেনী নদীতে নামিয়ে দিলেন। নামমাত্র নদী, শুকিয়ে সেটি তখন একটি খালে পরিণত হয়েছে। আমরা হেঁটে একইসঙ্গে খাল এবং সীমান্ত পার হয়ে ভারতের মাটিতে পা রাখলাম। সেই জায়গাটার নাম সাব্রুম। সেখানে পৌঁছে শুনলাম আমার সহপাঠী আমাদের গ্রামের আসলাম, রফিক আমার আগে ট্রেনিং নেয়ার জন্য ভারতে এসেছে। তাদের কমান্ডার পটিয়া থানায় করনখাইন গ্রামের অধ্যাপক শামসুল ইসলাম। তারা ট্রেনিং শেষ করে ফিরে আসছিলো। সীমান্তে তাদের সঙ্গে দেখাও হলো। আমাদেরকে প্রথমে বগাফা নামক একটি স্থানে ট্রেনিংয়ের জন্য নেয়া হলো। সেটি ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ট্রেনিং সেন্টার। সেখানে এক সপ্তাহ কি পনের দিনের ট্রেনিং নিয়েছিলাম তা এখন মনে করতে পারছি না। শুধু মনে আছে, রাইফেল, পিস্তল/রিভলভার, গ্রেনেড, স্টেনগান, এসএলআর, এসএমজি চালনা এবং বিস্ফোরক তৈরি ও ব্যবহার শিখেছিলাম সেখানে। সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং শেষে আমাদের ৭ জনকে রেখে অন্যদেরকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। বলা হলো আমরা স্পেশাল ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছি। স্পেশাল ট্রেনিং মানে মিডিয়াম মেশিনগান ও ৩ ইঞ্চি মর্টার চালনা শেখা। ৭ জনের মধ্যে ছিলাম: আমি, শাহ আলাম (পরবর্তীকালে নেভাল কমান্ডোদের নেতৃত্ব দিয়ে নৌ অপারেশনে কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য বীর উত্তম খেতাব পান। স্বাধীনতার বেশ ক’বছর পর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। তাঁর নামে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে একটি মিলনায়তন রয়েছে), আবুল কালাম আজাদ (সীতাকু-), আবুল কাশেম চিশতি (রাঙ্গুনিয়া), মাহবুব (ঘাটফরহাদবেগ), ফখরুল ও বশির (মিরসরাই)। আমাদেরকে অম্পি নগর নামক একটি স্থানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে স্পেশাল ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে আরো পক্ষকাল ট্রেনিংয়ের পর আমাদেরকে ত্রিপুরার হরিণা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ভারতের ৬ মাইল অভ্যন্তরে এই স্থানটি ছিলো মুক্তিবাহিনীর মূল বেইজ ক্যাম্প। এখানে পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা হল এবং নতুন করে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হলো। পৌঁছার দু’একদিন পর মেজর জিয়া আমাদেরকে অপারেশনের জন্য তৈরি হতে বললেন। তিনি আমাদেরকে এক রাতে বিএসএফ-এর নালুয়া বর্ডার আউট পোস্টে নিয়ে গেলেন। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে রয়েছি আমরা। অদূরে একটি ছোট নদী দেখা যাচ্ছে, তার ওপর একটি ব্রিজ। মেজর জিয়া বললেন, ওটি শুভপুর ব্রিজ। ওই ব্রিজ ধ্বংস করতে হবে, সেজন্য রেকি করতে আসা। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে থেকে আমরা ব্রিজে কিভাবে যাবো এবং কিভাবে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে কোন্পথে ফিরে আসবো, সেসব এবং অপারেশন পরিকল্পনার খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনার পর আমরা আবার মেজর জিয়ার সাথে হরিণা ফিরে আসলাম। অজ্ঞাত কারণে সে সময় শুভপুর ব্রিজ ধ্বংসের সে পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন করা হয়নি।
