একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট গেরিলা যোদ্ধা এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এসএম মাহবুবুল আলম আমার বন্ধু এবং সহযোদ্ধা। আমি অনেকের কথা লিখেছি এবং লিখে যাচ্ছি, কিন্তু মাহবুব সম্পর্কে এখনো কিছু লিখিনি, এটা আমার কাছে বিরাট অপরাধ বলে মনে হচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার হারুন ভাই, ডা. মাহফুজ ভাই, অমল মিত্র, ফজলুল হক ভূঁইয়া, হারিছ দা এবং আবু সাঈদ সর্দার সম্পর্কেও কিছু লেখার ইচ্ছা পোষণ করি। জানি না পারব কিনা।
মাহবুব এবং আমি একসঙ্গে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বগাফা বিএসএফ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং অম্পিনগরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ট্রেনিং নিয়েছি। পরে ইউসুফ ভাই (এসএম ইউসুফ) আমাকে বিএলএফ-এ নিয়ে যান। মাহবুব এফ এফ কমান্ডার হয়ে বিরাট এক গ্রুপ নিয়ে যুদ্ধ করার জন্য দেশের ফিরে আসে। ঘাটফরহাদবেগের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হাজি ইসহাক সওদাগরের তৃতীয় পুত্র মাহবুব। শহরের ছেলে হওয়ায় ত্রিপুরার হরিণা ক্যাম্পে ১নং সেক্টরের সামরিক কর্মকর্তারা তাকে খুব গুরুত্ব দেন এবং একটি গ্রুপ গঠন করে তাকে তার কমান্ডার নিযুক্ত করে শহরে পাঠান। কিন্তু মাহবুবের গ্রুপে গ্রামের ছেলেও ছিলো। যেমন মনসা গ্রামের আবদুস ছালাম এবং হুলাইন গ্রামের ইউসুফ। ফলে শহরে আসার পরে গ্রামের ছেলেরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রামে চলে যায়। সৈয়দ আবদুর রহমানের পর মাহবুবই সম্ভবত দ্বিতীয় কমান্ডার যিনি এফএফ গ্রুপ নিয়ে শহরে আসেন। শহরে মাহবুবের অনেক বন্ধুবান্ধব, চেনাজানা মানুষ। চকবাজারের চক এলাকার বাসিন্দা সেকান্দর তার বন্ধু, দানবীর সোলেমান চৌধুরীর দ্বিতীয় পক্ষের প্রথম পুত্র সেলিমউল্লিাহ চৌধুরী, চা বাগান মালিকের পুত্র শান্তুনু চক্রবর্তী এবং দানু ভাই (কাজী ইনামুল হক দানু)-এদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মাহবুব কাজ শুরু করেছিলেন।
রুশ্নি ভাইয়ের ভাই রুমু মাহবুবের বন্ধু, কিন্তু তারা মুক্তিযুদ্ধে যায় আলাদাভাবে। মাহবুব পরে আর একবার ভারতে গিয়েছিলো কিনা সেটা আমি তাকে জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু সে আমাকে তার গ্রুপের যে তালিকা দেয়, তাতে যেসব নাম দেখছি, সবাইকে আমি চিনতে পারছি না। সৌরিন্দ্র তার সঙ্গে ছিলো। ফজলুল হক ভূঁইয়া তার সঙ্গে সাকা’র অপারেশনে অংশ নিয়েছিলো।
মাহবুব তার পুরো পরিবারকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলো। তার বাসা মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম শেল্টার ছিলো। মাহবুবের কারণে তার বড় ভাই শাহ আলম, মেজ ভাই শামসু (এসএম শামসুল আলম) ভাই ছোট ভাই মুজিব, সপু এমনকি ছোট বোন মিনুও মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করেছিলো। মাহবুবের পিতা হাজি ইসহাস মিয়াও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনে পরামর্শ দিতেন। শামসু ভাইয়ের বন্ধু একেএম আবু বকর চৌধুরীও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আবু বকর চৌধুরী ফকা চৌধুরীর চাচাতো ভাই। শামসু ভাই ‘বলি শামসু’ নামে পরিচিত ছিলেন। বকর ভাই এবং তিনি ১১ দফা কর্মসূচির পর পন্থী এনএসএফ নেতা মাহবুবুল হক দোলনের সঙ্গে ১১ দফার প্রতি সমর্থন দিয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভুক্ত হন। তাদের এক নেতা নাজিম কামরান চৌধুরী ডাকসু’র জিএস এবং ১১ দফার অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিলেন। শামসু ভাই এনএসএফ নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং আবু বকর চৌধুরী সভাপতি ছিলেন। বকর ভাই এনএসএফ’র কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন।
