বুধবার, ২০ আগস্ট, ২০২৫, ৫ ভাদ্র, ১৪৩২, ২৫ সফর, ১৪৪৭

ষাটের_দশকের_ছাত্রনেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী সিরাজুল আলম

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

কাজী সিরাজুল আলম ষাটের দশকের শেষদিকে চট্টগ্রামের একজন বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ছিলেন। ৬৯-৭০-এ তিনি ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। তাঁর বাড়ি সীতাকুÐে; তিনি সীতাকুÐে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করেন। তিনি কাজী সিরাজ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন।
কাজী সিরাজের জন্ম ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি সীতাকুÐ থানার পূর্ব সৈয়দপুর গ্রামের কাজি বাড়িতে। তাঁর পিতার নাম মরহুম কাজি ওয়াজউল্লাহ, পিতামহের নাম কাজি আতাউল হক। তিনি একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সেই সময়ের গ্র্যাজুয়েট। তাঁর পিতাও একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম আয়েশা খাতুন।
তাঁরা পাঁচ ভাই, এক বোন। কাজী সিরাজ সবার ছোট, তাঁর বড় ভাইদের নামÑকাজি নুরুল আলম অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা কাজি শামসুল আলম, বিমা কর্মকর্তা, কাজি সারফুল আলম, জেনারেল ম্যানেজার, ওয়েল গ্রæপ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সোহরাওয়ার্দী হলের জি.এস. ছিলেন, কাজী খায়রুল আলম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক, বর্তমানে সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সের জিএম, কাজী সিরাজুল আলম, বোনের নাম হোসনে আরা ফাতেমা।
কাজী সিরাজ ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে একই কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেন।
১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে কাজী সিরাজ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রæয়ারি লালদিঘি ময়দানে যে জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করেছিলেন, কাজী সিরাজ সেই জনসভা শুনতে গিয়েছিলেন এবং সেদিনই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে তাঁর রাজনীতির অনুসারী হয়ে পড়েন। সেদিন থেকেই কাজী সিরাজ আন্দরকিল্লা আওয়ামী লীগ অফিসে যাতায়াত শুরু করেন। এর আগে তিনি ‘শিখা’ সাংস্কৃতিক পরিষদের কলেজিয়েট স্কুল শাখার সভাপতি ছিলেন। এই সময়ে ছাত্রলীগের সংগঠন ‘চলন্তিকার’ও সভাপতি হন। তখন স্কুলে সরাসরি ছাত্র রাজনীতি করা যেত না, তাই ছাত্রলীগ চলন্তিকার ব্যানারে ছাত্র রাজনীতি করতো। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে কাজী সিরাজ জেলা ছাত্রলীগের কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি সীতাকুÐ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ১১ দফা আন্দোলন সংগঠিত করা, গ্রামে গ্রামে স্কুল, কলেজে ছাত্রলীগ ও সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। সীতাকুÐ ছাত্রলীগের থানা ও কলেজ কমিটি গঠন করেন। ৬৯ এর গণআন্দোলনে তিনি মূল ভূমিকা পালন করেন।
৬৯ পর্যন্ত সীতাকুÐে আওয়ামী লীগও সংগঠিত ছিলো না। আগরতলা মামলা বিরোধী আন্দোলন চলাকালে সীতাকুÐে প্রথম আওয়ামী লীগের জনসভা আয়োজন করা হয়। এম এ আজিজের প্রত্যক্ষ তত্ত¡াবধানে ঐ জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। শহর থেকে ছাত্রনেতা এস.এম ইউসু, গোলাম রব্বান সীতাকুÐে গিয়ে তাঁকে নিয়ে জনসভার প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগম জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে এম এ আজিজ বক্তৃতা করেন। কাজী সিরাজ ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে নিউক্লিয়াসের সদস্য হন। এরপর থেকে সমস্ত কাজকর্ম বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়। ৬৭ থেকে তাদের মূল লক্ষ হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীন বাংলা। সে লক্ষেই তারা ছাত্রলীগের সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। খুব গোপনে তাদের কাজ করতে হতো। মাথার নিচে ইট দিয়ে ফ্লোরে ঘুমানো, যুদ্ধের জন্য সমস্ত গ্রামের প্রশিক্ষণ তখন থেকেই চলতে থাকে। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেয়ার মতো লোক ছিলো না। জাতীয় পরিষদে মনোনয়ন পেলেন তাদের সীতাকুÐেরই কৃতী সন্তান চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের এম আর সিদ্দিকী। প্রাদেশিক পরিষদে মনোনয়নের জন্য যখন সিটি কলেজের অধ্যাপক শামসুল হকের নাম আসলো, তখন কাজী সিরাজ প্রবলভাবে বিরোধিতা করে বলেছিলেন তাঁকে নমিনেশন দেয়া ঠিক হবে না। তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন। তখন বঙ্গবন্ধু হোটেল শাহজাহানে কাজী সিরাজকে বলেছিলেন, কাকে দেব। তোর তো বয়স হয়নি, বয়স হলে তোকে দিতাম। পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যখন শামসুল হক পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, তখন সবাই তাঁর সেদিনের কথার সত্যতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ৭০-এর নির্বাচনে ছাত্রলীগের নেতারা সমগ্র জেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
৬৯-এর আন্দোলনে তাদের ¯েøাগান ছিলো ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’; ‘পিÐি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’, ‘আইয়ুব না মুজিব, মুজিব মুজিব’ ‘আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। সে সময়ের প্রতিটি মিটিং ও মিছিলে তারা সচেতনভাবে এই ¯েøাগানগুলি দিতেন। এই ¯েøøাগান দিতে গিয়ে তাদের মধ্যে থেকেও তাদের বাধার সম্মুখীন হতে হতো। কিন্তু বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মুখে এই ক্ষীণ বাধা খড়কুটোর মতো ভেসে যেত। শহরের প্রত্যেকটা মিছিলে প্রথমে, মাঝখানে এবং শেষে স্বাধীনতাপন্থীদেরই নিয়ন্ত্রণই থাকতো। রিক্সা, ট্যাক্সি, বাসে করে যাতায়াতকারী মানুষের মধ্যেও এসব উৎসাহ সঞ্চার করতো। তারা হাততালি দিয়ে তাদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে ¯েøাগানে কণ্ঠ মেলাতেন।
৬৮’র গোলাম রব্বান, এস.এম ইউসুফ, আবদুর রব, এবিএম নিজামুল হক, ফুইক্যা জাফরসহ তারা সাত-আটজন গিয়ে লালদিঘিতে গোলাম আজম ও সবুর খানের জনসভা পন্ড করে দেন। এমন পরিস্থিতিতে আকস্মিকভাবে এমএ আজিজ মৃত্যুবরণ করলে তৎকালীন রাজনীতি ও আন্দোলনের উপর সবচেয়ে বড়ো আঘাত আসে। রাত্রে ৩ টা কি ৪ টার দিকে তার বাসায় সৈয়দ নামে ছাত্রলীগের একজন কর্মী এসে খবর দিলোÑএম.এ আজিজ মারা গেছেন। তাদের উপর তা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হলো।
নির্বাচনের পর লালদিঘি মাঠে প্রথম জনসভায় এম.এ আজিজ তাঁর ভাষণে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, তারা নির্বাচনে বাংলার জনগণের ৬ দফার পক্ষে। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে রায় চেয়েছিলেন। কিন্তু জনগণ রায় দিয়েছে এক দফার পক্ষে, বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে কাছের মানুষ হারিয়ে গেল, এটা ছিল বাঙালি জাতির জন্য বিরাট ক্ষতি।
৭১ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রলীগের কর্মীরা বাংলার জনগণকে এমনভাবে সংগঠিত করেছিলেন যে, ১ মার্চ সংসদ অধিবেশন মুলতবি ঘোষণার সাথে সাথে বাঙালি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। রাস্তায় নেমে আসে সমস্ত মানুষ, স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে মিছিলে রাজপথ কম্পিত হতে থাকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য অনেকের অবদান থাকতে পারে, কিন্তু চারজন লোক মরহুম এমএ আজিজ, এ কে এম আবদুল মন্নান, খালেক চাচা, সুলতান আহমদ কুসুমপুরী, এদেরই অবদান সবচেয়ে বেশি। কারণ যখন আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য পিডিএম ও ডাক গঠিত হয়, তখন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় এই ৮ দফা পাশ করানোর চেষ্টা হয়, যেহেতু পিডিএম-এর ৮ দফার মধ্যে ৬ দফা ছিলো। এম ও আজিজই একমাত্র বুঝতে পেরেছিলেন এটি ৬ দফা বানচালের জন্য পিডিএম এর একটি ষড়যন্ত্র। তিনি বর্ধিত সভায় ৮ দফার তীব্র বিরোধিতা করে ৬ দফার পক্ষে বলিষ্ঠ যুক্তি পেশ করেন। তিনি ও দফাকে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা করেন। একাত্তরের মার্চে তারা আমবাগানে, চট্টগ্রাম কলেজের আশেপাশে, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ভিতরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। মাদারবাড়ি, রাইফেল ক্লাব এবং আন্দরকিল্লা বন্দুকের দোকান লুট করে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। অসহযোগ আন্দোলনের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন।
২৪ মার্চ রাত ১০টায় এম.এ হান্নান, জাকারিয়া চৌধুরী, মোস্তফা ও কাজী সিরাজকে বললেন, আজকে রাতে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস হবে। সেনাবাহিনীর আসা-যাওয়ার পথ বন্ধ করার জন্য রাস্তায় পিডবিøউডি ক্যান্টিনের সামনে আলকাতারার ড্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করো। তারা যখন ব্যারিকেড দেয়ার জন্য সবকিছু রেডি করেছি, তখন দেখা গেল সেনাবাহিনীর একটি দল মার্চ করে ব্যারিকেড সরাতে সরাতে বারিক বিল্ডিংয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে । তারা রাস্তা থেকে সরে দূরে অবস্থান নিলেন। সেনাদল চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তারা খুব দ্রæত ইয়াহিয়া-ভুট্টো এ্যারেস্ট হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এই কথাগুলি চিৎকার করে বলতে বলতে শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করেন। জাকারিয়া সাইকেল চালাচ্ছিলো, কাজী সিরাজ পেছনে বসেছিলেন। ২৯ বা ৩০ মার্চ এস.এম জামালউদ্দিন ও কাজী সিরাজ হাটাহাজারীতে যান। সেখনে জামাল উদ্দিনের বাড়িতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রামগড় চলে যান। রামগড়ে তখন ক্যাম্প খোলা রয়েছে। এর কয়েকদিন পর তৎকালীন প্রথম সারির ছাত্রনেতাকে আর্মি কনভয় করে ৯১ বিএসএফ-এর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের এক সপ্তাহ প্রশিক্ষণের পর আবার রামগড় ফিরিয়ে আনা হয়। রামগড় থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সকল মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন গ্রামে বিভক্ত করে বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। সীতাকুÐের কোনো মুক্তিযোদ্ধা না থাকায় কাজী সিরাজ মিরসরাই প্রথম গ্রæপের সাথে প্রবেশ করেন। তাদের এই গ্রæপে ছিলেন জাফর আহমদ (সি-ইন-সি-স্পেশাল); এন.এম জাহেদী, ইঞ্জিনিয়ার ইরফানুল হক, ডা. গোফরানুল হক, প্রফেসর নুরুল আফসার, এডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, আমীর হোসেন, ফজলুল হক। তারা যখন করেরহাটে আসেন, তখন মস্তান নগরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চলে এসেছে। সন্ধ্যার দিকে ক্যাপ্টেন মতিন পিছু হাটে করেহাটে অবস্থান নেন। ঐ রাত্রে তারা পশ্চিম জোয়ারে ডা. গোফরানদের বাড়িতে অবস্থান করেন। করেরহাটের পতনের পর তারা শুভপুর ব্রিজের ছাগলনাইয়া অংশে অবস্থান নেন ইপিআর-এর সাথে। শুভপুরের পতন না হওয়া পর্যন্ত ইপিআর-এর সাথে সম্মুখ সমরে অংশ নেন। শুভপুরের পতনের পর তারা ভারতের শ্রীনগরে চলে যান। সেখানে একটি হাসপাতালের বারান্দায় বেশ কিছুদিন কাটান। দিনের বেলা হাসপাতালে, রাতের বেলা বাংলাদেশের মধুগ্রাম, জিনেরহাট প্রভৃতি এলাকায় বিচরণ করতেন। এগুলি ছাগলনাইয়া থানার সীমান্তবর্তী গ্রাম। এর মধ্যে শ্রীনগরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ঘোষ (যিনি ক্যাপ্টেন আলী নামে পরিচিত) তাদেরকে বিএসএফ ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যান। এর কয়েকদিন পর মুহুরি ব্রিজ অপারেশনে অংশ নেন। মাঝে মাঝে মিরসরাইর আলিনগরে প্রবেশ করতেন, সেখানে ওবায়দুল হক খোন্দকারের সাথে পরিচয় হয়। ওবায়দুল হক সহ শ্রীনগরে আসেন। ক্যাপ্টেন ঘোষের তত্ত¡াবধানে তারা ওবায়দুল ও ব্যারিস্টার নুরুল আফসারসহ শ্রীনগর স্কুলে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করেন। ঐ ক্যাম্পে প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য আল্লাহর নামে শপথ করতে বললে ওবায়দুল হক ও ব্যারিস্টার আফসার বাধা দেন। তারা বলেন, শপথ জনগণের নামে হবে। এ নিয়ে বাকবিতÐা সৃষ্টি হয়। ক্যাপ্টেন ঘোষ, ব্যারিস্টার আফসার ও ওবায়দুল হকের পক্ষ নিয়ে তাদেরকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শ্রীনগর ত্যাগের নির্দেশ দেন। তাদেরকে আ.স.ম আবদুর রব শ্রীনগর হৃষ্টমুখ থেকে হাইস্কুল ক্যাম্পে নিয়ে যান এবং কাজী সিরাজকে ক্যাম্পের দায়িত্ব প্রদান করেন। সেখানে ওবায়দুল্লাহ মজুমদার (ছাগলনাইয়ার এম.এন.এ) এডভোকেট বিসমিল্লাহ মিয়ার সাথে পরিচয় হয়। ক্যাম্পে কয়েকদিন অবস্থানের পর ওবায়দুল্লা মজুমদারের কথাবার্তা অসংলগ্ন এবং সন্দেহজনক মনে হওয়ায় উদয়পুরে অবস্থানরত খাজা আহমদের কাছে পাঠান যে, ওবায়দুল্লা মুজমদার যেকোন মুহূর্তে বর্ডার অতিক্রম করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করতে পারে। বড় ভাই হৃষ্টপুল থেকে কাজী সিরাজকে আবার তেপানিয়া বিএলএফ ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যান। সেখান থেকে আগরতলা শ্রীধর ভিলাতে। ১নং সেক্টরের হরিণা ক্যাম্প চালু হওয়ার সাথে সাথে কাজী সিরাজ হরিণা ইয়ুথ ক্যাম্পে অফিসের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক্যাম্প চিফ ছিলেন এম.এ হান্নান। স্টুডেন্ট মোবিলাইজার ছিলেন এডভোকেট আবু মোহাম্মদ হাশেম, ডেপুটি ছিলেন এবিএম নিজামুল হক, চিফ ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন সুবেদার ওয়াজি উল্লাহ পলিটিক্যাল মোটিভেটর ছিলেন এডভোকেট আজিজুল হক চৌধুরী, এম.এ মামুন, অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ। বিভিন্ন শহীদদের নামে ব্যারাকগুলোর নামকরণ করা হয়। সার্জেন্ট জহুর ব্যারাক, হেলাল ব্যারাক ইত্যাদি। জুলাই মাসে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ ছাত্রলীগকে সেক্টর অনুযায়ী ভাগ করে কাজী সিরাজকে ছাত্রলীগের সেক্টর ইন-চার্জ করেন এবং মনু বাজারে এর অফিস স্থাপন করা হয়। এই অফিস থেকে মূলত পোস্টার, বিভিন্ন পত্রিকা, লিফলেট বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশকালে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে দেয়া হতো । হরিণা থেকে খাদেরকে বিএলএফ ট্রেনিং এর জন্য রিক্রুট করা হতো, তাদেরকে মনু বাজার ছাত্রলীগ অফিসে এনে রাখা হতো। সেখান থেকে সাবের আহমদ আসগরী নিজ দায়িত্বে তেপনিয়া ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠাতেন। জুলাই মাসের প্রথম দিকে কাজী সিরাজ সীতাকুÐ থানা এফএফ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশে প্রবেশ করেন। সীতাকুÐে তখন সুবেদার মনছুর ও নায়েক শফির নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টর একটি গ্রæপ, সমীরণ ও খুরশিদ আলমের নেতৃত্বে আর একটি গ্রæপ অপারেশনের জন্য এসেছিলো। এসব গ্রæপের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিলো না। দীর্ঘদিন অবস্থান করে সীতাকুÐের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কিভাবে ভারতে পাঠানো যায়, তার জন্য পশ্চিম সৈয়দপুরের আবদুর রউফ, ফৌজদারহাটের শ্রমিক নেতা নুর আহমদকে দায়িত্ব প্রদান করেন। তারা সুচারু রূপে তাদের দায়িত্ব পালন করেন। যার ফলে মিরসরাইয়ের মতো সীতাকুÐেও ভারত থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা (প্রায় ৬০০ জন এফএফ) আসেন। আগস্টের প্রথম দিকে ইঞ্জিনিয়ার ইউসুফ সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বে বিএলএফ-এর একটি গ্রæপ সীতাকুÐে প্রবেশ করে। ফেনী নদীর দক্ষিণাঞ্চলে ছিলেন ১নং সেক্টরে কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম, অপারেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদ, স্টাফ অফিসার ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিসি জালালউদ্দিন আহমদ। ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সকল এফএফ সদস্যে প্ল্যাটুন ফরমেশন, অস্ত্র সরবরাহ, অপারেশনের দিক নির্দেশনা ইত্যাদি সমস্ত কিছু সুলতান মাহমুদের মাধ্যমে সম্পন্ন হতো। কাজী সিরাজ সীতাকুÐের এফএফ হেডকোয়ার্টার বাকখালীতে স্থাপন করেন।
আগস্টের শেষদিকে বিপ্লবী সরকারের নেতৃবৃন্দের মধ্যে এ ধরনের একটি ধারণা জন্মায় যে, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। সেজন্যে সাইফার ট্রেনিং, অয়্যারলেস ট্রেনিং, সি-ইন-সি স্পেশাল ট্রেনিং এবং কিছু কমিশন অফিসার রিক্রুট করা হলো। ওদিকে প্রথমাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দেশে পাঠানোর সময় কাফনের কাপড় সাথে দেয়া হতো আর বলা হতো হিট অ্যান্ড ডাস্ট।
সেপ্টেম্বর থেকে বলা হলো হিট অ্যান্ড রান। সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধে কাজী সিরাজ অপারেশন কমান্ডারের নির্দেশে পুনরায় ভারতে যান। নভেম্বর পর্যন্ত হরিণা ক্যাম্পে অবস্থান করেন। এর মধ্যে সীতাকুÐে ১৫ প্লাটুনের মতো মুক্তিযোদ্ধা প্রবেশ করে। তিনি হরিণা ক্যাম্প থেকেই প্রতিটি প্লাটুনকে কাজের নির্দেশনা প্রদান করতেন। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে কাজী সিরাজ স্থায়ীভাবে তিন প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সীতাকুÐে আসেন। সীতাকুÐের তিন চতুর্থাংশ মুক্তিযোদ্ধা ১নং সৈয়দপুর, ২নং বারৈয়াঢালা, ৩নং সীতাকুÐ, ৪নং মুরাদপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। আর কিছু মুক্তিযোদ্ধা কুমিরা ইউনিয়নের অধিবাসী।
ভারতে আসা-যাওয়ার রুট : বড় মিয়াজান ঘাট, বড়বাড়িয়াঘাট, ফাজিলপুর, ছাগলনাইয়ার মধুগ্রাম হয়ে শ্রীনগর। প্রথমে সাত্তারহাট, পাত্রাকু জমায়েত হত, তারপর সেখান থেকে গাইড চিহ্নিত পয়েন্ট দিয়ে সীমান্ত পার করে দিতো। চামলাইশ্যা চারিদিকে নদী, মাঝখানে পাথর আমলিঘাট (ভারত), অলিনগর (বাংলাদেশ)
তিনটি জোন : জোন-১ মোশাররফ
জোন-২ মির্জা মনসুর-দক্ষিণ জেলা, পার্বত্য চট্টগ্রাম।
জোন-৩ ডা. মান্নান-কক্সবাজার, বান্দরবান।
হরিণায় ক্যাম্প ছিলো দুটিÑ হরিণা আর্মি ক্যাম্প, ইয়ুথ ক্যাম্প; ছাত্র প্রতিনিধি ছিলেন আবু মোহাম্মদ হাশেম।
Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

