ইউক্রেনের যুদ্ধ ২য় বার্ষিকীতে প্রবেশ করেছে। এ যুদ্ধ কয়েক দিনের মধ্যে শেষ হবে বলে মনে করা হয়েছিল, কিন্তু এখন এটি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি-বহুল একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অনেক বিশেষজ্ঞ ওয়াশিংটনকে ইউক্রেনে উত্তেজনা বৃদ্ধির মূল হোতা বলে মনে করেন, যার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে অনির্দিষ্টকালের জন্য যুদ্ধ জিইয়ে রাখা।
২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মার্কিন কর্মকর্তারা যখনই শান্তি আলোচনার বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে তখনই তারা এ কথা বলেছেন যে, এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারে এবং বিশ্বকে এমন একটি যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখা উচিত যা বছরের পর বছর স্থায়ী হতে পারে।
ইউক্রেন ইস্যুতে আমেরিকার প্রথম স্বার্থ বা লক্ষ্য হচ্ছে, যুদ্ধ জিইয়ে রেখে রাশিয়াকে দুর্বল করা। হোয়াইট হাউস মনে করে, এই যুদ্ধ অব্যাহত থাকার অর্থ হবে, ইউক্রেনের পক্ষ থেকে আসা সামরিক হুমকির উৎস মোকাবেলা করতে গিয়ে রাশিয়াকে তার গুরুত্বপূর্ণ সব সম্পদ ব্যয় করতে হবে। সেইসাথে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় নিরাপত্তা কাঠামোতে সমান মর্যাদা অর্জনে তার রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলো অর্জনে বেগ পেতে হবে। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে রাশিয়াকে কোণঠাসা করা।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি খাতে রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যকার সহযোগিতা ছিন্ন করতে আগ্রহী।
শীতল যুদ্ধের পর থেকে দশকের পর দশক ধরে আমেরিকা রাশিয়ার ব্যাপারে এই টার্গেট বাস্তবায়নের চেষ্টা করে আসছে। যেমনটি খ্যাতনামা সাংবাদিক সিমর হার্শ একথা ফাঁস করে দিয়েছেন যে, ‘নর্ড স্ট্রিম’ গ্যাস পাইপলাইনে বিস্ফোরণের পেছনে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ’র হাত ছিল যার মূল পরিকল্পনাকারী হচ্ছে মার্কিন সরকার। এটি রাশিয়া এবং ইউরোপের মূল অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য মার্কিন সরকারের দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের অংশ।
প্রকৃতপক্ষে, আমেরিকার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে, ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহে রাশিয়ার বিকল্প উৎস দাঁড় করানো। এছাড়া, ইউরোপীয় শিল্প কারখানাগুলোর জন্য এমন এক কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে আমেরিকান পণ্যগুলো ইউরোপীয় দেশগুলোর উৎপাদিত পণ্যকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে থাকতে পারে এবং যাতে নিজেদের শিল্পপণ্যের বাজার শক্তিশালী করতে পারে।
গত জুলাই মাসের দিকে মার্কিন গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ইউরোপীয় নাগরিকরা যখন কয়েক দশকের মধ্যে নজিরবিহীন মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন এবং নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী তখন সেই সুযোগে কিছু মার্কিন তেল কোম্পানি প্রচুর মুনাফা অর্জনের ধান্ধায় রয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, “এক্সন মোবিল” কোম্পানি ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম মাসগুলোতে ঘোষণা করেছিল, ২০২২ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে তারা ১৭৯০ কোটি ডলারের মুনাফা অর্জন করেছে যেখানে ওই একই বছরের প্রথম ৩ মাসে এই কোম্পানির মুনাফা ছিল ৫৫০ বিলিয়ন ডলার।
এ ঘোষণার কিছুদিন পর ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি এক বক্তৃতায় এই বিষয়টি উত্থাপন করে বেশিরভাগ আমেরিকান কোম্পানিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘ভোক্তাদের ক্ষতি করে বিপুল লাভের আশায় বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগ নেয়া ঠিক নয়।’
ইউক্রেন যুদ্ধ জিইয়ে রেখে আমেরিকার তৃতীয় লক্ষ্য হল, ইউরোপের সামরিক শিল্প সক্রিয় করা এবং পুনরায় সামরিকীকরণে উৎসাহিত করা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা জানে যে, শুধুমাত্র মার্কিন বাহিনী দ্বারা সামরিক কার্যক্রম পরিচালিত হলে বিশ্বে দীর্ঘমেয়াদী সামরিক সংঘাত বা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অসম্ভব। কেননা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে রয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে তাদের অর্থ-সম্পদ প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে ব্যয়ের বিরাট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব কারণে ওয়াশিংটন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সামরিক-শিল্প কারখানা আরো সক্রিয় ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে।
ইউক্রেনের যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের চতুর্থ লক্ষ্য হল, রাশিয়া, চীন ও ইরানসহ আমেরিকার বিরোধীদের মোকাবেলা করার জন্য তার ইউরোপীয় মিত্রদেরকে সংঘবদ্ধ করা।
কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতিতে ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনকে দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে আমেরিকা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এবং তারা এমন এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে পারে যেখানে আমেরিকার মোড়লিপনার আর কোনো সুযোগ থাকবে না।