একটি অপারেশন করে কেউ যদি বিখ্যাত হয়ে যেতে পারেন, তিনি হচ্ছেন এসএম মাহবুব উল আলম। সেটি হলো সাকা (সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী) অপারেশন। সাকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর খুবই ঘনিষ্ঠ মিত্র, কনভেনশান মুসলিম লীগ সভাপতি ফকা চৌধুরী (ফজলুল কাদের চৌধুরী)-এর পুত্র; ফকা ও সাকা চৌধুরী পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞকে শুধু স্বাগতই জানানইনি, তাদের সহযোগিতা করার জন্য চট্টগ্রাম শহরে তাদের গুডস হিলের বাসভবনকে চর্টার সেল বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর পেয়ারের দোস্ত, খাসবান্দা এই পিতা-পুত্র চট্টগ্রামে মূর্তিমান বিভীষিকা রূপে দেখা দিয়েছিলেন। তারা আল শামস নামে একটি সশস্ত্র জল্লাদ বাহিনী সৃষ্টি করে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে তাদেরকে লেলিয়ে দিয়েছিলো। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে চলেছিলো। মুক্তিযুদ্ধের এই বাধা উপড়ে ফেলা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিলো। শহরের মুক্তিযোদ্ধা নেতৃবৃন্দ ফকা-সাকাকে খতম করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ফকা থাকতেন তার বাসভবনে সুরক্ষায়, খুব একটা বের হতেন না তিনি। ‘লম্ফ জম্ফ’ যা করতেন ঐ সাকাই। অতএব তাকেই আগেই শেষ করে দেয়ার চিন্তা নিয়ে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে মাহবুবের ওপর। মাহবুব তাঁর গ্রুপ নিয়ে সাকা’র ওপর সফল হামলা চালিয়েছিলেন। সাকার বাঁচার কোনো উপায় ছিলো না। তবুও শরীরে মারাত্মক জখম নিয়ে সাকা পৈতৃক প্রাণ হাতে নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেদিন যদি সাকা মারা যেত, তাহলে মাহবুবরা হিরো হয়ে যেতেন।
এ অপারেশনের উদ্যোক্তা হলেন চট্টগ্রাম শহরের যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার আফছার উদ্দিন মো. আলী, সদ্যপ্রয়াত সাবেক এমপি মঈনুদ্দিন খান বাদল ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মরহুম কাজী ইনামুল হক দানু। তারা জয়নগরে মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারুল ইকবালের (পরে পুলিশের আইজি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) বাসায় বৈঠক করেন এবং সেখানে মাহবুবকে ডেকে নেন। ঐ বৈঠকে ইঞ্জিনিয়ার আফছার উদ্দিন মো. আলী ও অপর দুজন সিদ্ধান্ত নেন যে, এ অপারেশনটা গ্রুপ কমান্ডার মাহবুব উল আলম করবেন। তারা তাকে অপারেশনের দায়িত্ব দেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুই-তিনদিন পর মাহবুব জয়নগরে সেকান্দার আলীর বাসায় সহযোদ্ধাদের নিয়ে আরেকটি বৈঠক করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সেকান্দার আলী, কাজী নুরুল আবছার, শাহ আলম, মো. হোসেন বাবুইয়া। বৈঠকে মাহবুব সাকা চৌধুরীকে আক্রমণের জন্য রেকি করতে কাজী নুরুল আবছারকে দায়িত্ব দেন। ৭/৮ দিন পরে খবর আসে সাকা চৌধুরী চন্দনপুরায় ডা. ছমিউদ্দিনের বাড়িতে তার মেয়ের সঙ্গে এনগেজমেন্টের জন্য সেখানে যাবে। সাকা চৌধুরী এনগেজমেন্টের আংটি পরাবে ছমিউদ্দিনের কন্যার হাতে। কাজী নুরুল আবছার এ খবর মাহবুবকে দেন। তিনি মাহবুবকে বললেন ডা. ছমিউদ্দিনের ছেলে আজিজ তার বন্ধু। আজিজের কাছ থেকে তিনি খবরটা পেয়েছেন যে সাকা চৌধুরী আসবে। তখন মাহবুব চকবাজার শেল্টারে বসে আবছারকে বললেন, আজিজ যখন তোমার বন্ধু, তুমি তাকে রাজি করাও যে সে আমাদের সাথে এ অপারেশনে সহযোগিতা করবে। দুদিন পর আবছার আবার খবর আনলো যে, আজিজ ও তার বোন উভয়ে তাদের এ অপারেশনে সহযোগিতা করতে রাজি আছে। যদিও ডা. ছমিউদ্দিনের কন্যার সাথে সাকা চৌধুরীর বিয়ের কথা হয়েছে, তথাপি মুসলিম লীগ নেতা ছমিউদ্দিনের পরিবারের সবাই জানতো সাকা চৌধুরী ইতোমধ্যে বহু নারীকে ধর্ষণ ও অত্যাচার করেছে। তাই আজিজের বোন এ বিয়ে ভেঙে দিতে চাচ্ছিলেন। সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে সাকা চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যরা আজিজদের বাড়িতে অনুষ্ঠান করতে আসবে। এ খবর পেয়ে মাহবুব পরবর্তী পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেন। ঐদিন ঘাটফরহাদবেগে মাহবুবের বাসায় সাকা চৌধুরীকে আক্রমণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মাহবুবের গ্রুপের সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা ফজলুল হক ভূঁইয়া ও সৌরেন্দ্রনাথ সেন ওরফে কামালকে নিয়ে মাহবুব অপারেশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেদিন দুপুর থেকে মাহবুবের বাসায় বসে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকেন। এসময় মাহবুবের বাবা তাদের সবাইকে ডেকে বললেন, তোমরা যেসব অস্ত্র নিয়ে এসেছো এগুলো নিয়ে তোমরা এ অপারেশন সফল করতে পারবে না। কারণ ওদের কাছে ভারি অস্ত্র আছে। তোমাদেরও ভারি অস্ত্র অর্থাৎ এলএমজি (লাইট মেশিনগান) লাগবে। কিন্তু ফজলু ও সৌরেন্দ্র বললো, চাচা আমরা সম্মুখ যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না, আমরা গেরিলা কায়দায় চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে ওদেরবে কাবু করে ফেলেবা।
সন্ধ্যার ঠিক আগে মাহবুবের বাসা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে তিন মুক্তিযোদ্ধা অপারেশনের গন্তব্যস্থলে রওনা হন। মাহবুবরা ডা. ছমিউদ্দিনের প্রতিবেশি আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান কায়সারের বাড়ির পাশ দিয়ে অগ্রসর হয়ে ছমিউদ্দিনের বাসার সামনে নালার স্ল্যাবের নিচে তিনজন অস্ত্রসহ ঢুকে পড়েন। আগে থেকে তার গ্রুপের কাজী নুরুল আবছার ও আজিজের মধ্যে কথা হয় যে, শত্রু যখন বাড়িতে ঢুকবে তখন আজিজ তার তিনতলা বাড়ি থেকে দুবার টর্চের আলো জ্বালাবে আমাদেরকে তাদের আগমন সংকেত দেওয়ার জন্য। আর যখন শত্রুরা বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে তখন তারা সংকেত জানানোর জন্য ৩ বার টর্চের আলো জ্বালাবে।
তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। গেরিলারা শত্রুর জন্য স্ল্যাবের নিচে অস্থির অপেক্ষায় ছিলেন। আনুমানিক সাড়ে সাতটার দিকে তারা দেখলেন সাকা চৌধুরী নিজে গাড়ি চালিয়ে সদলবলে ছমিউদ্দিনের বাসায় ঢুকছে। তখন তারা খুব উত্তেজিত এবং শত্রু নিধনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। রাত আনুমানিক নয়টার পর তারা দেখেন ছমিউদ্দিনের তিনতলা বাড়ি থেকে টর্চের আলো তিনবার জ্বলে উঠলো। তাদের রেকির দায়িত্বপ্রাপ্ত নুরুল আবছারও তখন গোপনে ঐ বাড়ির তিনতলায় আজিজের সাথে ছিলেন। তাদের অপেক্ষার পালা শেষ। টর্চের আলোর সংকেত পেয়ে গেরিলারা ড্রেন থেকে বের হয়ে সাকার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ান। সাথে সাথে একযোগে তিনজনই গুলি চালান, ব্রাশফায়ার করেন। একই সময়ে শত্রুকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড চার্জ ও রিভলবার থেকে গুলি ছুঁড়তে থাকেন। এ সময় গাড়ির মধ্যে একজন নিহত হয়েছে নিশ্চিত হওয়া গেল, কারণ নিহত ব্যক্তির মাথার মগজ ও রক্ত তার জ্যাকেটের ওপর ছিটকে পড়েছে দেখলেন মাহবুব। মনে করলেন সাকা নিহত হয়েছে। কিন্তু একটু পরেই ঝুপ করে কিছু একটা পতনের আওয়াজ শোনা গেল। আওয়াজ লক্ষ্য করে মাহবুব রিভলবার থেকে আরও তিন রাউন্ড গুলি ছুঁড়লেন। পরে জানতে পারেন সাকা চৌধুরী আহত হয়ে গাড়ির দরজা খুলে পার্শ্ববর্তী ফায়ার ব্রিগেডের পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলো এবং সাঁতরে পুকুর পার হয়ে সিরাজদ্দৌলা রোড দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। সাকা’র পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার শব্দই মাহবুব শুনতে পেয়েছিলো। ওদিকে তখন সিরাজদ্দৌলা রোডের দিক থেকে আর একটা জিপ তাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে দেখে মাহবুব আবার রিভলবার থেকে সেটি লক্ষ্য করে আরেক রাউন্ড গুলি ছোঁড়েন। জিপটা পিছু হটে পালিয়ে যায়। তারাও পানির ড্রেন ও মলমূত্রের নালার ভেতর দিয়ে বের হয়ে বাকলিয়ায় তাদের শেল্টারে চলে যান। সেখান থেকে সৌরেন্দ্রকে একটি শেল্টারে এবং ফজলুকে আরেকটি শেল্টারে পাঠিয়ে দিয়ে মাহবুব বাকলিয়ার শেল্টারে থেকে যান। ঐ রাতে দশটার বিবিসি সংবাদ শুনলেন মাহবুব বাকলিয়া শেল্টারে বসে। বিবিসির খবরে বলা হলো কুখ্যাত রাজাকার সর্দার সাকা চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে। রাত ১১টায় ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদে বলা হলো সাকা চৌধুরীর ওপর মুক্তিযোদ্ধারা গুলি চালিয়েছে। এ ঘটনায় একজন ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছে এবং সাকা চৌধুরী গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পরদিন সকালে বিভিন্ন সূত্রে শহরে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, সাকা চৌধুরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম দিন চিকিৎসা নেয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য পাকিস্তানের করাচি হয়ে লন্ডনে চলে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা আশ্বস্ত হলেন যে, কুখ্যাত রাজাকার সর্দার সাকা চৌধুরী অন্তত দেশছাড়া হয়েছে। তার নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে চট্টগ্রামের মানুষ সাময়িকভাবে মুক্তি পেয়েছে।
চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন
মাহবুবের আরেকটা উল্লেখযোগ্য অপারেশন হলো চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন। ১৯৭১ সালের জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকার অর্ডিন্যান্স ’৭১ জারি হয়। এই অর্ডিন্যান্স-এর ক্ষমতাবলে ১৯৫৮ সালের আনসার অ্যাক্ট বাতিল ঘোষণা করা হয়। আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার কারণে সরকার নতুন করে আইন জারি করতে বাধ্য হয়। সেই আইন হলো রাজাকার আইন। সেই আইনে পূর্ব পাকিস্তানের সকল ব্যক্তিকে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অস্ত্রে সজ্জিত করা হবে বলে ঘোষণা দিলে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের উগ্রপন্থী হানাদার দোসররা রাজাকার বাহিনীর জন্ম দেয়। চট্টগ্রামে রাজাকার বাহিনীর নেতা হয় চট্টগ্রাম কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি চকরিয়ার এনামুল হক মঞ্জু। তার তত্ত্বাবধানে চন্দনপুরায় একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এই ক্যাম্পের রাজাকাররা রাস্তায় একটি চেকপোস্ট বসিয়েছিল। শুধু চেকপোস্ট বসিয়ে তারা ক্ষান্ত হয়নি। রাস্তা থেকে সাধারণ মানুষদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তাদের টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে নিতো। অক্টোবরের প্রথম দিকে তারা চন্দনপুরা মসজিদে মাইকের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ঘোষণা প্রচার করতে থাকে। চন্দনপুরার রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকারদের অত্যাচার চরমে উঠলে সেদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। এছাড়া প্রায় প্রতিদিন চন্দনপুরা অঞ্চল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পটিয়া থেকে অস্ত্র আসতো। রাজাকার বাহিনীর এ ক্যাম্পের কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র আনা-নেয়াতে অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এ অস্ত্র চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করতে না পারলে অনেকগুলো অপারেশন বন্ধ হয়ে যাবে।
এ পরিস্থিতিতে চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্প নিয়ে কি করা যায় সে সম্পর্কে আলোচনার জন্য বৈঠকে বসলেন ইঞ্জিনিয়ার আফছার উদ্দিন মো. আলী ও কাজী ইনামুল হক দানু। তারা বৈঠক করে মাহবুবকে ডেকে নেন এবং সিদ্ধান্ত হয় যে অপারেশনটি পরিচালনা করবেন ৮নং এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার মাহবুব উল আলম। এই অপারেশনের জন্য মাহবুব পরদিন তার গ্রুপ নিয়ে আবার পৃথকভাবে গোপন বৈঠকে বসেন জয়নগর সেকান্দার আলীর বাসায়। বৈঠকে মাহবুবের সাথে ছিলেন সেকান্দার আলী, শান্তনু চক্রবর্তী, মোহাম্মদ হোসেন (বাবুইয়া) ও শাহ আলম। তখন রমজান মাস এবং ঈদের দু’চারদিন পূর্বে এ পরিকল্পনা হয়েছিলো। কোন সময় কীভাবে অপারেশনটা করলে সুবিধা হবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনায় তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ইফতারের সময় আক্রমণ হবে এবং মোহাম্মদ হোসেন বাবুইয়া অপারেশনে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি চালাবে। আমি তখন ঘাটফরহাদবেগের বাসায় ছিলাম। মাহবুবের কাছে অপারেশনের কথা শুনে আমিও তোমার সাথে অপারেশনে যাব। পরদিন মাহবুব আর আমি চকবাজারে সেকান্দরের শেল্টারে উঠলাম। সেখানে মাহবুব তাঁর অস্ত্র ৯ এম এম কার্বাইন ও ৪টা ম্যাগজিন সেকান্দরকে দিলেন। আমাকেও একটা ৯ এম এম কার্বাইন সে দিলো। সম্ভবত ঈদের পূর্বদিনই আমরা অপারেশনটি করেছিলাম। অপারেশনের আগে আমরা শান্তুনুর বাসায় যায়। সেখানে শহরের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় এ কথা ওঠে আসে যে, ঈদের কারণে শহরে এখন কড়া পাহারা বসানো এবং বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সৈন্যরা টহল দিচ্ছে। এমতাবস্থায় তখন অপারেশন না করার পক্ষে সবাই মতামত দিয়েছিলেন। আমি মাহবুবকে বলেছিলাম কেউ না করলেও চল তুমি আর আমি অপারেশনটা করি। মাহবুব আমার কথায় রাজি হয়। মোহাম্মদ হোসেন বাবুইয়ার ট্যাক্সি করে আমরা রাজাকার ক্যাম্প আজম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ আক্রমণ করার জন্য রওনা দিলাম। আমরা দুজনে সন্ধ্যা ৬টায় ইফতারের সময় এ ওয়ার্কশপে অতর্কিত আক্রমণ করি। আক্রমণের জন্য যে পরিকল্পনা স্থির হয়েছিলো তাতে মাহবুব দরজা দিয়ে আক্রমণ ওপেন করবে আর আমি জানালায় দাঁড়িয়ে তাকে কাভার দেব। কিন্তু প্যারেড কোণায় ট্যাক্সি চলন্ত অবস্থায় দাঁড় করিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে আমরা যখন ওয়ার্কশপে পৌছে যার যার অবস্থান নিই, তখন দেখি মাহবুব দরজা দিয়ে ঢোকার সময় চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছে। আর সেটা দেখে ভিতর থেকে রাজাকাররা দাঁড়িয়ে তাকে ধরার জন্য দরজার দিকে ছুটে আসছে। আমি এ দৃশ্য দেখে এক মুহূর্তও দেরি না করে আমার কার্বাইন থেকে ব্রাশফায়ার করে যখন নিশ্চিত হলাম যে, ভিতরে আর কেউ অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে নেই, তখন মাহবুবকে নিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে ট্যাক্সিতে উঠে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে চলে আসি।
সাকা চৌধুরীর ওপর হামলার দুদিন পর পাকিস্তানি সেনারা মাহবুবের ঘাটফরহাদবেগের বাড়ি রেইড করে এবং তাঁর মা-বাবার সাথে অত্যন্ত অশোভন ও অপমানজনক আচরণ করেন। মাহবুবকে হাজির করার জন্য তার মা-বাবাকে আলটিমেটাম নিয়ে পাক সেনারা মাহবুবের পার্শ্ববর্তী আরেকটি শেল্টারে রেইড করে। সেই বাড়ি থেকে তারা মাহবুবের বড়ভাই এস এম শামসুল আলম ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ঐ শেল্টার মাস্টার আবু বক্কর চৌধুরীকে রাতে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। পাক সেনারা তার বড়ভাই ও তার বন্ধুকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে আধমরা করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে হস্তান্তর করে। নির্যাতনে মারা গেছে ভেবে পাক সেনারা তাদের উভয়কে চট্টগ্রাম কারাগারে প্রেরণ করে। কারা হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর তারা জীবন ফিরে পান এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাহবুবরা তাদের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনেন।
এর দুদিন পর পাকসেনারা খেজুরতলা মাস্টারপুল এলাকার আরও একটি শেল্টারে আবার রেইড করে এবং ঐ বাড়ির শেল্টার মাস্টার শহীদ তফজুল আলী, শহীদ আবু বক্কর লাবু ও শহীদ মো. কমর আলী- এ তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়। মাহবুবকে হাজির করার জন্য তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। তারা বলেছিল তারা মাহবুবকে চেনে না। মাহবুবের খোঁজ নেওয়ার জন্য পাক সেনারা এ তিনজনকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। আজ অবধি তাদের ব্যাপারে পরিবার তাদের কোনো খোঁজখবর পায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের লাশও খুঁজে পায়নি পরিবারের সদস্যরা।
মাহবুব যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হলেন : ১৯৪৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। এস এম মাহবুব উল আলম। তাঁর পিতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হাজি মোহাম্মদ ইসহাক মিয়া। মাতা কুলছুমা খাতুন। ছয় ভাই দু’বোনের মধ্যে মাহবুব তৃতীয়।
মাহবুব ১৯৭৩ সালে ওয়াজেদিয়া থেকে এসএসসি ও ১৯৭৪ সালে সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি ছাত্রজীবনে রাজনীতি করতেন, সে রাজনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। তাঁকে রাজনীতিতে দীক্ষা দেন ছাত্রলীগ নেতা শহীদ স্বপন চৌধুরী। স্বপন চৌধুরী পরে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক হয়েছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পূর্বে ছাত্রলীগের কার্যকরি কমিটির সভায় স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ-এর প্রস্তাব উত্থাপন করে বিখ্যাত হন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিএলএফ’র দায়িত্ব নিয়ে ভারত থেকে দেশে আসার পথে কাউখালিতে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাকে হত্যা করা হয়।
১৯৬৬ সালের একটি দিনে হাজারি গলিতে স্বপন চৌধুরীর সাথে মাহবুবের দেখা হয়। সেদিন পরিচয়ের পর তিনি মাহবুবকে তাঁর দেওয়ান বাজারের বাসায় যেতে বললেন। মাহবুব তার বাসায় যাওয়ার পর স্বপন চৌধুরী তাকে এমএ আজিজের বাসায় নিয়ে যান। সেখানে শওকত হাফিজ খান রুশ্নি’র সঙ্গে দেখা। রুশ্নি তাঁর পাড়ার ছাত্র এবং তাঁর বন্ধু। সেদিন এমএ আজিজ তাঁকে রাজনীতির অনেক কথা বললেন। এভাবে মাহবুব রাজনীতির পথিক হয়ে যান। পরে তিনি রেস্ট হাউজেও যান এবং পুরোপুরি ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন। শহরের যেখানে মিটিং-মিছিল হতো সেগুলিতে মাহবুব অংশগ্রহণ করতেন। হাজারী গলিতে কাজী মনিরুজ্জামান মন্টুর বাসা ছিলো, মন্টু তাঁর বন্ধু, সে সুবাদে মন্টুর বাসায় যাতায়াত করতেন মাহবুব। সেখানে এবিএম নিজামুল হক, রুশ্নি এবং শামসুদ্দিনও থাকতেন। ফুইক্যা জাফর, এনায়েত বাজারের সালাউদ্দিন, দীপক, বশরজ্জামান চৌধুরী মাহবুবের বন্ধু ছিলো। জাফর-বশর-দীপক হাজারী গলির মুখে সামী হোটেল থেকে নাস্তা করে ইপিআরের রসদ নিয়ে যাওয়ার পথে চেরাগী পাহাড়ে পাকিস্তানি নৌকমান্ডোদের অতর্কিত হামলায় শহীদ হন। সামী হোটেলে মাহবুবও তাদের সঙ্গে নাস্তা করছিলো, তারা মাহবুবকে ডেকেছিলো কিন্তু মাহবুব যায়নি। ফলে মাহবুব বেঁচে যাই।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মাহবুব হাজারী গলির মুখে বিনোদা ভবনে যান। সেখানে তাকে আখতারুজ্জামান বাবু একটি ল্যান্ড ক্রুজার জিপ দিয়ে বলেন, তুমি হালিশহরে ইপিআর’র জন্য রসদ নিয়ে যাও। জিএম চৌধুরী মাল তুলে দিতেন, মাহবুব গাড়ি চালিয়ে তা হালিশহরে যুদ্ধরত ইপিআরদের কাছে পৌঁছে দিতেন। শহরের পতন হলে মাহবুব, জামালখানের এহসানুল করিম, ঘাটফরহাদবেগের মহসীন ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাউজানে হায়দার মিয়া চৌধুরীর বাড়িতে যান। হায়দার সাহেবের জ্যেষ্ঠপুত্র দুলাল ছিলো মাহবুবের বন্ধু। কনিষ্ঠপুত্র এহসানুল হায়দার বাবুল বর্তমানে রাউজান উপজেলার চেয়ারম্যান। সেখানে পাঁচদিন থেকে তারা রামগড় যান। রামগড়ে সাবের আহমদ আসগরী, স্বপন চৌধুরী, গোলাম রব্বান, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, বোরহান, ওমর ফারুকের সঙ্গে দেখা হয় মাহবুবের। ২৮ এপ্রিল মাহবুব ফেনী নদী পার হয়ে ত্রিপুরার সাব্রুমে যান। সেখানে চট্টগ্রাম কলেজের ভিপি জালাল উদ্দিন, এসএম ইউসুফ, মিরসরাইর মুকুলের সঙ্গে দেখা হয়। স্বপন চৌধুরী তাকে একটা স্লিপ দিয়ে বললেন, স্লিপটা নিয়ে মেজর জিয়ার সঙ্গে দেখা কর। জিয়ার সঙ্গে দেখা করলে তিনি বললেন, রাত ১২টার সময় এখানে আসবে। রাতে গিয়ে দেখেন একটি ট্রাক দাড়িয়ে আছে, মেজর জিয়া বললেন, ট্রাকে ওঠে যাও, তোমাকে ট্রেনিং-এ পাঠাচ্ছি। সে ট্রাক মাহবুবকে বগাফা নিয়ে গেলো। সেখানে ১৫দিন ট্রেনিং-এর পর ওম্পিনগর পাঠানো হলো ১ মাসের ট্রেনিং-এর জন্য।
ওম্পি নগর থেকে আবার হরিণা ক্যাম্পে নেওয়া হয়। সেখানে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে মেজর জিয়ার কাছে রিপোর্ট করলে তিনি মাহবুবকে বললেন, চট্টগ্রাম সিটির মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা দেওয়ার জন্য। মাহবুব তাঁকে ষোলজনের একটি তালিকা দিলে তিনি তাকে ঐ ষোলজনের গ্রুপ লিডার মনোনীত করেন। ২/৩ দিন পর তিনি নিজেই তাদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এবং পাঁচদিনের ছুটি দেন বিশ্রামের জন্য। এ সময় মাহবুবকে কিছু টাকা-পয়সা এবং তালিকাভুক্ত সহযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ বুঝিয়ে দেন।
অতঃপর রামগড় দিয়ে তার গ্রুপ নিয়ে মাহবুব বাংলাদেশে ঢোকেন। হরিণা থেকে রামগড় হয়ে চট্টগ্রাম শহরে ঢুকতে তাদের সাত/আট দিন লেগে যায়। শহরে এসে প্রথম আশ্রয়কেন্দ্রে উঠলেন তার গ্রুপের পাথরঘাটার রফিকের বাসায়। দুই/তিনদিন সে বাড়িতে সবাই ছিলেন। এরপর মাহবুব গ্রুপ ভাগ করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন শেল্টারে পাঠিয়ে দেন। ২য় শেল্টার ছিল তার বাসা অর্থাৎ হাজি ইসহাক মিয়া সওদাগরের বাড়ি। ৩য় শেল্টার ছিল ঘাটফরহাদবেগ বজলুর রহমান চৌধুরীর বাড়ি। ৪র্থ শেলটার ছিল খেজুরতলা (মাস্টারপুল বাকলিয়া) শহীদ তফজল আলী সওদাগরের বাড়ি। ৫ম শেল্টার ছিল কোরবানীগঞ্জ মকবুল আলী সওদাগর (শেল্টার মাস্টার ছালামত আলী)। ৬ষ্ঠ শেল্টার ছিল বাকলিয়া হাজি ইব্রাহিম সওদাগরের বাড়ি (শেল্টার মাস্টার মো. ইউনুছ)। ৭ম শেল্টার ছিল চকবাজার জয়নগর সেকান্দার আলীর বাড়ি। ৮ম শেল্টার ছিল চন্দনপুরা আবু এন্ড কোম্পানিতে কাজী নুরুল আবছারের বাড়ি। ৯ম শেল্টার ছিল নন্দনকানন হাজি বাদশা মিয়া চৌধুরীর বাড়ি (শেল্টার মাস্টার ডা. মঈনউদ্দিন খান)। ১০ম শেল্টার ছিল আগ্রাবাদ ডা. জাফর আহমেদের বাড়ি (শেল্টার মাস্টার জাহেদ আহমদ, পাঠানটুলি)। ১১তম শেল্টার ছিল জয়নগর চকবাজার শান্তনু চক্রবর্তীর বাড়ি। মাহবুবের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে ষোলজনকে ১১টি শেল্টারে ভাগ করে দেওয়া হয়। কিছুদিন সবাই বিশ্রামে ছিলেন। এদের মধ্যে প্রায় আটজনকে তাদের মা-বাবার সাথে দেখা করার জন্য ছুটি দেওয়া হয়।
পাক সেনাদের তৎপরতা তখন খুব একটা জোরদার ছিল না বলে তারা প্রায় আঠারো/বিশ দিন চুপচাপ ছিলেন এবং এখানে-সেখানে চলাফেরা করেছিলেন। তারপর তার গ্রুপ সদস্যরা একত্রিত হয় এবং ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আরও বিভিন্ন গ্রুপ দেশে ঢুকতে শুরু করে। এ পর্যায়ে ইঞ্জিনিয়ার আফছার উদ্দিন মোহাম্মদ আলী ও মৌলভী সৈয়দ আহমদ যৌথভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য সিটি কমান্ড গঠন করেন এবং এ দুজনের যৌথ কমান্ডের অধীনে সকল মুক্তিযোদ্ধা সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। মাহবুবের গ্রুপের তৎপরতার উল্লেখযোগ্য দিক ছিল তারা একই দিনে শহরের বিভিন্ন স্থানে ১২টি গ্রেনেড চার্জ করে শহরময় ত্রাস সৃষ্টি করে জানান দিয়েছিলেন যে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে ঢুকে পড়েছে এবং অপারেশন শুরু করেছে।