জান আলীকে নিয়ে মকবুলের কবিতা : তক দে মিয়া বকশিস দিবা আসলত্তুন হানি

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের পথিকৃৎ শিল্পপতি এ কে খানের পিতামহ জান আলী খান চৌধুরী ১৮ ও ১৯ একজন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার ও সমাজপতি ছিলেন। আঠার শতকে

বিস্তারিত »

ভালো মানুষের জন্য খারাপ সময়ে একজন ভালো মানুষের প্রস্থান

জীবন থেকে ছুটি নিলেন মোবারক ভাই। মোবারক ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে আমার মধ্য নানা রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন এটা সত্য

বিস্তারিত »

বাঁশখালীর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক সুভাষ আচার্য্য

ভারতে না গিয়ে যাঁরা গ্রামে অবস্থান করে বাঁশখালীতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুভাষ আচার্য্য অন্যতম। তিনি সুলতান উল কবির চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করতেন এবং

বিস্তারিত »

মুক্তিযুদ্ধ যাঁরা শুরু করেছিলেন তাঁরা চলে গেছেন, হারিছই আছেন একা

চট্টগ্রাম শহরে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন, তাঁরা চলে যাচ্ছেন। সাতজন ছিলেন তাঁরা, পাঁচজন ইতিমধ্যে তাঁদের প্রভুর ডাক পেয়ে এ গ্রহ ছেড়ে চলে গেছেন প্রভুর সন্নিধানে।

বিস্তারিত »

আওয়ামী লীগ, বাঙালি জাতিসত্তার নির্মাণ ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাথা

আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৩ বছরের অবিরাম সংগ্রাম এবং অবশেষে ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকেই

বিস্তারিত »

সুলতান কুসুমপুরী ও তাঁর কোম্পানি কমান্ডার হাবিলদার আবু’র মুক্তিযুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ১৩জন এমপি সম্মুখ যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারা সেনা কর্মকর্তাদের ন্যায় মুক্তিযুদ্ধে তাদের গ্রæপকে কমান্ড করেন। এই ১৩ জন এমপি

বিস্তারিত »
প্রদ্যোৎ কুমার পাল

৭১-এর দুরন্ত গেরিলা প্রদ্যোৎ কুমার পাল

প্রদ্যোৎ কুমার একজন অসম সাহসী বীরের নাম। মুক্তিযুদ্ধে এই দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা দক্ষিণ চট্টগ্রামের রণাঙ্গণ মাতিয়ে রেখেছিলেন তাঁর অসীম সাহস ও পরাক্রম দিয়ে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের চারটি

বিস্তারিত »

দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ক্যান্টনমেন্ট বরকল, শাহজাহান ইসলামাবাদী জিওসি

মুক্তিযুদ্ধের এক কিংবদন্তী শাহজাহান ইসলামাবাদী। দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের তিনিই ছিলেন প্রধান নায়ক। কিংবা এভাবেও বলা যায়, তাঁকে কেন্দ্র করেই দক্ষিণ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ গড়ে উঠেছিল। তাঁর

বিস্তারিত »