এ ঘটনার দু’তিনদিন পর কর্নেল (অব.) রব হরিণা ক্যাম্পে আসলেন। তিনি তখন বাংলাদেশ বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, তিনি অফিসার পদে লোক রিক্রুট করতে এসেছেন। আমি যোগ দিতে চাইলাম। একদিন আগ্রহী প্রার্থীদের ইন্টারভিউতে ডাকা হলো। শওকত, ওয়ালি এ সময়ই কমিশনপ্রাপ্ত হয়। আমার পালা যখন আসলো, তখন কর্নেল রব জানতে চাইলেন আমার পড়াশোনা কদ্দুর। যখন বললাম আমি এইচএসসি পরীক্ষার্থী, তখন তিনি বললেন, আমরা তো ন্যূনতম এইচএসসি পাস না হলে এখন নিচ্ছি না। পরে যদি নতুন সিদ্ধান্ত হয়, তখন তোমার বিষয়টা বিবেচনা করে দেখবো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার হতে না পেরে মনে দুঃখ পেয়েছিলাম, কিন্তু তখন আমার আর কিইবা করার ছিলো।
হরিণায় আবার ইউসুফ ভাইর সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বললেন, পলিটিক্যালি মোটিভেটেড একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করা হচ্ছে। শুধু ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাই এ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বাহিনীর নাম বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ। এটিই বহুল আলোচিত মুজিব বাহিনী। ইউসুফ ভাই বললেন, নাসির, তুমি এই প্রশিক্ষণটা নিয়ে বিএলএফ সদস্য হিসেবে দেশে ফিরে যাও। তিনি আমার অভিভাবকতুল্য। তাঁর আদেশ শিরোধার্য করে এবার বিএলএফ ট্রেনিংয়ের জন্য আসামের হাফলং নামক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গেলাম। সেখানে একমাস নিই। শুনলাম উত্তর প্রদেশের দেরাদুনে তানদুয়া নামক স্থানে বিএলএফ-এর আরো একটি ট্রেনিং সেন্টার আছে। বিএলএফ-এর চার শীর্ষ কমান্ডারের মধ্যে তিনজন, শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান ও তোফায়েল আহমদ তানদুয়ায় সামরিক প্রশিক্ষণ নেন ও বিএলএফ সদস্যদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেন। একজন কমান্ডার আবদুর রাজ্জাক হাফলং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ছিলেন। আমি যখন সেখানে পৌঁছি, তখন চোখ ওঠা রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করেছিলাম।
যা-ই হোক, হাফলং থেকে ট্রেনিং নিয়ে হরিনা ফিরে আসি। এবার আমার দেশে ফেরার পালা। কর্ণফুলীর দক্ষিণাঞ্চলের পাঁচ থানা পটিয়া, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, সাতকানিয়া ও বাঁশখালী থানায় কাজ করার জন্য আমাদের ৬ জনকে নিয়ে একটি টিম গঠন করা হলো। কমান্ডার নির্বাচিত হলেন শোভনদ-ীর নুরুল আনোয়ার (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), ডেপুটি কমান্ডার নির্বাচিত হলেন আনোয়ারার ইদ্রিস আনোয়ারি (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ)। বাকি চার সদস্যের মধ্যে একজন আমি, আর তিনজনের মধ্যে একজনের নামই আমার মনে আছে। তার নাম অজিত, বাড়ি পটিয়ায় (বর্তমানে চন্দনাইশ)। অজিত স্বাধীনতার পর হাজারি গলিতে একটি দোকান খুলেছিলো। অনেক পরে, সম্ভবত নব্বইয়ের দশকে সে দু®কৃতকারিদের হাতে নিহত হয়।
ইন্ডাকশন অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের পূর্বে মনি ভাই (শেখ ফজলুল মনি) আমাদের ব্রিফিং দেন। বৈষ্ণবপুর নামক একটি স্থান দিয়ে আমরা ফেনী নদী পার হয়ে অধিকৃত বাংলাদেশে প্রবেশ করি। ফেবার পথে ফেনী নদীর আরেক রূপ দেখলাম। যাবার সময়ে দেখেছিলাম মরা নদী, এখন দেখছি ভরা নদী। ফুলে ফেঁপে ওঠা নদীর পানি দু’কুল উপচে পড়ার উপক্রম। নৌকায় পার হতে হলো। আমাদের সঙ্গে সমগ্র চট্টগ্রামের একশজনের একটি গ্রুপ ছিলো। কম্বাইন্ড গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন সম্ভবত মাদার্শার ইদ্রিস ভাই (প্রয়াত)। রাঙ্গুনিয়ার কমান্ডার নুরুল আলমের গ্রুপ (পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক) এবং আমাদের সঙ্গে দেশে প্রবেশ করে। হাটহাজারীর জামাল ভাই (এসএম জামালউদ্দিন), আফসার ভাই, হাশেম ভাই (মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও বিজয় মেলা পরিষদের সাবেক মহাসচিব আবুল হাশেম) পথিমধ্যে আমরা দু’জায়গায় পাক বাহিনীর এ্যামবুশের সম্মুখীন হই। এই খ-যুদ্ধ ছিলো আমাদের দীর্ঘ ট্রেনিংয়ের পরীক্ষা। আমরা সাফল্যের সাথে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। একটি যুদ্ধে রাঙ্গুনিয়ার আলম ভাইয়ের গ্রুপের আমিন শরিফ খুব সাহসিকতা প্রদর্শন করেছিলো। তার কাছে এলএমজি ছিলো। আমাদের একজন সহযোদ্ধা প্রাণ হারান। মনে পড়ছে ফটিকছড়ির খিরাম পাহাড়ে আমরা সাময়িক যাত্রাবিরতি করেছিলাম। অস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরকের বোঝা মাথায় বহন করে সাঁতরে হালদা নদী পার হয়েছিলাম। রাউজানেও আমরা একটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলাম। যুদ্ধের স্থান মনে নেই, স্মৃতি প্রতারণা করছে, তাই বিবরণও দিতে পারছি না। সাম্পানে কর্ণফুলী পার হয়ে বোয়ালখালীর জ্যৈষ্ঠপুরায় আবুল হোসেনের সেল্টারে একদিন যাত্রা বিরতির পর আবার বোয়ালখালী ও পটিয়ার পূর্বে উত্তরাভিমুখী প্রসারিত পাহাড়ি পথ ধরে দীর্ঘ যাত্রা। পটিয়ায় থানার শোভনদ-ী গ্রামে পৌঁছে সেই পথ চলার বিরতি। আনোয়ার আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। এসময় এমএ জাফর যোগ দিলেন আমাদের গ্রুপে। তিনি শোভনদ-ীরই বাসিন্দা, আনোয়ারের বন্ধু। জাফর স্বাধীনতার পর প্রথমে ছাত্রলীগ ও পরে পটিয়া থানা ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতা হন। তিনি এখনো আওয়ামী লীগই করেন।
শোভনদ-ী থেকে আমরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ি। ইদ্রিস আনোয়ারি চলে যান আনোয়ারায় তার বাড়িতে, আমি পশ্চিম পটিয়ায় আমার বাড়িতে, অজিত এবং অন্যরাও নিজ নিজ বাড়িতে চলে গেল।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ। রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতিতে এই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠে। সশস্ত্র যুদ্ধ হলেও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই ছিলেন এই যুদ্ধের পরিচালক, নীতিনির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক। যুদ্ধের এই রাজনৈতিক দিকটি যাতে মুক্তিযোদ্ধারা বিস্মৃত না হন, সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য আমাদেরকে ভিতরে পাঠানো হয়েছিলো। তাই যুদ্ধ করার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পলিটিক্যাল মোটিভেশনের একটি বাড়তি দায়িত্ব আমাদের কাঁধে চেপে বসেছিলো।
দক্ষিণ চট্টগ্রামে তখন দু’টি বৃহৎ গেরিলা গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধ করছিলো। একটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন করিম, আরেকটির কমান্ডার ছিলেন সার্জেন্ট আলম। দুটি গ্রুপের অধীনেই একাধিক উপ-গ্রুপ যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলো। করিম গ্রুপের গেরিলা তৎপরতা রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারায় বি¯তৃত ছিলো। ক্যাপ্টেন করিম শহরেও অপারেশন করেন। সার্জেন্ট আলম গ্রুপের গেরিলা তৎপরতা বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীতে বি¯তৃত ছিলো। পটিয়া থানার বরকলে ছিলো এই গ্রুপের প্রধান ঘাঁটি। বলা যায় শাহাজাহান ইসলামাবাদীর বাড়িকে কেন্দ্র করে বরকল, বরমা ও কানাইমাদারি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা ছিলো মুক্তাঞ্চল। সার্জেন্ট আলম ছিলেন গ্রুপের অপারেশনাল কমান্ডার। প্রধান সংগঠক তথা রাজনৈতিক কমিশনার ছিলেন শাহজাহান ইসলামাবাদী ও মুরিদুল আলম। সার্জেন আলম গ্রুপে যারা অপারেশনে কমান্ড করতেন তারা হলেন, হাবিলদার আবু, হাবিলদার হাবিব, মহসিন খান ও শহীদ সবুর।
করিম গ্রুপে কমান্ড করতেন অধ্যাপক শামসুল ইসলাম, জাকের আহমদ ও আ.হ.ম নাসিরউদ্দিন। অধ্যাপক শামসুল ইসলাম, আহমদ শরীফ মনীর, আহমদ হোসেন পোস্ট মাস্টার, ডা. শামসুল আলমকে এই গ্রুপের রাজনৈতিক কমিশনার বলা যেতে পারে।
আমি করিম ও আলম দু’গ্রুপের সাথেই যোগাযোগ রেখে কাজ করার চেষ্টা করি। তবে শেষ পর্যন্ত আলম গ্রুপের সাথেই অপারেশনে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হই। যেহেতু আমাদের বিএলএফ গ্রুপটা ভেঙে গিয়েছিলো, তাই যুদ্ধ করার জন্য সে সময় দক্ষিণ চট্টগ্রামে যুদ্ধরত কোন না কোন গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করা ছাড়া আমার উপায় ছিলো না। হাবিলদার আবুর সাথে ওষখাইনে একটি অপারেশনে যাই। সেখানে টিক্কা খান নামে খ্যাতি পাওয়া একজন কুখ্যাত শান্তিবাহিনী তথা রাজাকার কমান্ডারকে হত্যা করার জন্য আবু সেই অপারেশন চালিয়েছিলেন। আনোয়ারা থানা অপারেশন ছিলো দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের খুব বড়ো একটি অপারেশন। সার্জেন্ট আলমের অধিকনায়কত্বে অনেকগুলো গ্রুপ এই অপারেশনে অংশ নিয়েছিলো। আমি সে সময় বরকল থাকায় সে অপারেশনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম। মহসিন খানের সাথেও একটি অপারেশনে ছিলাম, কিন্তু কোথায় সেটি এখন মনে করতে পারছি না।
আনোয়ারা থানা অপারেশনের পর আমি শহরে চলে আসি। শহরে পাথরঘাটায় শামসুল আলমের বাড়িতে একটি শেল্টার ছিলো। শামসুল আলম হুলাইন গ্রামের দেলোয়ার হোসেন চৌধুরীর খালাতো ভাই। সেই সূত্রে যোগাযোগটা হয়। সেই বাসায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল হক মুশতাকের সঙ্গে আমার দেখা হয়। পরে আমি ঘাটফরহাদবেগের মাহবুবের বাসায় যাই। আমরা একসঙ্গে বগাফায় ট্রেনিং নিই, সেকথা আগেই বলেছি। মাহবুবের সঙ্গে দু’তিনটি অপারেশনে অংশ নিই। একটি অপারেশন ছিলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঈদের একদিন কি দু’দিন পূর্বে মাহবুব আর আমি অপারেশনটা করেছিলাম। শহরে পাকিস্তানি আর্মির তৎপরতা খুব বেড়ে গিয়েছিলো সে সময়। রাস্তায় রাস্তায় টহল, মোড়ে মোড়ে চেক পোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছিলো হায়েনারা। এমনি ভয়ংকর বিপদ সংকুল পরিস্থিতিতে আমরা রাজাকার শিকারে বের হই।
চন্দনপুরায় একটি দোকানে ফটিকছড়ির রাজাকারদের আড্ডা ছিলো। এই রাজাকারদের জন্য ফটিকছড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের মুভমেন্ট কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তারা শহরে একটি জায়গায় মিলিত হয়, খবর পেয়ে খতম করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অপারেশনের পরিকল্পনা ছিলো এরকম: বেবি ট্যাক্সি নিয়ে দু’জন যাবো এবং দোকানের সামনে রাস্তার অপর পাড়ে ট্যাক্সি চালু অবস্থায় রেখে আমরা নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে হামলা করবো। কথা ছিলো মাহবুব দরজা দিয়ে ঢুকে ফায়ার করবে, আমি জানালা দিয়ে স্টেন বাগিয়ে রেখে তাকে কাভার দেবো। সেই অনুযায়ী দু’জনে পজিশন নিই। মাহবুব দোকানে ঢোকার মুখে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। আমি জানালা দিয়ে দেখতে পাই রাজাকাররা তাকে ধরার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। এই দৃশ্য দেখে আমি মুহূর্ত মাত্র দেরি না করে আমার হাতে থাকা স্টেন গান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে সব কটাকে ফেলে দিয়ে দু’জনে দৌড়ে ট্যাক্সিতে উঠে শেল্টারে ফিরে আসি। আমরা জয়নগর শান্তনু’র বাসা থেকে এই অপারেশনে গিয়েছিলাম। নভেম্বরের শেষ দিকের ঘটনা এটি।
