চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল স্থগিত করা হয়েছে। ৩১ জুলাই কাউন্সিলের তারিখ নির্ধারিত ছিলো। কিন্তু পূর্বদিন ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপ-নির্বাচনে ভোট গ্রহণের তারিখ ঘোষিত হওয়ায় দলের কাউন্সিল স্থগিত করা ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। এবার চতুর্থ দফা তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিলো। এর আগে আরো তিনবার সম্মেলনের তারিখ স্থির করা হয়েছিলো। কিন্তু কোন তারিখেই সম্মেলন করা সম্ভব না হওয়ায় চতুর্থবারের মত তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিলো।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিলো ২০০৬ সালে। সেই সম্মেলনে কাউন্সিলাররা শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে তাদের ওপর পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার দায়িত্ব দেন। মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী নয়া সভাপতি এবং যুগ্ম সম্পাদক কাজী ইনামুল হক দানু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন । সুদীর্ঘকাল যিনি দলের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন এবং যাঁকে ৬২ সালে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ পুনরুজ্জীবনের প্রধান উদ্যোক্তা এবং যাঁকে মনে করা হতো মহানগর আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা ও অপরিহার্য সভাপতি, সেই এম এ মান্নানকে আশ্চর্যজনকভাবে সেবার সভাপতির পদ অলংকৃত করতে দেখা গেল না। ২০০৬-এর সম্মেলনে যাঁরা সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হলেন, তাঁরা দু’জনই একে একে পরলোকগমন করলেন। প্রথমে সম্পাদক কাজী ইনামুল হক দানু চলে গেলেন ২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, তাঁকে অনুগমন করে সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীও ধরাধাম থেকে প্রস্থান করলেন ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর। দানুর মৃত্যুর পর কেন্দ্র থেকে আ.জ.ম নাছিরউদ্দিনকে সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রাণবিয়োগের পর দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাহতাবউদ্দিন চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নিয়োগ করা হয়। মাহতাব চট্টগ্রাম শহর বা নগর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সিটি কমিটির প্রথম সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ও বিশ্বস্ত সহচর এবং বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটের সদস্য জহুর আহমদ চৌধুরীর পুত্র।
মাহতাবের অগ্রজ ছাত্রলীগ নেতা সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। মাহতাব দামপাড়ায় পল্টন রোডে তাঁর পিতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবনেই থাকেন এবং তাঁর পিতার আমল থেকেই পল্টন রোডের বাড়িটি শহরের আওয়ামী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু বা তীর্থস্থান রূপে পরিগণিত। ৭১-এর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ওই বাড়ির টেলিফোনে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন। বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। চট্টগ্রাম শহরে আর কোন আওয়ামী লীগ নেতা বাড়ি পাকিস্তানি সৈন্যরা জ্বালিয়ে দিয়েছলো কিনা সেটা আমার জানা নেই। মাহতাবকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করে মহানগর আওয়ামী লীগকে তার নিজের ঠিকানায় ফিরিয়ে আনা হয়েছিলো। মাহতাব তাঁর পিতার মৃত্যুর পর থেকে পৈতৃক বাসভবনের রাজনৈতিক ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা চালান। তাঁর বাসভবন যেন মহানগর আওয়ামী লীগের অঘোষিত অফিস; মহাগরের নানা প্রান্ত থেকে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা মাহতাবের বাসভবনে ভিড় করেন। তাদেরকে নিয়ে মাহতাব বৈঠক করেন, রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা করেন, সাংগঠনিক দিক-নির্দেশনা দেন। এটা মাহতাবের প্রতিদিনের রুটিন ওয়ার্ক।
পল্টন রোড ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের আরেকটা গন্তব্য আছে, সেটা হলো স্টেডিয়ামে সিজেকেএস অফিস। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আ.জ.ম নাছির উদ্দিন সিজেকেএস-এরও নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক। সন্ধ্যার পরে নাছিরের সিজেকেএস অফিস অভ্যাগতদের ভিড়ে গমগম করে। জেলা ক্রীড়া সংস্থার রুটিন কাজগুলি সেরে নাছির রাজনীতির আলাপচারিতা, শলা-পরামর্শ, গল্প-গুজবে মেতে উঠেন। প্রতিদিন না হলেও দু’একদিন পরপর নাছির তাঁর সভাপতি মাহতাবউদ্দিন চৌধুরীর দপ্তরেও হাজিরা দেন। নগরে কমিটির সিনিয়র নেতারাও সেখানে মজুদ থাকেন। যেমন নঈমুদ্দিন চৌধুরী, সফর আলী, শেখ মাহমুদ ইসহাক, কখনো ইব্রাহিম হোসেন বাবুল, মোহাম্মদ হারিছ, বেলায়েত হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু, মানিক চৌধুরী তনয় দীপংকর চৌধুরী কাজল, শফিক আদনান, শফিকুল ইসলাম ফারুক, সৈয়দ মাহমদুুল হক, চন্দন ধর-এঁরা মাহতাবের বাসার নিয়মিত-অনিয়মিত অতিথি।
মাহতাব-নাছির ছ’বছর ধরে দল চালাচ্ছেন, বেশ ভালোভাবেই পরিচালনা করছেন রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে মাহতাব-নাছিরের নেতৃত্বে নগর আওয়ামী লীগের ৬ বছরের কর্মকাণ্ডকে যদি সফলতা-ব্যর্থতার নিক্তিতে পরিমাপ করা হয়, তাহলে সাফল্যের পাল্লাই বেশ ঝুঁকে থাকবে। এই সময়ের মধ্যে তাঁরা একটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন শতভাগ সাফল্যের সঙ্গে উতরে গেছেন। ৬ বছরে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ থেকে আওয়ামী লীগের অনেক নতুন কর্মী বেরিয়ে এসেছে। দলের এই নতুন প্রজন্ম তারুণ্যের প্রাণশক্তিতে ভরপুর। এটা মাহতাব-নাছিরের আরেকটি কৃতিত্ব।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শাখা হলেও পিতৃ বা মাতৃ সাংঠনের প্রায় সমবয়সী। রোজ গার্ডেন সম্মেলনে যোগদানকারী চট্টগ্রামের ১১ জন ডেলিগেট চট্টগ্রামে ফিরে আসার পর অবিলম্বে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ গঠন করে ফেলেন। প্রথমে জেলা, পরে শহর-দুটি কমিটিই ১৯৪৯ সালে গঠিত হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” গ্রন্থসূত্রে আমরা জানতে পারি দেশের প্রথম যে দু’একটি জেলায় আওয়ামী লীগের কমিটি গঠিত হয়েছিলো, তন্মধ্যে চট্টগ্রাম একটি; শুধু যে আওয়ামী লীগের সাংগঠীনক বিস্তৃতিতে চট্টগ্রাম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলো তা নয়, পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সমস্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিশ্বস্ত সহযোগী হয়ে উঠেছিলেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি চট্টগ্রাম থেকে ঘোষণা করেছিলেন। এবং চট্টগ্রামের কথা মাথায় রেখেই ৭১-এর ২৬ মার্চ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর বিখ্যাত ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায়। বঙ্গবন্ধু ৭১-এর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে তা’ প্রচারের জন্য চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু ও প্রবীণ জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে। তিনি যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সেই ঘোষণা প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন।
এতো গেল চট্টগ্রামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর গভীর আবেগময় সম্পর্কের বিবরণ। চট্টগ্রামে কিভাবে আওয়ামী লীগ গড়ে উঠেছিলো, সে ইতিহাসও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটির সভাপতি হন আমীর হোসেন দোভাষ এবং সাধারণ সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী। ৬২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার পর ৬৩-তে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পর তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত দোভাষী সাহেব রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং সভাপতির পদে ইস্তফা দিয়ে স্বেচ্ছা নির্বাচনে চলে যান। অতঃপর জহুর আহমদ চৌধুরীকেই সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয়। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করা হয় ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরীকে।
পঞ্চাশের দশকে চট্টগ্রাম একটি ছোট শহর। হাল্কা জনবসতি; রাস্তাঘাটও তেমন ছিলো না; চকবাজার থেকে সিরাজদ্দৌলা রোড ধরে আন্দরকিল্লা হয়ে লালদিঘি, কোতোয়ালী ঘুরে জিপিও’র সামনে দিয়ে পশ্চিম দিকে পুরাতন রেল স্টেশন এবং চুনার গুদাম হয়ে দক্ষিণে সরদঘাটÑএই হচ্ছে প্রধান পাকা রাস্তা। রাস্তায় গণপরিবহন তখনো চালু হয়নি, ব্যক্তিগত গাড়ি ছিলো যৎসামান্য; এ গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়িই ছিলো যানবাহন। লালদিঘি এবং আন্দরকিল্লা জনসমাগমের স্থান। পাহাড়- জঙ্গলে পরিপূর্ণ গাছপালার সবুজে আচ্ছাদিত এই ক্ষুদ্র ছিমছাম শহর তখনো গ্রামের মায়া কাটাতে পারেনি। এমনি এক শহরে মুক্তচিন্তার প্রগতিশীল বিরোধী রাজনীতির বীজ রোপনের কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক কাঁটা বিছানো বন্ধুর পথে যাত্রা করেছিলেন ট্রেড ইউনিয়নিস্ট রাজনীতিবিদ জহুর আহমদ চৌধুরী। চট্টগ্রামে আওয়ামী মুসলিম লীগের শাখা গঠন থেকে পঞ্চাশের দশকে নতুন দলে সামিল হয়েছিলেনÑ জহুর আহমদ চৌধুরী, আমীর হোসেন দোভাষ, মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী, ইউনুস খান, ডা. শামসুল আলম চৌধুরী, কবিরউদ্দিন আহমদ বিএ, মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বিএ, সুলতান কন্ট্রাক্টর (আবিদর পাড়া), ইউসুফ মিয়া (বুলবুল স্টোর), মওলানা নুরুল ইসলাম, এম এ গণি, চৌধুরী এন জি মাহমুদ কামাল, তারিক আহমদ চৌধুরী, বাংলাবাজারের বজল মিয়া, বালির বাপ (নুরুল ইসলাম চৌধুরী), আবুল খায়ের চৌধুরী, ছিদ্দিক আহমদ (জহুর আহমদ চৌধুরীর ঘোড়ার গাড়ি চালক ইউনিয়নের সেক্রেটারি), ছালেহ আহমদ (খড়ম ছালেহ), মোহাম্মদ ছালেহ (্এম. ইউসি আলকরণ- তারেক সোলেমান সেলিমের পিতা), ক্যাপ্টেন জানে আলম (আলকরণ), মোহাম্মদ শফি (পাথরঘাটা), ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী (এনায়েত বাজার), মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী, ডা. আনোয়ার হোসেন, ফকির মিয়া (সুফি মোশাররফ হোসেন), তোহফাতুন্নেছা আজিম, আমিনুল হক মধুর বাপ, এজাহার মিয়া (মাইক এজাহার), ছালেহ আহমদ খান (মোহরা), রিদওয়ানুল বারী, ইয়াহিয়া চৌধুরী (চান্দগাঁও), আবুল ফজল (এমইউসি-আন্দরকিল্লা), সন্তোষ বাবু (অমলেন্দু ভট্টাচার্য), নিত্য বাবু, মানিক চৌধুরী, বিধান কৃষ্ণ সেন, ছৈয়দ আহমদ খান (চকবাজার), সিরাজুল হক মিয়া (মাদারবাড়ি), বশিরুজ্জামান চৌধুরী (আখতারুজ্জামান বাবু’র বড় ভাই), গোলাম রসুল সওদাগর (চন্দনপুরা), আকবর আলী সওদাগর (চেয়ারম্যানÑদেওয়ান বাজার ইউনিয়ন কমিটি), ছোবান ইবনে ইসহাক, ইসহাক কন্ট্রাক্টর (চেয়ারম্যান-দক্ষিণ আগ্রাবাদ ইউনিয়ন কমিটি), কবি বদন মিয়া দীদারি (মৃধা পাড়া, আতুরার ডিপো, পাঁচলাইশ), পরান বল্লভ ঘোষ (রেয়াজুদ্দীন বাজার), রহমান আলী মিস্ত্রি (এম ইউসি-পশ্চিম মাদারবাড়ি), ডা. আইয়ুব আলী (পতেঙ্গা), মকবুল আহমদ কন্ট্রাক্টর (পতেঙ্গা), মহিউদ্দিন (জামালখান), বাদশা সওদাগর (ঈশান মিস্ত্রির হাট), জনাব আলী পেশকার (হালিশহর), মনির আহমদ কন্ট্রাক্টর (রামপুরা), আবদুর রশিদ উকিল (কাট্টলী), অ্যাডভোকেট ওমর হায়াত, মোহাম্মদ মোসলেম (শুলকবহর), এয়াকুব কন্ট্রাক্টর (মাদারবাড়ি), শামসুল হক ও এজাহার মিয়া (পাঁচলাইশ), জয়লাল আবেদীন প্রধান (জেনারেল সেক্রেটারি-টাটরী গ্লাস ফ্যাক্টরী-আমিন জুট মিল), জামশেদ আহমদ চৌধুরী (কাট্টলী), মোহাম্মদ উল্লাহ (পরবর্তীকালে বিটিসির সিবিএ), রহমতউল্লাহ চৌধুরী, খোন্দকার জাকির হোসেন (রফিক মঞ্জিল, স্টেশন রোড, পাঠানটুলীর স্থায়ী বাসিন্দা), ছালেহ আহমদ কমিশনার (পাঠানটুলী), যদুগুহ (পাথরঘাটা), সুরমা নুরুল হক, ইমাম শরীফ, ইউসুফ সর্দার (এনায়েত বাজার) প্রমুখ।
পঞ্চাশের দশকে জহুর আহমদ চৌধুরী ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরম সিদ্ধি লাভ করেন। তিনি ১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম পৌরসভার কমিশনার এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কোতোয়ালী থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন।
আমরা আগেই বলেছি ৬৩ সালে আমীর হোসেন দোভাষ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে ইস্তফা দিলে জহুর আহমদ চৌধুরী সভাপতি এবং ডা, ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। শহর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ডা. ছৈয়দের যোগদান এবং সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়োগ একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কারণ জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন দরবারি মানুষ, পাবলিক লিডার। তাঁর ব্যক্তিত্বের একটা সম্মোহন ছিলো, যার আকর্ষণে মানুষ তাঁর কাছে যেত এবং এভাবে তাঁকে ঘিরে একটি জনমণ্ডলী তৈরি হয়েছিলো। ৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করার পূর্ব পর্যন্ত আন্দরকিল্লা নবী স্টোরের পাশে তাঁর ট্রেড ইউনিয়নের এবং শহর আওয়ামী লীগের অফিস ছিলো। মার্শাল ল-এর সময় তিনি স্টেশন রোডে সড়ক ও জনপথ বিভাগের ডাক বাংলার ২৩নং কক্ষ প্রথমে হাশেমিয়া রেস্টুরেন্টের মালিক হাশেম সাহেব এবং পরে সৈয়দুর রহমানের (ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের পিতা) কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে প্রথমে তাঁর ব্যক্তিগত অফিস এবং ৬২ সালে মার্শাল ল উঠে যাবার পর শহর আওয়ামী লীগের অফিসও স্থানান্তরিত করেন। পক্ষান্তরে ডা. ছৈয়দ ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত গুণের একজন মানুষ। তিনি ছিলেন সংগঠন-অন্তপ্রাণ মানুষ, যাঁকে বলা যেতে পারে সাংগঠনিক নেতা। তাঁর একটি সাইকেল ছিলো, সেটি নিয়ে শহরময় চরকির মত ঘুরে বেড়াতেন এবং মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ফেরি করে বেড়াতেন। আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহ, কর্মী সৃষ্টি তাঁর প্রধান কীর্তি। শহরের তৎকালীন প্রথমে ১১টি ও পরে ২৫টি ওয়ার্ডে তিনি আওয়ামী লীগকে বিস্তৃত ও দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।
চট্টগ্রাম মহানগরে আজ আওয়ামী লীগের যে কর্মী বাহিনী এবং সাংগঠনিক কাঠামো পরিদৃষ্ট হয়, তার প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী। ১৯৬৫ সালে কাউন্সিলে জহুর আহমদ চৌধুরী সভাপতি এবং চৌধুরী এন জি মাহমুদ কামাল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৬৬ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে গেলে এমএ মান্নান সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, পরে কাউন্সিলে তাঁকে রেগুলার করা হয়। শহর আওয়ামী লীগে শুরু হলো মান্নান যুগ। ডা. ছৈয়দের মত তিনিও একজন অসাধারণ সংগঠক ছিলেন। ডা. ছৈয়দ যেখানে শেষ করেছিলেন, এম এ মান্নান সেখান থেকে শুরু করেন। এম এ মান্নানের একটা বাড়তি সুবিধা ছিলো, সেটা হলো তিনি ৬২ সালে ছাত্রলীগের পুনরুজ্জীবনের প্রধান উদ্যোক্তা এবং সে বছরের ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন। ছাত্রনেতা হওয়ার সুবাদে তিনি ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগের জন্য কর্মী সংগ্রহ করার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং সর্বোত্তম উপায়ে তা’ কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি পতেঙ্গা থেকে বাকলিয়া, চান্দগাঁও, মোহরা, জালালাবাদ, উত্তর পাহাড়তলী, হালিশহর ও কাট্টলী পর্যন্ত ৪২টি ওয়ার্ডে শাখা গঠনের মাধ্যমে নগর আওয়ামী লীগের বিস্তৃতি ঘটান।
মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান সংগঠন এমএ মান্নানের সৃষ্টি এবং তাতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর কিছু অবদানও আছে। এম এ মান্নান বহু বছর (১৯৬৬-২০০৬) আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীকালের নেতাদের নেতা ছিলেন তিনি। আশরাফ খান, মৌলভী সৈয়দ, ইদরিস আলম, এসএম ইউসুফ, মহিউদ্দিন চৌধুরী, শহীদ রব, কাজী আবু জাফর, গোলাম রব্বান, সালাউদ্দিন মাহমুদ, সুলতান উল কবির চৌধুরী, হাজি কামাল, মোহাম্মদ ইদ্রিস, আবদুল্লাহ হারুন এবং ষাটের দশকের আরো বহু বিখ্যাত ছাত্রনেতা প্রমুখ এম এ মান্নানের কর্মী। নতুন ছাত্রদেরকে ছাত্রলীগে দীক্ষা দেওয়ার জন্য এম এ মান্নানকে যিনি সহযোগিতা করতেন, তিনি হচ্ছেনÑশহীদ মুরিদুল আলম। এম এ মান্নান ছাত্রদের সংগ্রহ করে মুরিদুল আলমের হাতে ছেড়ে দিতেন। তাঁদেরকে ছাত্রলীগের আদর্শ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করতেন মুরিদুল আলম। আরেকজনের কথাও বলতে হয়, তিনি হচ্ছেনÑফেরদৌস আহমদ কোরেশী। মুরিদুল আলম এবং ফেরদৌস আহমদ কোরেশী বন্ধু ছিলেন। উভয়েই অসাধারণ মেধাবী ছাত্র ছিলেন, আইয়ুবের মার্শাল ল’-এর পর ছাত্রলীগকে পুনরুজ্জ্বীবিত করে নতুনভাবে সংগঠিত করেছিলেন, এম এ মান্নান, ফেরদৌস কোরেশী, শহীদ মুরিদুল আলম ও আবু ছালেহ।
ষাটের দশকে শহর আওয়ামী লীগে অনেক নতুন নেতা-কর্মীর সমাবেশ ঘটে, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে দেয়া হলোÑবিজি মাহমুদ জালাল এলএলবি, ইদ্রিস বিএসসি, শামসুল আলম চৌধুরী, গোলাম মোস্তফা মিন্টু, লম্বা কবির, ইউসুফ চৌধুরী (মনসুরাবাদ), আজমালুল হক, নুরুল আলম চৌধুরী, খায়রুল আনোয়ার, আবদুর রহমান, রাখাল দাশ, ছালেহ জহুর, নূর হোসেন (পাঁচলাইশ), আবদুস শুক্কুর, ডা. নুরুন্নাহার জহুর, শাহ বদিউল আলম, নূর মোহাম্মদ চৌধুরী, আশরাফ খান, ইদরিস আলম, মোহাম্মদ ইব্রাহিম, কফিল উদ্দিন, মোহাম্মদ জাকেরিয়া (কদমতলী), ফজল কবির খান, জানে আলম দোভাষ, শামসুল আলম (পাথরঘাটা), সুলতান উল কবির চৌধুরী, নুরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী (কাট্টলী), সুলতান (কাট্টলী), মোহাম্মদ ইদ্রিস (মাদার্শা), আবদুল মতিন, হাজি কামাল, আবদুর রউফ, জাফর আহমদ (সাবেক কমিশনার-মাদারবাড়ি), জাহাঙ্গীর চৌধুরী, আবদুল হাকিম (দেওয়ানবাজার), আবুল খায়ের সওদাগর, তেজেন্দ্র লাল ঘোষ (এনায়েত বাজার), সনৎ বড়ুয়া (বান্ডেল রোড, পাথরঘাটা), জাফর আহমদ, ইউসুফ, রহমান আলী, অ্যাডভোকেট মাজেদুল হক, অ্যাডভোকেট অধ্যাপক খান শফিকুল মান্নান, অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম (দামপাড়া), কালামত আলী সওদাগর (কোরবাণীগঞ্জ), অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম (মাদারবাড়ী), অ্যাডভোকেট শহীদুল হুদা, শেখ আহমদ (পশ্চিম ষোলশহর), হাজি মনির (পাথরঘাটা), ইব্রাহিম, দোস্ত মোহাম্মদ (বক্সিরহাট), আবুল বশর কায়সার, এস. এম জাহাঙ্গীর (ঝাউতলা), কবির আহমদ (মতিয়ার পোল), এমবি আহমদ (দেওয়ানহাট), মো. শোয়েব (জালালবাদ), নুরুল হক (উত্তর পাহাড়তলী), আবুল খায়ের (অয়্যারলেস কলোনী), কামাল আহমদ চৌধুরী (পাহাড়তলী বাজার), ডা. মোহাম্মদ মীর (জালালবাদ), শাহ আলম (ইসমাইল ফৌজদার বাড়ি-জালালবাদ), হাবিবুর রহমান চৌধুরী (হোসেন গ্লাস ফ্যাক্টরি, পশ্চিম ষোলশহর), ফিরোজ আহমদ (দামপাড়া লেইন), আমিনুল হক (দামপাড়া লেন), বাদশা মিয়া (মাঝিরঘাট), এস আই হায়দার (এ কে খান জুটমিল, পাহাড়তলী), মোস্তফা আলী (সন্দ্বীপ জনকল্যাণ সমিতি-লালখান বাজার), যতন্ত্রী ঘোষ (রেয়াজুদ্দিন রোড,) আবদুস সালাম (ফিরিঙ্গীবাজার লেন), নুর আহমদ (নিউ মার্কেট), মোহাম্মদ আলী (আলকরণ), দিদারুল আলম, বাড়বকুণ্ড, আবুল বশর (আছদগঞ্জ), শামসুল আলম (দেওয়ানবাজার), আবদুল মালেক (আতুরার ডিপো), নুরুন্নবী (অয়্যারলেস কলোনী), মহিউদ্দিন আহমদ (অয়্যারলেস কলোনী), আবদুল কাদের (এম ইউ সি-টাইগারপাস), শামসুল হক (প্রযত্নে নোমান প্রেস, খাতুনগঞ্জ), মো. ইব্রাহিম (লামাবাজার), এস এম জাহাঙ্গীর (এম ইউ সি-পাঠানটুলী), এম ই আহমদ (ম্যানেজার, দেওয়ানহাট), এম এ ইউসুফ (এম ইউসি, পশ্চিম মাদারবাড়ি), জামাল শরীফ (এম ইউ সি-পাঠানটুলী)।
এম এ মান্নান নেতৃত্বে থাকতেই তাঁর ছায়ায় মহিউদ্দিনের নেতৃত্ব বেড়ে ওঠে এবং পরবর্তীকালে মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে একটি যুগ চিহ্নিত হয়। এই ধারাবাহিকতায় মাহতাব-নাছির মহানগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। মাহতাব ভারপ্রাপ্ত এবং নাছির মনোনীত হলেও তাঁরা নিয়মিত সভাপতি সম্পাদকের মতই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। মাহতাব এক সময় অসুস্থ ছিলেন, এখনো হয়তো পুরোপুরি সুস্থ নন, কিন্তু তিনি যেভাবে দলের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছেন; জনসংযোগ এবং সংগঠনের সভা, মিছিলে যোগদানের জন্য নগর চষে বেড়াচ্ছেন, তাঁকে দেখে কে বলবে তিনি অসুস্থ ? মাহতাব একজন সিজন্ড্ পলিটিসান। অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ, প্রবীণ ও জ্ঞানী রাজনীতিবিদ।
এক ঝাঁক তরুণের সমন্বয়ে গড়া নগর আওয়ামী লীগে মাহতাব একজন মুরুব্বিস্থানীয় নেতা। তাঁর অভিভাবক সুলভ কর্তৃত্ব দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। তাঁকে এবং তাঁর বাসভবনকে ঘিরে নগরের আওয়ামী রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে। আ.জ.ম নাছিরও এখন প্রবীণ নেতা, তথাপি তাঁর উদ্যম, উদযোগ, কর্মকুশলতা, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ক্রিয়াকর্মে তাঁর প্রাণোচ্ছ্বল উপস্থিতি দিয়ে তিনি দলে যে জীবনী শক্তি সঞ্চার করেন, তাঁকে তরুণরাও হিংসে করবে। আ.জ.ম নাছির নগর আওয়ামী লীগে নতুন বীর্য, নবরক্ত সঞ্চার করে সংগঠনকে টগবগে ঘোড়ার ন্যায় ছুটিয়ে চলেছেন। আমার মনে হয়, আসন্ন কাউন্সিলে মাহতাব-নাছিরের নেতৃত্বের কোন বদল হবে না, বরং কাউন্সিলরদের ভোটে তাঁদের নেতৃত্ব নিয়মিতকরণ হবে। সামনে নির্বাচন, সে সময় যে দক্ষযজ্ঞ হবে বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপি’র সাথে, তখন পদে পদে আ.জ.ম নাছিরের প্রয়োজনই অনুভূত হবে। নাছির এখন তরুণও নন, যুবকও নন, মেঘে মেঘে তাঁরও অনেক বেলা কেটে গিয়ে তিনি এখন প্রৌঢ়ত্বের কোঠায় উপনীত হয়েছেন। সিজেকেএস সহ নগরের অনেক সামাজিক, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তিনি সভাপতির পদ অলংকৃত করছেন। সর্বোপরি তিনি উনবিংশ শতাব্দীর বুড়া মাদ্রাসার মোহাদ্দেস সাহেবের প্রপৌত্র। তাঁর পিতামহ ছিলেন শাহী জামে মসজিদের হাফেজ সাহেব।