ঢাকায় চিকিৎসককে দেখানোর পর আলট্রাসনোগ্রাফীতে পেটের বাচ্চা মৃত বলে জানতে পারেন এক অন্তঃসত্ত্বা নারী। এরপর স্বামী-স্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন দিনাজপুরে নিজ এলাকায় গিয়ে মৃত বাচ্চা প্রসব করাবেন। সে অনুযায়ী রোববার সন্ধ্যায় আন্তনগর চিলাহাটী এক্সপ্রেস ট্রেনে রওনা হন তাঁরা। কিন্তু ট্রেনের বগিতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই নারী। এরপর ট্রেনের মাইকে ঘোষণা দিয়ে চাওয়া হয় সহায়তা। এ সময় ওই ট্রেনে থাকা চিকিৎসক ও কয়েকজন নার্স ও যাত্রীদের সহায়তায় বেঁচে যান ওই নারী।
ভুক্তভোগী ওই গৃহবধূর নাম মৌসুমী আক্তার (২৭)। তাঁর স্বামীর নাম রবিউল আউয়াল। তিনি ঢাকার মগবাজারের একটি কোম্পানিতে কর্মরত। রবিউল আউয়ালের বাড়ি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ৪ নম্বর বেদবিঘী ইউনিয়নের শ্রীকৃষ্ণপুর গ্রামে। আর তাঁর স্ত্রীর বাড়ি একই উপজেলার ৩ নম্বর কাজীহাল ইউনিয়নের পুকুরী তালপাড়া গ্রামে।
স্বামী রবিউল আউয়াল জানান, ২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাঁরা ঢাকাতে থাকেন। তাঁর স্ত্রী মৌসুমী চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। এটি ছিল তাঁদের প্রথম সন্তান। গত রোববার সকালে ঢাকার নয়াটোলা মাতৃসদন কেন্দ্রে গাইনি চিকিৎসককে দেখানোর পর আলট্রাসনোগ্রাফীতে পেটের বাচ্চা মৃত বলে জানতে পারেন তাঁরা। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দিনাজপুরে নিজ এলাকায় গিয়ে মৃত বাচ্চা প্রসব করানো হবে। সেই জন্য রোববার সন্ধ্যায় আন্তনগর চিলাহাটী এক্সপ্রেস ট্রেনে রওনা হন স্বামী-স্ত্রী।
কিন্তু ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই নারী। এ সময় ট্রেনের দায়িত্ব পালন করছিলেন পার্বতীপুর হেডকোয়ার্টারের টিটিই আমিরুল হক জাহেদী। রাত ৮টা নাগাদ ট্রেনটি গাজীপুরের মহেড়া স্টেশন পার হওয়ার পর শাহিন আলম নামের এক যাত্রী তাঁকে জানান ‘ঘ’ নম্বর কোচে একজন অন্তঃস্বত্ত্বা গৃহবধূ (মৌসুমী) ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তখন তিনি তাঁর সঙ্গে থাকা গার্ড সিফাত হোসেনকে জরুরি ভিত্তিতে পিএ অপারেটরকে ট্রেনের মাইকে একটা ঘোষণা দিতে বলেন। ঘোষণা দেওয়া হয় ‘ট্রেনের মধ্যে যদি কোনো ডাক্তার থাকেন তাহলে জরুরি ভিত্তিতে ‘ঘ’ কোচে তাকে বিশেষ প্রয়োজন, একজন গর্ভবতী মা ভীষণ অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন।’ মাইকে সেই ঘোষণা শুনে ট্রেনে থাকা ঢাকার ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতালের চিকিৎসক মো. সানাউল্লাহ ‘জ’ কোচ থেকে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যান। এরপর ‘চ’ কোচ থেকে রংপুর কমিউনিটি হাসপাতালের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী আফসানা ইসলাম রোজা সেখানে যান। মাইকিং শুনে দুজন নার্সও দ্রুত ‘ঘ’ কোচে ছুটে যান।
এরই মধ্যে অন্তঃস্বত্ত্বা যাত্রী মৌসুমী আক্তারের রক্তপাত শুরু হয়। ওই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নার্সরা কাজ করেন। ‘ঘ’ কোচের নারী যাত্রীরা নিজেদের কাছে থাকা কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখেন পুরো জায়গাটা। তিন আসনের চেয়ারের সারিটা যেন সেই মুহূর্তে হয়ে যায় অস্ত্রোপচার কক্ষ।