নজির আহমদ চৌধুরী রোডে আমার পিতার একটি বইয়ের দোকান ছিলো। সেই দোকানের পেছনে ছিলো জামে মসজিদের মোহাদ্দেস সাহেবের বাড়ি। আমার পিতা তাঁর ভাড়াটিয়া ছিলেন। যমুনা অয়েলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন, সমাজসেবী ও আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কমিশনার মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন এবং বর্তমানে সিজেকেএস সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আ.জ.ম. নাছিরউদ্দিন মোহাদ্দেস সাহেবের কৃতী পৌত্র। নিরাপত্তার জন্য তাঁর দেউড়ির সামনের একটি ঘরের দোতলায় আমি রাত্রিযাপন করতাম। এক রাতে ডালিম হোটেল থেকে আলবদররা এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হবার দিন পনেরো আগে সম্ভবত আমি ধরা পড়ি। আর যখন মুক্তি পাই তখন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। চারিদিকে বিজয়ের আনন্দ।
টীকা ও তথ্যনির্দেশ
১. (Gazetteer of Chittagong district (1908), L.S.S.O malley. P.76)
২. পদ্মিনীমোহন সেনগুপ্ত : দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত (বঙ্গানুবাদ), ৪ জানুয়ারি ১৯৭৫, পৃ. ৪
৩। মোনায়েম সরকার (সম্পাদক) : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ২০০৮) পৃ. ৮৩
৪। ড. মোহাম্মদ হাননান : বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ২০০৬), পৃ. ৬২-৬৩
৫। শেখ মুজিবুর রহমান : অসমাপ্ত আত্মজীবনী (ঢাকা : ইউপিএল, ২০১২) পৃ. ৩১
৬। শেখ মুজিবুর রহমান : প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮
৭। হাননানের গ্রন্থে সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের কলকাতা কেন্দ্রের জেলা নেতৃবৃন্দের একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। এতে চট্টগ্রাম জেলার নেতা হিসেবে মাহবুব আনোয়ারের নাম পাওয়া যায়। তালিকাটি নিম্নরূপ :
বরিশাল : আবদুর রহমান
খুলনা : মোহাম্মদ ইকরামুল হক
শেখ আবদুল আজিজ
যশোর : আবদুল হাই
মোশাররফ খান
রাজশাহী : আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান
মোহাম্মদ আতাউর রহমান খান
মোজাম্মেল হক
মোহাম্মদ মাহবুবুল হক
আবদুর রশীদ খান
ফরিদুপুর : শেখ মুজিবুর রহমান
বগড়–া : বি.এম. ইলিয়াস
শাহ আবদুল বারি
রংপুর : আবুল হোসেন
পাবনা : মোহাম্মদ আবদুর রফিক চৌধুরী
নদিয়া : ফকির মোহাম্মদ
মোহাম্মদ সোলায়মান খান
দিনাজপুর : মোহাম্মদ দবিরুল ইসলাম
চট্টগ্রাম : মাহবুব আনোয়ার
কলকাতা : জহীরুদ্দিন
কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের :
সহ-সভাপতি : শাহাবুদ্দীন
এবং : নূরুদ্দিন আহমেদ
সালেহ আহমদ
ঢাকা কেন্দ্রে উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন :
টাঙ্গইল : সামসুল হক
কুমিল্লা : খন্দকার মোস্তাক আহমেদ
অলি আহাদ
নোয়খালী : মোহাম্মদ তোয়াহা
নজমুল করিম
ঢাকা : কাজী মোহাম্মদ বশির
ইয়ার মোহাম্মদ
শামসুদ্দীন আহমদ
মোহাম্মদ শওকত আলী
এ. কে. আর. আহমেদ
মসিউদ্দিন আহমেদ রেজামিয়া
আসলাম আলী
আবদুল আউয়াল
তাজউদ্দীন আহমেদ
এবং কারুমদ্দিন আহামদ
Ñড. মোহাম্মদ হাননান : প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪-৬৫
৮। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৩
লেখক : সম্পাদক (মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম), প্রাবন্ধিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক।