যাঁদের সমর্থন ও সহযোগিতায় চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিলো, ডা. শামশুল আলম চৌধুরী তাঁদের একজন। তিনি ঢাকায় রোজ গার্ডেন সম্মেলনে গিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে তাঁরা এগার জন উক্ত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদেরকে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা-নেতা (ঋড়ঁহফরহম-ষবধফবৎং) বলা যেতে পারে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত রোজ গার্ডেন সম্মেলনে আওয়ামী (মুসলিম) লীগের জন্ম হয়।
ডা. শামশুল আলম চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ছিলেন। তাঁর বন্ধু রাউজানের ডা. সুলতান আহমদ কলকাতা বেকার হোস্টেলে থাকতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ডা. শামশু বেকার হোস্টেলে যেতেন। বঙ্গবন্ধুও বেকার হোস্টেলে থাকতেন। ডা. সুলতানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বন্ধুত্ব ছিলো। তাঁর আত্মজীবনীতেও বঙ্গবন্ধু ডা. সুলতানের কথা লিখেছেন। ডা. সুলতানের কাছে যাতায়াতের সূত্রে ডা. শামশুর সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো।
পাকিস্তান-উত্তর কালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধু যখন চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া করছেন, তখন বেকার হোস্টেলের সম্পর্কের সূত্রে ডা. শামশুও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ডা. সাহেব কলকাতা ইসলামিয়া কলেজেও (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) যেতেন, কারণ সেখানে তাঁর শ্যালক পড়াশোনা করতেন।
ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ও বেকার হোস্টেলের আবাসিকদের অনেকে বাংলার শীর্ষস্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, পরে যিনি নিখিল বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তাঁর কাছে যেতেন। তাঁদের কাছে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন নেতৃত্বের আইকন। সোহরাওয়ার্দী নিখিল ভারতেরও প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তো ইসলামিয়া কলেজ ও বেকার হোস্টেলের রাজনীতিতে উৎসাহী ছাত্ররা সোহরাওয়ার্দীর ভক্ত ও একান্ত অনুসারী হয়ে উঠেছিলেন। ডা. শামশুও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বের ক্যারিশমায় অভিভূত হয়ে তাঁর শিষ্যের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। তাঁর শ্যালকও সোহরাওয়ার্দীর গুণমুগ্ধ শারগিদ ছিলেন।
রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়াও ডা. শামশু আরো নানা পরিচয়ে পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর দশকের চট্টগ্রামের একান্ত বিশিষ্ট মান্য ব্যক্তিত্ব ও অভিজাত পুরুষ ছিলেন। ডাক্তারি তাঁর পেশা ছিলো, নেশা ছিলো রাজনীতি ও সমাজসেবা। ফলে পেশাগত পরিচয়ের প্রসিদ্ধি অতিক্রম করে তাঁকে বহুতর সামাজিক কর্মযজ্ঞে লিপ্ত হতে দেখা গিয়েছিলো।
ডা. শামশুল আলম চৌধুরী ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের রাউজানের উপজেলার ডাবুয়া ইউনিয়নের হাছানখিল গ্রামের হাছান চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাউজানের ইতিহাসে হাছান চৌধুরী একটি প্রসিদ্ধ নাম, তিনি যে বংশধারার প্রবর্তন করেন, উত্তরকালে সেই বংশে বহু বিখ্যাত ব্যক্তি আবির্ভূত হয়ে হাছান চৌধুরীর বংশকে গৌরবান্বিত করেছেন। তন্মধ্যে ডা. শামশুল আলম চৌধুরী ও তদীয় পুত্র আবদুস সালাম, যিনি বাঙালির একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি আদায়ের জন্য অন্যতম উদ্যোগী ও সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের প্রাক্তন ম্যানেজার দবিরউদ্দিন চৌধুরী (৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা সংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধুরীর লেখা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কবিতা কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে ছাপানোর দায়ে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছিলো) হাছান চৌধুরীর বংশের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি।
ডা. শামশুর পিতার নাম মৌলভী সালেহ আহমদ চৌধুরী। তিনি ফরংঃৎরপঃ ৎবমরংঃৎধৎ ছিলেন এবং সেই পদ থেকেই ৎবঃরৎব করেন। ব্রিটিশ-রাজের কর্মকর্তা হিসেবে গর্বিত সালেহ আহমদ সাহেব রাজপুরুষের ন্যায় চলাফেরা করতেন। তিনি একজন সৌখিন পুরুষ ছিলেন। তিনি ঘোড়ায় চড়ে গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের কর্মস্থলে যাতায়াত করতেন। ডাবুয়ায় তাঁর জমিদারি এলাকাতেই পূর্বপুরুষের ভিটাতে তিনি বসবাস করতেন। সেকালে খানদানি লোকেরা শহরে থাকা অপছন্দ করতেন। সালেহ আহমদ সাহেবও তাই গ্রামের বাড়িতেই তাঁর জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন। তবে শহরের নজির আহমদ চৌধুরী রোডে একটি জায়গা কিনে বাড়ি একটা করেছিলেন বটে; কিন্তু সে বাড়িতে তিনি তেমন একটা থাকেননি। রাত্রি যাপন করেছেন কিনা তা তাঁর অধস্তন পুরুষদের মধ্যে কারো জানা নেই। বিংশ শতাব্দীতে মুসলমান সমাজের গৌরবময় উত্থানের সাক্ষী হাছান চৌধুরীর বংশের অন্যতম এই কৃতিপুরুষটির বর্ণাঢ্য ও আকর্ষণীয় জীবনের ওপর যবনিকা নেমে আসে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে রাউজানে নিজ বাড়িতে।
ডাক্তার শামশু প্রথমে ডাবুয়া জগন্নাথ হাট প্রাইমারি স্কুলে পড়াশুনা করেন। পরে রাউজান স্কুলে পড়ালেখা করেন। তাঁর পিতার সরকারি বদলির চাকরির সূত্রে বিভিন্ন শহরে তাঁকে পড়ালেখা করতে হয়। এক পর্যায়ে তাঁর পিতা খুলনায় থাকাকালীন তিনি খুলনা জেলা স্কুলেও পড়াশুনা করেন। খুলনার সঙ্গে তাঁর জীবনের একটি বিষাদময় স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তাঁর ¯েœহময়ী মা আমেনা খাতুন চৌধুরানী ১৯৩৩ সালে তাঁদের খুলনা শহরের বাসায় ইন্তেকাল করেন। তাঁকে খুলনা শহরের মাঝে অবস্থিত টুটপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। আমেনা খাতুন চট্টগ্রামের পটিয়া থানার বড়উঠান গ্রামের আছদ আলী খান জমিদার বাড়ির জনৈক জমিদারের মেয়ে ছিলেন।
ডাক্তার শামশুর শিক্ষাজীবনের কোন রেকর্ড তাঁর সন্তানদের কাছে নাই, তবে তাঁরা ধারণা করছেন তাঁদের পিতা চট্টগ্রাম শহরের কলেজিয়েট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হন ডাক্তারি পড়ার জন্য। সেই সময় তিনি চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লায় তাঁর পৈতৃক বাড়ি ২০ নম্বর নজির আহমদ চৌধুরী রোডে থাকতেন। আবার কিছুদিন ওনাদের বাসার উল্টো দিকে ঠ. ও ঐড়ংঃবষ বা ভিক্টোরিয়া ইসলামিক হোস্টেলÑএ ছিলেন অন্য মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পড়ালেখার জন্য। সেই সময় ওখানে মেডিক্যাল ছাত্ররা আবাসিক থাকতেন। যেখানে এম ই এস স্কুল, কলেজ এবং ল’ কলেজ ছিল, সেখানে ছিল এই হোস্টেল। অনেক আগে পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে এই তিনতলা বিশাল হলুদ ইমারতে উইমেন্স কলেজ এবং নাইট কলেজও ছিল।
ডাক্তার শামশুল আলম চৌধুরীর জীবনে কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তখন কলকাতা ছিলো বৃহৎ বঙ্গের রাজধানী, এক সময় গোটা ভারতবর্ষেরও রাজধানী ছিলো। চট্টগ্রামের সামর্থ্যবান মুসলমান পরিবারের ছেলেরা উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি, সেন্ট জেভিয়ার্স ও ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যেতেন। মাদ্রাসার ছাত্ররা উচ্চ শিক্ষার জন্য হুগলী, আলীগড় ও দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে যেতেন। চট্টগ্রাম থেকে ডা. সুলতান আহমদ, মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বিএ, মাহবুব-এ-আনোয়ার কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন। ডা. সুলতান ছিলেন ডাক্তার শামশুর বন্ধু; তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ডাক্তার শামশু কলকাতায় যাতায়াত শুরু করেছিলেন। নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই, তবে তাঁর ছেলের অনুমান তিনি ডাক্তারি পড়া শেষ করে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় যান। তিনি কলকাতায় কিছুদিন চাকরি করেছিলেন বলে জানা যায়। আর যতদিন ছিলেন, রাজনীতি নিয়েই মেতে ছিলেন।
ডাক্তার শামশু ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার একজন তরুণী শিক্ষিকাকে বিয়ে করে সংসার পাতেন। কনের নাম সুরতুন্নেছা। তিনি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন মেমোরিয়াল উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে সে স্কুলেই শিক্ষকতা করছিলেন। বিয়েতে ডাক্তার শামশুর সবচেয়ে বড় ভাই রফিকুদ্দিন আহমদ চৌধুরী (প্রকাশ ডাবুয়ার নাওয়াব মিয়া চৌধুরী) বরপক্ষের যাত্রীর মধ্যে থাকার জন্য দেশে থেকে গিয়েছিলেন। এই নাওয়াব মিয়া চৌধুরী দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় ডাবুয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং পঞ্চাশ ও ষাট দশকে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার নিয়াজ মোহাম্মদ খান (সিএসপি) সেরা চেয়ারম্যান হিসেবে কৃতিত্বের জন্য তাঁকে স্বর্ণের মেডেল এবং সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন।
যাই হোক, ডা. শামশু ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ-এ (পরে এটি পিআইএ হয়; ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ-এর মালিক ছিলেন ইস্পাহানি, তখন এরকম একটা কথা চালু ছিলো যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একমাত্র সেতুবন্ধ ছিলো ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ) করে চট্টগ্রামে চলে আসেন এবং ওনার আব্বার চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লার ২০ নম্বর নজির আহমদ চৌধুরী রোডস্থ বাসার তৃতীয় তলার দক্ষিণ অংশে বসবাস শুরু করেন।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল স্কুলে পড়াকালীন সময়ে শামসুল আলম চৌধুরী রাজনীতিতে জড়িত হন। সেই সময়কার মেডিক্যাল স্কুলের ওনার খুব কাছের রাজনৈতিক বন্ধু ছিলেন হালিশহরের ডাক্তার ফজলুল আমীন (দেওয়ানহাট মোড়ে তাঁর চেম্বার ছিলো, তাঁর ছেলে ডাক্তার আফসারুল আমীন পরে আওয়ামী লীগের আমলে বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়েছিলেন, বর্তমানেও তিনি সংসদ সদস্য), ডা. নুরুল আলম (বাড়ি চিরিঙ্গা, চকরিয়া-কক্সবাজার এবং পরে চট্টগ্রামের কোন এক পাটকলে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন), ডা. আবদুল আহাদ (পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদে তাঁর বাড়ি এবং সেখানেই বাসার সামনে প্র্যাকটিস করতেন। আজাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জনাব ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেব ছিলেন তাঁর শ্বশুর), ডা. নুরুল আলম (চেম্বার হালিশহর, ঈশান মিস্ত্রির হাট; থাকতেন ঘাতফরহাদবেগ), ডা. সুলতান আহমদ (গ্রামের বাড়ি সুলতানপুর, রাউজান; তিনি শুরু থেকেই কুমিল্লা শহরে প্র্যাকটিস করতেন, তাই পরবর্তীকালে কুমিল্লার ডাক্তার সুলতান আহমদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন) এবং ডা. আবদুল মতিন (চেম্বার মোমিন রোড; বাসা পাঁচলাইশ-সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের পিতা), ডা. আফতাব আহমদ (বাড়ি কাট্টলি এবং সেখানেই প্র্যাকটিস করতেন)। এছাড়া আরও ডাক্তার বন্ধু ছাড়াও, তাঁর খুব প্রিয় এবং কাছের রাজনৈতিক বন্ধু ছিলেন, প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা জনাব এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মওলানা এ, কে, এম, আবু তাহের (বাড়ি মাদার্সা, পরে পাঁচলাইশ মোড়ে খলিল ভিলা নামে বাড়ি করেছিলেন এবং ওখানেই থাকতেন), মওলানা প্রফেসর নুরুল ইসলাম (বাড়ি সাবানঘাটা, চান্দগাঁও), আজাদী পত্রিকার সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ (বাড়ি রাউজান; ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগের জাঁদরেল প্রার্থী ফজলুল কাদের চৌধুরীকে পরাজিত করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন), মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী (পরে ইস্টার্ন ফেডারেল ইন্সুরেন্স কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার), ফারুক আহমদ (পরে নন্দনকাননে অবস্থিত মুসাফিরখানা বিল্ডিং-এর নীচ তলায় হাকিম সন্স ফার্ম এ অফিসার), কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানার আজিজুর রহমান প্রকাশ লাল আজিজ (পরে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য), ইউসুফ চৌধুরী (নিউজ ফ্রন্ট বুক স্টল, সিগনেট প্রেস এবং পরবর্তীতে দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা), চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদ আবিদরপাড়ার সুলতান আহমদ কন্ট্রাক্টর, আন্দরকিল্লা লালদিঘির মোড়ে ফার্নিচারের দোকানের মালিক কন্ট্রাক্টর মোহাম্মদ ইউনুস খান (এম এ আজিজের খালাতো ভাই; বাড়ি পাঠান্যা গোদা, চান্দগাঁও; তাঁর একটি জীপ গাড়ি ছিল), অবাঙালি হুসাইন (কালো হুসাইন, তিনি ইউনুস খানের ফার্নিচারের দোকানে থাকতেন, সোহরাওয়ার্দীর ভক্ত ছিলেন) এবং আন্দরকিল্লার ঔষধের দোকান বুলবুল স্টোর-এর মালিক ইউসুফ মিয়া (পরবর্তীকালে শিল্পপতি-সুলতানা জুট মিল ও ইউসুফ টেক্সটাইল মিলের স্বত্ত্বাধিকারী)।
ডাক্তার শামশু তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল স্কুল ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন ওনাকে বন্ধু মহলে সবাই ‘লন্ডন শামশু’ হিসেবে চিনত এবং ডাকতো। তিনি খুব স্টাইলিস্ট ছিলেন; হাল ফ্যাশনের স্যুট এবং তার সঙ্গে ম্যাচিং করা টাই পরিহিত ডা. শামশু যখন পঞ্চাশ ওয়ালা সিগারেটের টিন হেঁটে যেতেন, তখন সত্যিই সেটা একটা দেখার মত দৃশ্য হতো। এই সিগারেটের টিনগুলি ছিল ইংলিশ ‘ক্রাভেন এ, থ্রী ক্যাসেলস, ফাইভ ফিফটি ফাইভ, প্লেয়ারস নাম্বার থ্রী, ইত্যাদি।
ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে মুসলিম লীগ মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন আরম্ভ করে এবং ব্রিটিশ সরকারের ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করে। তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের মত ডাক্তার শামশুও পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে এত গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন যে, স্বাধীনতার জন্য তিনি ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের পরিকল্পনাও করেছিলেন। সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য তিনি গোপনে বার্মার আকিয়াব থেকে অস্ত্র নিয়ে এসেছিলেন তাঁর আরেক বন্ধুর সঙ্গে; এই বন্ধুটির নাম তালেব আলি (বাড়ি পাঠান্যা গোদা, চান্দগাঁও), তিনি একজন রাজমিস্ত্রি ছিলেন।
চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ডাক্তার শামশুর বন্ধু ডা. সুলতান থাকতেন কলকাতায় বেকার হোস্টেলে। যে হোস্টেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও থাকতেন। ডা. শামশু যখন ডা. সুলতানের সঙ্গে দেখা করার জন্য বেকার হোস্টেলে যেতেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতো। কারণ বঙ্গবন্ধু ডা. সুলতানের বন্ধু ছিলেন। ডা. সুলতানের সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ডাক্তার শামশুর পরিচয় এবং পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ডাক্তার শামশু ইসলামিয়া কলেজেও যেতেন, সেখানেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর দেখা সাক্ষাৎ হত। ইসলামিয়া কলেজ ও বেকার হোস্টেলের ছাত্রদের মধ্যে যারা রাজনৈতিক করতেন, অধিকাংশেরই অপরিহার্য গন্তব্যস্থল ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তাদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অগ্রগণ্য। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৪, ১৯৪৫, ১৯৪৬ সারা ভারত একজন বিচক্ষণ, সাহসী, দূরদর্শী মুসলিম নেতা পেয়েছিল, যাঁর নাম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি ১৯৪৬ সালে বৃহৎ বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে তখন মুসলমান জনতা, ছাত্র, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক, দিনমজুর সবাই তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল এবং অনেকের মত ডাক্তার শামশুও এক সময় সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সংস্পর্শে আসেন কলকাতায়। সম্ভবত সেই সময়ই রাজনৈতিক কাজের জন্য এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ব্যক্তিত্ব ও আদর্শের কারণে শেখ মুজিব, জহুর আহমদ চৌধুরী (তিনি তখন কলকাতায় খিদিরপুর ডক ইয়ার্ডে শ্রমিক রাজনীতি করতেন), ডাক্তার শামশু, ডাক্তার সুলতান, মাহবুব-এ-আনোয়ার, মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বিএ, কবির উদ্দিন আহমদ বিএ এবং আরও অনেকে, পরে যারা জাতীয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন, তারা এক ছাতার নিচে এসেছিলেন। এখানে অনেক বাঙালি বন্ধু ছাড়াও অবাঙালি বন্ধুও ছিলেন। তাঁরা সবাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সংগ্রাম করছিলেন। পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকে চট্টগ্রামের চৌধুরী এন জি মাহমুদ কামাল, এমএ গণি এবং তারিক আহমদ চৌধুরী সোহরাওয়ার্দীর প্রভাবে আওয়ামী রাজনীতিতে লিপ্ত হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনৈতিক সূত্রে তাঁর অনেক বন্ধু বান্ধব লাভ এবং ওনার তখনকার রাজনৈতিক কর্মকা-ে লিপ্ত হওয়ার সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। আর একটি কারণ পূর্বেই উল্লেখ করেছি, তাঁরা সবাই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ছিলেন। এছাড়া, কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ডাক্তার শামশুর যাতায়াতের আরেকটা কারণ ছিল সেখানে তাঁর শ্যালক কমার্সে পড়াশুনা করতেন। তিনিও সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বড় ভক্ত ছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে উপর্যুক্ত ছাত্রগণ যার যার মত করে কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা সকলে আবার পাকিস্তানি আমলের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সোহরাওয়ার্দীর প্রতি অবিচার ও তাঁকে হেনস্থা করার কারণে, সারা পাকিস্তানে তাঁর অসংখ্য ভক্ত অনুরাগীরা মুসলিম লীগ ছাড়া বিকল্প ধারার রাজনীতির কথা চিন্তা করতে শুরু করেন। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ সালে ২৩ জুন ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃতে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
পুরোনো ঢাকার টিকাটুলি কেএম দাস লেনে তৎকালীন ঢাকা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান বশির হুমায়ুনের রোজ গার্ডেন হলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ জন্ম লাভ করে। উক্ত সম্মেলনে চট্টগ্রাম থেকে ১১জন রাজনীতিক অংশ গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়। ডাক্তার শামশুও তাঁদের মধ্যে ছিলেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর চট্টগ্রামে এই নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠাকল্পে এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী, মওলানা ছালে জহুর, সালারে জিলা শেখ মোজাফফর আহমদ (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), আমীর হোসেন দোভাষ, মওলানা আবু তাহের, ডাক্তার শামশুল আলম চৌধুরী, মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী, মুহাম্মদ ইউনুস খান, প্রফেসর মওলানা নুরুল ইসলাম, রিদওয়ানুল বারী, সুলতান আহমদ কন্ট্রাক্টর, ইউসুফ মিয়া, মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বিএ (আশরাফ আলী চৌধুরীর পুত্র, আশরাফ আলী চৌধুরীর নামে আশরাফ আলী রোড নামকরণ হয়েছে), ডা. আনোয়ার হোসেন, হাফেজ মোহাম্মদ শরীফ (বিশিষ্ট বিমাবিশারদ) সহ আরও অনেকে কঠোর পরিশ্র্রম করেছিলেন।
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দু’এক বছর ডাক্তার শামশুল আন্দরকিল্লা ২০ নম্বর নজির আহমদ চৌধুরী রোডস্থ বাসা সংলগ্ন চেম্বারটি আওয়ামী লীগের অঘোষিত অফিসে পরিণত হয়েছিলো। এই দোতলা ভবনটি ছিল ওনার পিতার এবং হোল্ডিং নম্বর ছিলো একই। তাঁর চেম্বারে একটি ফার্মেসি ও ডিসপেনসারি ছিলো। এই ফার্মেসিতে আওয়ামী লীগের সদস্য ছাড়াও প্রতিদিন অনেক রাজনীতিসচেতন লোক জড়ো হয়ে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় মগ্ন হয়ে থাকতেন। সারাদিন চলতো নানা তর্ক-বিতর্ক, পরিকল্পনা, গল্প। ডা. শামশু মাঝে মাঝে দিনে নিচে থেকে ডাক দিয়ে উপরে বাসায় ইশারাতে বলতেন কয় কাপ চা লাগবে নিচে ওনার বন্ধুদের জন্য। এভাবে তিনি দিনে কয়েকবার উপরে তাঁর স্ত্রীর কাছে চায়ের ফরমাশ করতেন। ওপরে চা নাস্তা সবই তাঁর স্ত্রী তৈরি করে দিতেন, কাজের ছেলে নিচে নিয়ে আসতেন অতিথিদের জন্য। ওনার চেম্বারে টেলিফোন থাকলেও তখনও উপরে ফোন ছিল না।
ডিসপেনসারিটি আওয়ামী লীগের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হত। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো, ফাইলপত্র, প্যাম্পলেট, নির্বাচনী বই-সবই ঔষধের আলমারির পেছনে একটি ছোট্ট কামরা ছিল, ওখানে রাখা হতো। আর গল্প, রাজনৈতিক আলাপ এবং অনেক সময় সিদ্ধান্তগুলো সামনের কামরার ফার্মেসীতে হতো এবং মাঝে মাঝে লোক বেশি হলে সামনের খোলা বারান্দায় চেয়ার পেতে আসর বসত।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মূল নেতা ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। নির্বাচনী প্রচারে ভাসানী এবং সোহরাওয়ার্দী সারা পূর্ব পাকিস্তানে সফর করে বাঙালির অধিকারের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা চালান। এক পর্যায়ে তারা চট্টগ্রামেও সফরে আসেন। চট্টগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং প্রধান সামুদ্রিক বন্দর। তৎকালীন সরকার প্রধান ও শীর্ষ কর্মকর্তারা চট্টগ্রামের কর্মকর্তাদের প্রতি এই মর্মে এক আদেশ জারি করেছিলো যে, যুক্তফ্রন্টের নেতাদের কোন হোটেল বা সরকারি বা বেসরকারি গেস্ট হাউসে থাকতে দেয়া যাবে না। তখন ডাক্তার শামশু তাঁর চট্টগ্রামের ২০ নং নজির আহমেদ চৌধুরী রোডের বাসভবনে নেতৃবৃন্দের থাকার জন্য স্থান দেন। ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে ডাক্তার শামশু নিজ বাসায় আপ্যায়ন করেন ওনার স্ত্রীর হাতের রান্না দিয়ে এবং তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করলেন সংলগ্ন ১৯নং নজির আহমেদ চৌধুরী রোডের ওনার বড় বোন নুরজাহান বেগমের বাসায় (নুরজাহান বেগম ছিলেন ফটিকছড়ি নিবাসী রেঙ্গুনের ব্যবসায়ি আবদুল বারী চৌধুরীর বড় ছেলের স্ত্রী। এই আবদুল বারী চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম পথিকৃৎ শিল্পপতি একে খানের শ্বশুর। এ কে খানের সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করেছিলেন তিনি রেঙ্গুনে এবং পানির জাহাজে করে চট্টগ্রাম থেকে বরযাত্রীদের নিয়ে গিয়েছিলেন। আবদুল বারী চৌধুরী বেঙ্গল বার্মা স্টিমশিপ নামে একটি জাহাজ দিয়েছিলেন, যেটি আকিয়াব-চট্টগ্রাম জলপথে চলাচল করতো)। এই সময় ঢাকা থেকে আরও অনেকে এসেছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও ছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু ডা. শামশু বা তাঁর বোনের বাসায় ছিলেন কি না সেটা তাঁর ছেলে সালাম সাহেব, যাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই লেখা তৈরি করা হয়েছে, তিনি তা মনে করতে পারলেন না। বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন এটা তাঁর আব্বার এবং অন্যদের কাছ থেকে শোনা। এই বাসাতেই তখন মিটিং, আলোচনা, পরিকল্পনা সব হয়েছে। কাজেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ডা. শামশুর উক্ত বাসায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ নেতারা চট্টগ্রামের নেতাদের রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন এবং ওনাদের সঙ্গে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগসহ যুক্তফ্রন্টের নেতাকর্মীগণ নির্বাচনে জয়লাভের ক্ষেত্রে মূল্যবান ভূমিকা রেখেছিলেন।
আওয়ামী লীগের দাপ্তরিক কাজের জন্য ডা. শামশুর ফোন ব্যবহৃত হত। ফোন নম্বর ছিলো ৩৭৩৬। এটিই ছিল তখন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের ফোন এবং এর বিল পরিশোধ করতেন ডা. শামশু। পরে আওয়ামী লীগের নিজস্ব অফিস হয়ে যায় আন্দরকিল্লার এ আর রহমান আর্মস কোম্পানি (বন্দুকের দোকান) এবং বাটা সু’র (জুতার দোকান) দোকানের উপর তলায়।
চট্টগ্রাম শহরে এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মওলানা এ কে এম আবু তাহের, প্রফেসর মওলানা নুরুল ইসলাম, মওলানা ছালে জহুর, মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী, প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ, ইউসুফ মিয়া, মুহাম্মদ ইউনুস খান, সুলতান আহমদ কন্ট্রাক্টর, মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বিএ, কবির উদ্দিন আহমদ বিএ (পাথরঘাটা বান্ডেল রোড নিবাসী, তিনি বাঁশখালীর জমিদার এমতাজউদ্দিন আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে যৌথ মালিকানায় স্টেশন রোডের বর্তমান বিআরটিসি মার্কেটের পূর্বপাশে ‘ওয়ালেস হোটেল’ নামে একটি হোটেল পরিচালনা করতেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব চট্টগ্রাম আসলে সেই হোটেলে থাকতেন), ফারুক, এম এ কাদের (তিনি প্রথমে লয়েডস ব্যাংক (গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক), পরে ইউনাইটেড ব্যাংক এবং সর্বশেষ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে তাঁকে দোস্ত বিল্ডিংস্থ ব্যাংকের অফিস থেকেই পাকিস্তানি মিলিটারিরা ধরে নিয়ে মেরে গুম করে ফেলে), ংয়ঁধফৎড়হ ষবধফবৎ সালেহ আহমদ চৌধুরী (যিনি পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও গবেষক ডক্টর এনামুল হকের কন্যা অধ্যাপিকা সালমা চৌধুরীর সঙ্গে ঢাকায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন), চৌধুরী এন জি মাহমুদ কামাল, এমএ গণি, তারিক আহমদ চৌধুরী, নজু সওদাগর (বাড়ি চৈতন্য গলি, এনায়েত বাজার এবং একসময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এর উল্টো দিকে লোটাস সিনেমার মালিক; পরে তিনি হালিশহরের পীর সাহেব হজরত হাফেজ মনিরুদ্দিন রহতুল্লাহ-এর বায়াত গ্রহণ করার পর তা বিক্রি করে দেন; যেটা পরে নিরালা সিনেমা নাম হয় এবং আরো পরে রঙ্গম সিনেমা নামে পরিচিত হয়) সহ ডা. শামশু তাঁর ডা. বন্ধুদের নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা এবং সম্প্রসারণে বিরাট ভূমিকা রাখেন।
ডা. শামশু তাঁর ছেলে আবদুস সালামকে হাইস্কুলে পড়ার সময় তার কাছে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন-এর ইতিহাস মুখে বর্ণনা করতেন; পূর্ণেন্দু দস্তিদারের লেখা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বীর চট্টলার যুবকদের নাম বলতেন এবং তাঁদের নেতা মাস্টারদা সূর্য সেনের কথা প্রায় উল্লেখ করতেন। পাকিস্তান আমলে পুলিশ লাইনের সামনে দিয়ে রিকশাতে করে যাবার সময় দামপাড়ায় অবস্থিত অস্ত্রাগারের প্রতি হাত দিয়ে দিক নির্দেশ করে দেখাতেন যে এটাই ছিল অস্ত্রাগার এবং এটি লুট করা হয়েছিল; পরে খুব বেশি দূরে নয়, জালালাবাদের পাহাড়ে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল, চট্টগ্রামের যুবকদের এসব বীরত্বপূর্ণ কাহিনী তিনি খুব গর্বভরে বর্ণনা করতেন তাঁর ছেলের কাছে। পাহাড়তলীতে তৎকালীন ইউরোপিয়ান ক্লাব এর সামনে দিয়ে যাবার সময় বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদারের কথা বলতেন, সেই ক্লাবটাও দেখিয়েছিলেন ছেলেকে।
চট্টগ্রাম ভাষা আন্দোলনের একজন শীর্ষস্থানীয় সংগঠক ছিলেন ডা. শামসুল আলম চৌধুরী। ১৯৫২ সালের ৪ জানুয়ারি আন্দরকিল্লা আওয়ামী লীগ অফিসে সবর্দলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনকালে ডা. শামশু সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সভা, মিছিল ইত্যাদি যত রকমের কাজ হয়েছে, সমস্ত কিছুর সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর জন্য যেটা সুবিধা হয়েছিলো সেটা হচ্ছে আন্দোলনের কেন্দ্র আন্দরকিল্লা, লালদিঘির খুব কাছেই ছিলো তাঁর বাসা। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ডাক্তার শামশু লালদিঘি ময়দানে বক্তৃতাও করেছেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা ছিল ডাক্তার শামশুর এবং তাঁকে পাক-ভারত উপমহাদেশের এক নম্বরের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলে মনে করতেন তিনি। সোহরাওয়ার্দীকে তিনি বলতেন ইন্টেলেকচুয়াল জাইয়ান্ট (ওহঃবষষবপঃঁধষ মরধহঃ); বলতেন বর্ণ এরিস্টক্র্যাট (নড়ৎহ ধৎরংঃড়পৎধঃ) অর্থাৎ জন্মগতভাবে ঐতিহ্যবাহী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে সবচেয়ে বড় হাত এই বিরাট নেতার। ডাক্তার শামশুদের মত লোকেরা যারা তখন কলকাতায় ছিলেন, তাঁরা খুব কাছে থেকে দেখেছেন এই নেতার বিশাল, আকাশচুম্বি ব্যক্তিত্ব, মানুষের উপর তাঁর জাদুকরী প্রভাব এবং পুরো বাংলার ভোট ১৯৪৬ সালে পাকিস্তানের পক্ষে আনার জন্য যে বিশাল ভূমিকা তিনি পালন করেছিলেন, সেকথা গর্বের সাথে উল্লেখ করতেন ডাক্তার শামশু।
১৯৫৭ সালে একটি অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনার মুখোমুখি হন তিনি। সে বছর তাঁর প্রিয় স্ত্রী মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের ফলে ইন্তেকাল করেন চট্টগ্রামের বাসায়। স্ত্রী মারা যাবার সময় ডা. শামসু আন্দরকিল্লায় পাহাড়ের উপর অবস্থিত চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে হাউস ফিজিশিয়ান হিসেবে চাকরিরত ছিলেন। ডাক্তার কে.এস আলম তখন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ছিলেন। অনেক চেষ্টা করেও তাঁর স্ত্রীকে বাঁচানো যায়নি। তাঁর সন্তানরা খুব ছোট, তাই পরে আবার তাঁকে বিয়ে করতে হয়। যিনি বাচ্চাদের মা হয়ে এলেন, তিনি অত্যন্ত ¯েœহময়ী মা ও দায়িত্বশীল স্ত্রী প্রমাণিত হন।
১৯৫৮ সালে এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জেনারেল আয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে গণতন্ত্র হত্যা করে চালু করেন ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্র’ বা ‘ইধংরপ উবসড়পৎধপু’.। এছাড়া তিনি নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য নিজে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করেন যার নাম দেন ‘কনভেনশন মুসলিম লীগ’। এটার প্রেসিডেন্ট হলেন তিনি নিজে; দেশে আরো একটি মুসলিম লীগ দল ছিল যার নাম কাউন্সিল মুসলিম লীগ। অন্যান্য দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, নেজামে ইসলাম, জামাতে ইসলাম এবং আরও অন্যান্য দল ছিল।
সমস্ত বড় রাজনৈতিক নেতাদের (ঊইউঙ) দিয়ে রাজনীতি করার ক্ষমতা খর্ব করা হয়, সবকিছুতে ওনাদের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সোহরাওয়ার্দীসহ অনেক নেতাকে কারাগারে নিক্ষেপ করে আইয়ুব খান। পরে উনারা ছাড়া পেলে এই বুনিয়াদি গণতন্ত্রের বিপক্ষে সারা পাকিস্তানব্যাপী জোর প্রচারণা চালান। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের উদ্যোগে নয় নেতার একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয় এবং পরবর্তীকালে ঘধঃরড়হধষ উবসড়পৎধঃরপ ঋৎড়হঃ (ঘ.উ.ঋ.) বা এনডিএফ নামে একটি জোট গঠন করা হয়। এনডিএফ নেতৃবৃন্দ আইয়ুবের বিরুদ্ধে জোর করে গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে নিজে ক্ষমতা কুক্ষীগত করায় তার বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য প্রায় প্রতি শহরে জনসভা করেন। পাকিস্তানের আনাচে কানাচে তাঁরা ঘুরে বেড়ান।
এরই এক পর্যায়ে চট্টগ্রামেও আসেন উপর্যুক্ত নেতৃবৃন্দ। চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে এননিএফ-এর উদ্যোগে ১৯৬৩ সালে বিশাল জনসভার আয়োজন করা হয়। শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আমীর হোসেন দোভাষের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। আর বক্তৃতা করেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী। ঢাকা থেকে আসা নেতৃবৃন্দের মধ্যে আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, শেখ মুজিবুর রহমান, আবু হোসেন সরকার, আওয়ামী লীগের বেগম রোকেয়া বক্তৃতা করেন। মাগরিবের নামাজের আগে বক্তৃতা শুরু করে নামাজের বিরতির পরে পুনরায় সোহরাওয়ার্দী সাহেব প্রায় দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা দেন প্রায় তিন লাখ মানুষের সামনে বুনিয়াদি গণতন্ত্রের বিপক্ষে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। এই বক্তৃতা মঞ্চ ছিল বেশ বড় এবং মঞ্চের চারিপাশে বাঁশের ঘেরা দেয়া স্থান ছিল যেখানে চট্টগ্রামের নেতারা বসেছিলেন। সেখানে ডাক্তার শামশু, আজাদী পত্রিকার অধ্যাপক খালেদ, মওলানা এ কে এম আবু তাহের, সুলতান আহমদ কন্ট্রাক্টর, প্রফেসর মওলানা নুরুল ইসলামসহ আর অনেকে ছিলেন। ডাক্তার শামশু তাঁর বড় এবং মেজ ছেলেকে, অর্থাৎ লেখক ও তাঁর ছোট ভাইকে অনেক আগে থেকে বলে রেখেছিলেন যে তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দী চট্টগ্রামে আসলে তিনি দেখাতে নিয়ে যাবেন। কথামত তিনি বক্তৃতা মঞ্চে আগে থেকে তাঁর দুই ছেলেকে বসিয়ে নিজে পাশে নিচে চেয়ারে গিয়ে বসেছিলেন। পরে নেতৃবৃন্দ আসলে মঞ্চ ভরে যায়।
সেই রাতেই, হয়তো তার পরদিন, সুলতান কন্ট্রাক্টরের আগ্রাবাদ আবিদরপাড়ার বাড়িতে সোহরাওয়ার্দীর সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীসহ শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ গিয়েছিলেন। ডাক্তার শামশু তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে ঐ ভোজসভায় যোগ দিয়েছিলেন। তখনকার উদীয়মান জাতীয় নেতা শেখ মুজিব তাঁর বড় মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পুরো পরিবার নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন । এক পর্যায়ে ডাক্তার শামশু তাঁর রাজনৈতিক বন্ধু শেখ মুজিবকে ডেকে নিয়ে আসেন। হাতে পাইপসহ তিনি আসেন এবং ডাক্তার শামশু ছেলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে পরিচয় করে দিলে তিনি হাত বাড়িয়ে তাদের সঙ্গে করমর্দন করেন এবং চুলে হাত বুলিয়ে দেন। সেখানে ডাক্তার শামশু এবং শেখ মুজিব একে অপরকে নাম ধরে সম্বোধন করেছেন। তুমি বলে ডেকেছেন একে অপরকে। তুই সম্বোধনটা ডাক্তার শামশু শুধুমাত্র ব্যবহার করতেন, এ কে এম আবু তাহের, প্রফেসর খালেদ, ইউসুফ মিয়া, ডাক্তার নুরুল আলম (চিরিঙ্গা), ডাক্তার সুলতান, ডাক্তার নুরুল আলম (ঘাটফরহাদবেগ), মুহাম্মদ ফারুক, মুহাম্মদ ইউনুস খান, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট কাদের, হালিশহরের এম এ আজিজ এবং জহুর আহমদ চৌধুরীর (দু’জনই কেন্দ্রিয় নেতা এবং জহুর আহমদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় শ্রম, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ছিলেন। প্রসঙ্গত এম এ আজিজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে মারা যান) সঙ্গে। উল্লেখ্য চট্টগ্রামের এই বন্ধুদের একেবারে তাঁর ঘরের ভিতরে যাতায়াত ছিল।
এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দী সাহেব অসুস্থ হয়ে বিদেশে গেলেন এবং লেবাননের রাজধানী বৈরুতে একটি হোটেলে ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩ সালে হঠাৎ করে মারা যান। তাঁকে ঢাকাতে এনে দাফন করা হয়। ঢাকায় তিন নেতার মাজার এর একটি তাঁর মাজার।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দল মিলে একটি সম্মিলিত বিরোধী দলীয় জোট ‘কপ’ (ঈঙচ; ঈড়সনরহবফ ঙঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ চধৎঃু) গঠন করেন। আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি খান), নেজামে ইসলাম, জামাতে ইসলামসহ আরও কিছু দল এটার অন্তর্ভুক্ত হয়। এই জোট সারা পাকিস্তানে তখনকার একমাত্র গ্রহণযোগ্য প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহকে কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রার্থী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়।
কপের বিশাল মিটিং হয়েছিল লালদীঘির ময়দানে। ময়দানের একেবারে দক্ষিণ দিক ঘেঁষে ওপরে পুলিশ অফিসে ওঠার জন্য যে পাহাড় তারই সঙ্গে লাগানো বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিলো। ফাতেমা জিন্নাহসহ সমগ্র পাকিস্তানের বড় বড় নেতারা চট্টগ্রামে এসেছিলেন। সেই সময়ে সারা পাকিস্তানে এ নির্বাচন হয়েছিল। আইয়ুব খান স্বাভাবিকভাবেই মহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহকে ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে হারিয়ে দেয় ‘আশি হাজার ফেরেশতার’ ভোটে।
গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাকল্পে কপের অন্তর্ভুক্ত দলগুলো নিজ নিজ এলাকায় তাদের ক্যান্ডিডেট দিয়েছিলো স্থানীয় নির্বাচনে। আন্দরকিল্লা, রহমতগঞ্জ এবং ঝাউতলা থেকে চট্টগ্রামের কপ নেতারা এবং বিশিষ্টজনেরা ডাক্তার শামশুকে দাঁড়াতে অনুরোধ করলে তিনি নির্বাচনে দাঁড়ান। তার প্রতিপক্ষ ছিলেন ফজল করিম, যিনি কনভেনশন মুসলিম লীগের হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বদ্বিতা করেন। চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনের মধ্যে রেয়াজুদ্দিন বাজারের মালিক এবং কাউন্সিল মুসলিম লীগের নেতা রফিউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী, এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, প্রফেসর খালেদ, প্রফেসর মওলানা নুরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী, আজিজুর রহমান (লাল আজিজ-কক্সবাজার) এবং জামাতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামী চট্টগ্রাম বিভাগ এবং চট্টগ্রাম শহরের নেতারা ডাক্তার শামশুকে ংঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ করে ইস্তেহার ছাপালেন। ইস্তেহারের নিচে সবার নাম উল্লেখ করা ছিল যে কি কারণে তাঁরা আওয়ামী লীগের নেতা এবং বর্তমানে কপের (ঈঙচ) প্রার্থী শামশু ডাক্তারকে মদদ দিচ্ছেন। এলাকাবাসির কাছে তাদের আকুল আবেদন ছিল ডা. শামশুকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার জন্য। ডাক্তার শামশুর মার্কা ছিল ‘চেয়ার’। এলাকার সমস্ত প্রগ্রেসিভ মানুষ এবং যুবক ও তরুণরা অনেক কাজ করেছিল, গভীর রাত পর্যন্ত। বাসার সামনে উঁচু বাঁশে মাইক লাগিয়ে রাতের বেলা ওনার জন্য প্রচারও হয়েছে। তারপরেও নির্বাচনে ফজল করিমের কাছে ডা. শামশু হেরে যান। ফজল করিম সাহেব ডাক্তার শামশুকে আগে থেকেই চিনতেন এবং ওনার বয়সে বড় হিসেবে শ্রদ্ধাও করতেন। পরস্পরের বাসায় আসা যাওয়াও ছিল। তিনি সেদিন বলেছিলেন “বদ্দা জিবনত বউত ইলেকশন গইরজি; কিন্তু অনর অঁয়ারে জিত্তে আঁর বউৎ কষ্ট অইয়ে”। ফজল করিম জেতার জন্য একটা কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। সেটা হলো ভোটের দিন অনেক ভোর থেকেই ফজল করিম সাহেব তাঁর শ্বশুরবাড়ি তৈলারদ্বীপ থেকে লোকজন এনে লাইনে দাঁড় করান এবং প্রশাসনও স্বাভাবিকভাবেই ওনাকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিল। তিনি এমনি ভাল মানুষ ছিলেন এবং পরে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। জনগণের কাছের এবং পছন্দের লোক ছিলেন তিনি। স্থানীয় বাসিন্দা হবার সূত্রে যতদিন বেঁচে ছিলেন ডাক্তার শামশুর সঙ্গে ফজল করিমের সুসম্পর্ক ছিল। যাতায়াত ছিল তাঁর বাসার সামনের অফিস কক্ষে।
এই সময় ডাক্তার শামশুর বন্ধু নজু মিয়া সওদাগর এনায়েত বাজার থেকে কনভেনশন মুসলিম লীগের একজন প্রার্থীর কাছে নির্বাচনে হেরে যান। তখন আইয়ুব খানের জোর করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা এবং নির্বাচনে বিজয়ের যুগ চলছিল।
১৯৬২ সালে পাকিস্তানে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক জোট ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)-এ ডাক্তার শামশু যোগ দেন ১৯৬৪ সালের দিকে। এই জোটের একটি অংশ ছিলো আওয়ামী লীগ। অবশ্য সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগকে এনডিএফ থেকে বের করে আনেন। ডাক্তার শামশু চট্টগ্রাম শহর ঘউঋ (ঘধঃরড়হধষ উবসড়পৎধঃরপ ঋৎড়হঃব) কমিটির একজন নেতা ছিলেন। তাদের মিটিংগুলো খুব সম্ভব তখনকার মুসাফিরখানা বিল্ডিং (রাইফেল ক্লাবের উল্টো দিকে; নন্দন কানন), বুলবুল নার্সারি (কে, সি, দে রোড) এবং স্টেশন রোডের রেস্ট হাউসে হত। সেখানে জহুর আহমদ চৌধুরীর ট্রেড ইউনিয়ন ও শহর আওয়ামী লীগের অফিস ছিলো। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন বেগবান করার জন্য ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত চট্টগ্রামে যতগুলো আন্দোলন বা আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়েছিলো, তাতে ডাক্তার শামশু জড়িত ছিলেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে।
ডা. শামশু কিছুদিন চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। এসময় আসকার দীঘির উত্তর পাড়ের জনাব এন এ খান, ঘাটফরহাদবেগ নিবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব বজলুর রহমান চৌধুরী, আন্দরকিল্লা ও নজির আহমদ চৌধুরী রোডের মোড়ে অবস্থিত রহমানিয়া প্রেসের মালিক জনাব রহমান, নজির আহমদ চৌধুরী রোডের ইনকাম ট্যাক্স এর উকিল জনাব মফিজুর রহমান এবং প্রিন্সিপ্যাল রেজাউল করিম চৌধুরী মসজিদ কমিটিতে ছিলেন। ডা. শামশু একজন পরামর্শক হিসেবেও জামে মসজিদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অবধি রাজনীতির বিষয়ে আলোচনার জন্য ডা. শামশু মাঝে মাঝে ঢাকায় যেতেন। চট্টগ্রাম থেকে তাঁর সঙ্গে তাঁর আরো যেসব বন্ধু ঢাকায় যেতেন তাঁরা হোটেল গ্রিনে থাকতেন। তাঁর ছেলে সালাম সাহেব জানিয়েছেন, তিনি সেখানে সুলতান কন্ট্রাক্টর, এ কে এম আবু তাহের সাহেবদের দেখেছেন হোটেলের সামনে বেতের চেয়ারে বসে থাকতে। সুলতান কন্ট্রাক্টর আওয়ামী লীগের একজন বড় আর্থিক দাতা ছিলেন সেই সময়ে।
১৯৭০ এর পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ছয় দফা সারা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির কাছে শতভাগ গ্রহণযোগ্যতা লাভে সমর্থ হয়। এতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল। বাঙালি জনগণ বুঝতে পারল যে এটা তাদের প্রাণের দাবি। এই ৬ দফাতেই তাদের মুক্তি নিহিত। তাই ১৯৬৯ এর সময়টাতেই শেখ মুজিব হয়ে যান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, দেশের মানুষ তাঁকে ভালোবেসে উপাধি দেয় ‘বঙ্গবন্ধু’।
জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য, চট্টগ্রামের রাউজান, হাটহাজারী থেকে তৎকালিন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিপক্ষে প্রফেসর খালেদকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নমিনেশন দেয়া হয়। ফজলুল কাদের প্রতিবারই নির্বাচনের সময় এলাকার হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনীতিক, সংগঠন ও ভোটারদের মাঝে সন্ত্রাস, গুম, মারধর এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে এলাকাটি নিজের কব্জায় রেখেছিলেন এবং ভোটে কারচুপির মাধ্যমে জয়লাভ করতেন। খালেদ সাহেব একটু দ্বিধা দ্বন্দ্বে ছিলেন এসব কথা ভেবে। তিনি সৎ, অমায়িক এবং ভাল লোক ছিলেন। ডাক্তার শামশু এবং আজাদী পত্রিকায় কর্মরত রাউজানের ডাবুয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বাবু সাধন কুমার ধর, রাউজানের জগন্নাথ হাট এর ডা. জাকেরিয়া চৌধুরী (মেম্বার), নুরু মিয়া মাস্টার, আজাদী পত্রিকার স্বত্ত্বাধিকারী ও প্রকাশক এম এ মালেক এবং আরও কিছু কাছের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয় মিলে ওনাকে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে দেশের জন্য প্রার্থী হতে রাজি করান। ডাক্তার শামশু সম্পর্কে খালেদ সাহেবের মামা হতেন, আবার সমবয়সীও ছিলেন। খালেদ সাহেব তাঁর এই মামুর কথার মূল্যও দিতেন। অনেক রাত অবধি আন্দরকিল্লায় অবস্থিত আজাদী পত্রিকার ছাপাখানা কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসের দোতলায় ডাক্তার শামশু চলে যেতেন খালেদ সাহেব, সাধন ধর এবং অনান্যদের সঙ্গে আসন্ন ইলেকশান নিয়ে আলোচনা করার জন্য। তিনি এবং জনাব খালেদ সিগারেট চা খুব ভালবাসতেন। খালেদ সাহেব গভীর রাতে দোতলায় বসে ওনার ডেস্কে পরের দিনের সম্পাদকীয় লিখতেন চা আর সিগারেট খেতে খেতে। এই রাতের সময়ই এসবের মাঝে ডাক্তার শামশু তাঁকে বুঝান যে খালেদ সাহেবের যে পরিচয় এবং সুনাম, তাতে তিনি জয়লাভ করবেন। ইলেকশনে জেতার কৌশল প্রণয়নের জন্য বহুদিন সন্ধ্যার পরে ডাক্তার শামশু কখনো তাঁর ড্রাইভার গফুর বা তাঁর মেজ ছেলেকে তাঁর কালো রঙের মরিস মাইনার গাড়ি নিয়ে চলে যেতেন রাউজানের ফকিরহাটে। সেখানে নিজামুদ্দিন হলে মিটিং হত অনেক নেতাকর্মীকে নিয়ে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অফিস ছিল সেখানে। সেখানে সব আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন ডা. শামশু একজন পড়ৎব সবসনবৎ হিসেবে। গভীর রাতেই আবার শহরে ফিরে এসেছেন নিজের গাড়িতে। সে সময় রাতে ফকির হাটে যাতায়াত করাটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো, বিশেষ করে অধিক রাতে যখন শহরে তারা ফিরে আসতেন তখন ঝুঁকির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যেত। কারণ ফজলুল কাদের চৌধুরীর (ফ কা চৌধুরী) বাড়ির সামনে দিয়ে তাঁদেরকে যাতায়াত করতে হতো। ফ কা চৌধুরীকে চ্যালেঞ্জ করেই অধ্যাপক খালেদ এবং তাঁর বন্ধুরা নির্বাচন করছিলেন। নির্বাচনী হাওয়াটাও ফ কা চৌধুরীর প্রতিকূলে প্রবাহিত হচ্ছিলো তা আগে ভাগেই কিছুটা টের পাওয়া যাচ্ছিলো। তবুও নোয়াখালীর সেনবাগ নিবাসী তাঁর বিশ্বস্ত ড্রাইভার আবদুল গফুর ডাক্তার শামশুকে নিয়ে রাতবিরাতে রাউজান আসা-যাওয়া করতে ভয় পাননি।
১৯৭০ এর নির্বাচনে ডাক্তার শামশু রাউজানে প্রফেসর খালেদ এর পোলিং এজেন্ট এর দায়িত্বে ছিলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফজলুল কাদের চৌধুরীকে বিরাট ব্যবধানে পরাজিত করে প্রফেসর খালেদ ইতিহাস সৃষ্টি করেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সারা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। সেই ইতিহাস সৃষ্টির ফলে বাংলাদেশ এর অভ্যুদয় সম্ভব হয়েছিল, তবে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ডাক্তার শামশু তাঁর স্ত্রী এবং সর্বকনিষ্ঠ ছেলেকে শহরের বাসায় রেখে অন্য সব ছেলেমেয়ে এবং তাঁর সবচেয়ে ছোটবোনের মেয়েদেরসহ গ্রামের বাড়ি চলে যান। ওনার গ্রামের বাড়িতে এমন কিছু বাঙালি সরকারী কর্মকর্তাকে থাকার জায়গা দিয়েছিলেন যাদের পাকিস্তান সরকার খুঁজছিল।
সেখানে অবস্থানকালে একদিন পাঞ্জাবি মিলিটারি হাজির হয় এবং তাঁকে ও তাঁর মেজ ছেলেকে ধরে নিয়ে যায় চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে। সেখানেই ছিল পাকিস্তানিদের হেড কোয়ার্টার এবং টর্চার চেম্বার। সারাদিন বসিয়ে রাখার পর বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাঁদের দু’জনকে। মাগরিবের সময় হলে তিনি ওজু করার জন্য পানি চান নামাজ পড়বেন বলে। নামাজের পর একজন যুবক পাকিস্তানি অফিসার এসে ওনাদের অবাক করে দিয়ে বলল যে তাঁরা দু’জনই বাড়ি যেতে পারেন। আল্লাহ্র অসীম রহমতে সার্কিট হাউস থেকে জীবন নিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন। আবার বাড়িতেই অবস্থান করতে থাকেন। স্বাধীনতার পর পর চট্টগ্রাম শহরে ফিরে আসেন।
ডা. শামশু এরপর আর রাজনীতিতে জড়িত হননি। তিনি তাঁর ঔষধের ব্যবসায় সময় দেন এবং ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁর দীর্ঘ সময়ের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ অক্ষুণœ ছিল, বিশেষ করে এ কে এম আবু তাহের, প্রফেসর খালেদ, দৈনিক পূর্বকোণের মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী, এনায়েত বাজার এর নজু সওদাগর, চিরিঙ্গার ডাক্তার নুরুল আলম প্রমুখের সঙ্গে। এরই মধ্যে এম এ আজিজ (যিনি সব সময় পায়জামা এবং সাদা লম্বা শার্ট পরতেন; দু’টি হাতই গুটানো অবস্থায় থাকত সবসময়) স্বাধীনতার আগেই ইন্তেকাল করেছিলেন।) স্বাধীনতার সময় বা তার কিছুকাল পরেই মারা যান ডাক্তার সুলতান, আন্দরকিল্লার মুহাম্মদ ইউনুস খান- সদা হাসি লেগে থাকত যাঁর মুখে এবং অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন কথায় কথায়Ñ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। (তিনি চেইন ধূমপায়ী ছিলেন এবং সঙ্গে পানও খেতেন)। চান্দগাঁও’র বাড়িতে প্রায়ই তাঁকে দেখতে যেতেন ডাক্তার শামশু, আফসোস করতেন এই বলে যে এই মারাত্মক রোগ কি দশা করেছে ওনার বন্ধুর। ডাক্তার ফজলুল আমীনও মারা জান। সুলতান কন্ট্রাক্টরও পরে মারা যান। দামি ক্রিম রঙের পিওর সিল্কের লম্বা শার্ট পরতেন পায়জামার সঙ্গে। আবার এই সময় সুলতানা জুট মিলের মালিক জনাব ইউসুফ আওয়ামী লীগের বড় আর্থিক সহায়তাকারি হিসেবে সামনে আসেন।
১৯৮৩, ৮৪ সালের দিকে ডাক্তার শামশু ক্রমে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়িতে অবসর জীবন যাপন শুরু করেন। ফুল এবং সবজি বাগান করান, নিজেও অংশ নিতেন বাগানের পরিচর্যায়। ফুলের বাগানের খুব বেশি সৌখিন ছিলেন তিনি। তাঁর মেজ ভাই জনাব মুজাফফর উদ্দিন আহমদ চৌধুরী (ইপিসিএস) ইন্তেকালের পর তিনি তাঁর বাবার অসিয়ত নামা অনুযায়ী গ্রামে তাঁদের পূর্বপুরুষের ওয়াক্ফ সম্পত্তি এবং শহরের ওনার পিতার সম্পত্তি মোতোয়াল্লির দায়িত্ব পালন করেন। শহরের আসলে বন্ধুদের বাসায় মাঝে মধ্যে যেতেন এবং তাঁরাও আসতেন।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রথমবার ক্ষমতায় আসলে চট্টগ্রাম আসেন। তিনি চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের জন্মলগ্নে যাঁরা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন এবং যাঁরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিলেন তাঁদের সম্মানিত করেন ক্রেস্ট দিয়ে। এই তালিকায় ডাক্তার শামশুও ছিলেন। শেখ হাসিনা নিজে এটি প্রদান করেন। কিন্তু শরীর খুব অসুস্থ থাকায় ডা. শামশু সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। ক্রেস্টটি ডাক্তার শামশুর পক্ষে তখনকার মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রহণ করেন এবং চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল অফিসে রাখেন।
ডা. শামশুল আলম চৌধুরী ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১২ জিলহজ, ১৪২৩ হিজরী ১৫ ফাল্গুন, ১৪০৮ বঙ্গাব্দে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন প্রধানত হার্ট এটাকে। চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লার এম ই এস স্কুল মাঠে এবং নিজ গ্রামের মসজিদের সামনে জানাজার পরে তাঁকে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।