এদিকে ওই নারীর স্বামী রবিউল আউয়াল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একজন যাত্রী জানান, তাঁর পকেটে মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকার মতো ছিল। তাৎক্ষণিক সব যাত্রীরা যে যার মতো টাকা সংগ্রহ করা শুরু করেন। প্রায় ৫ হাজারের মতো টাকা মৌসুমীর স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ‘চিকিৎসক-নার্সসহ সবার সহযোগীতায় আল্লাহর রহমতে ওই নারীর মৃত বাচ্চাটি প্রসব করা সম্ভব হয়। ডা. সানাউল্লাহ সবাইকে আশ্বস্ত করেন রোগী অনেকটা আশঙ্কামুক্ত। রোগীকে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। সেই স্যালাইন, হেক্সিসল, ডেটল যাত্রীরা যার কাছে যা ছিল তা দিয়ে সাহায্য করেছেন।’
টিটিই আমিরুল আরও জানান, সব কিছু যখন অনেকটা স্থিতিশীত, তখন দুশ্চিন্তা শুরু হলো জরুরি ভিত্তিতে কিছু ওষুধ প্রয়োজন। চিকিৎসক ওষুধ লিখে দিলেন। তখন ঈশ্বরদীর টিটিই আব্দুল আলীম বিশ্বাস মিঠুকে ফোন করে বিস্তারিত জানানো হলো। ঈশ্বরদীতে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। তবুও তিনি মোবাইলে প্রেসক্রিপশন পেয়ে নিজেই ওষুধের দোকানে গিয়ে সব ওষুধ কিনে রিকশাওয়ালাকে দিয়ে ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন মাস্টারকে দিয়ে পাঠালেন। পরে ট্রেন স্টেশনে থামলে ওষুধ নিয়ে চিকিৎসকের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। তারপর রোগীকে ওষুধ খাওয়ানো হয়।
পরে রাত সাড়ে ৩টা নাগাদ ওই নারী ও তাঁর স্বামী দিনাজপুরের ফুলবাড়ি স্টেশনে নামেন। আর চিকিৎসক সানাউল্লাহসহ নার্সরা সারা রাত, সারাটা পথ ওই রোগীর পাশে বসেছিলেন। চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করেন শিক্ষানবিস চিকিৎসক আফসানা ইসলাম রোজা, নার্স ফারজানা আক্তার, মুন্নি খাতুন, নার্সিং ইন্ট্রাক্টর রেবেকা সুলতানা, খাদিজা খাতুন নিশা, রুমি ইসলাম। এভাবেই একদল মানবিক মানুষের সহযোগিতায় চলন্ত ট্রেনের মধ্যে বেঁচে যান একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী।
রবিউল আউয়াল জানান, ফুলবাড়ি স্টেশনের নামার পর তাঁর স্ত্রী মৌসুমীকে নিয়ে দিনাজপুর শহরের সিটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে গত সোমবার বিকেলে তাঁকে তাঁর বাবার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে তিনি সেখানে রয়েছেন। চিকিৎসক বলেছেন, ঠিকমতো খাবার গ্রহণ ও কিছুদিন পরিপূর্ন বিশ্রাম নিলে তিনি পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে যাবেন। ভয়ের কিছু নেই।
পুরো ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে রবিউল আউয়াল বলেন, ‘আমি ওই সময় হতভম্ব ছিলাম। ট্রেন কর্তৃপক্ষ, ট্রেনের পুলিশ, বিশেষ করে ওই ডাক্তার সাহেব ও নার্সরা যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়ালেন, তা বলে শেষ করা যাবে না। তারা আমাকে সাহস দিয়েছেন। পাশে থেকে সহযোগিতা করেছেন। এ ঘটনা আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ডাক্তার, নার্সসহ সবার ঋণ কোনোদিন শোধ হওয়ার নয়। মানবিকতা বেঁচে থাক সবার মাঝে।’
জানতে চাইলে মৌসুমী আক্তার বলেন, ‘ওই সময় যে কি পরিস্থিতি হয়েছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। ট্রেনের মধ্যে যখন আমার মৃত বাচ্চাটা প্রসব হলো, তখন মনে হলো নতুন করে জীবন পেলাম। আমি ডাক্তার, নার্সদের হাত ধরে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আল্লাহ মনে হয় আমার জন্যই তাদের পাঠিয়েছিলেন। ডাক্তার নার্স যারা ছিলেন তাদের আমি আমার বাসায় একদিন নিমন্ত্রণ জানিয়েছি। তারা কখনও আসলে আমি খুব খুশি হবো।’
সৌজন্যে- ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি