আগস্ট আমাদের শোকের মাস, দুঃখের মাস, বেদনার মাস; আগস্ট মাস আসলে আমাদের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়, রক্তক্ষরণ হতে থাকে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়তে পড়তে পদ্মা, মেঘনা, তিস্তা, আড়িয়াল খাঁ, গোমতী, মধুমতি, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, কর্ণফুলি ভাসিয়ে ৫৬ হাজার বর্গমাইলে ছড়িয়ে যায়।
পঁচাত্তরের পনের আগস্ট খুনীরা বঙ্গবন্ধুকে নয়, বাংলাদেশকে হত্যা করেছিলো। কেননা বঙ্গবন্ধু তো বাংলদেশেরই অপর নাম; ৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সেই বাংলাদেশ। যে দেশ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করেছিলো।
পাকিস্তানি সৈন্যরা গণহত্যার মিশন নিয়ে বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাঙালি জাতি দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর কবল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। হাজার বছরের মধ্যে বাঙালি জনগোষ্ঠি ছিলো, কিন্তু তার জাতিচেতনা ছিলো না। ফলে জাতিসত্তা হিসেবে সে সুগঠিত ছিলো না। বাংলাদেশ নামে কোন দেশও ছিলো না। বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতিসত্তা জাগ্রত করেন, জাতি হিসেবে বাঙালি জাতিকে সংগঠিত করেন। বাঙালির অভিন্ন ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ছিলো, কিন্তু যে ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে জাতিসত্তার স্ফূর্তি ঘটে, পাকিস্তান হওয়ার পর পূর্ববঙ্গের ভৌগলিক সীমানায় বসবাসকারী বাঙালির জাতি হিসেবে সংগঠিত হবার অবকাশ মেলে। ১৯৬৬ সালে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্বোধন ঘটায়।
পঁচাত্তরের খুনীরা ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, তারা হত্যা করেছিলো বাংলাদেশকে, একটি গোলাপকে। কেননা বঙ্গবন্ধু একজন ব্যক্তি মাত্র ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি আদর্শের প্রতীক, একটি চেতনার নাম। সে আদর্শ বাংলাদেশ, সেই চেতনা বাঙালিত্ব।
তবে খুনীরা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধুর দেহান্ত হলেও তাঁর আদর্শ বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি বেঁচে আছে। বঙ্গবন্ধুর দৈহিক মৃত্যুর ৪৮ বছর পরও আজো বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নিত্য উপস্থিতি, বঙ্গবন্ধু আজো এদেশে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বঙ্গবন্ধু ততদিন বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের মাঝে।
কারা ওরা? মুশতাক, চাষী, ঠাকুর, রশিদ, ফারুক-যাদেরকে আমরা খুনী বলে চিনি, ব্যক্তি পরিচয়ের আড়ালে আসলে কি ছিলো তারা? তারাও একটি আদর্শের প্রতীক, কিংবা তাদেরকে শিখ-ী হিসেবে খাড়া করে আড়ালে বসে যে অট্টহাসি হাসছিলো, ১৫ আগস্টের ভোর রাতে ক্লিন শেভ হয়ে সুটেড বুটেড হয়ে পূর্ণ সামরিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে কিলিং মিশন অ্যাকমপ্লিশ্্ড হয়েছে শুধু এ খবরটা শোনার জন্য যে প্রস্তুত হয়ে উৎকর্ণ হয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় পায়চারি করছিলো, সে জিয়াউর রহমান। ক্ষমতারূঢ় হওয়ার অনেক পরে সে নিজেই জানান দিয়েছিলো, তার আদর্শ ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’, যা আসলে ইসলামি তথা পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদেরই নামান্তর। তার আগে মুশতাক বাংলাদেশের রাষ্ট্রাদর্শ বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’র পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, বাংলাদেশ বেতারকে ‘রেডিও বাংলাদেশ’-এ বদলে দেয়। বঙ্গবন্ধু নয়, বঙ্গবন্ধুর পোশাককেও ঘৃণা করতো মুশতাক, তাই সে কিম্ভুতকিমাকার নতুন এক জাতীয় পোশাকের প্রচলন করতে চেয়েছিলো। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির মধ্যে তিনটি অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রকে একে একে পাল্টে দেয়া হলো। এই মূলনীতিগুলি মুক্তিযুদ্ধেরই অর্জন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং শ্রেণী বৈষম্য ও শোষণভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তে শোষণ-বঞ্চনামুক্ত সমতাভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার ছিলো, তাকেও বিসর্জন দেয়া হলো। এরপর যা থাকলো সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ নামের খোলসে ‘পাকিস্তান’।
মুশতাক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করলো, জিয়া তাকে জায়েজ করলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মোড়কে। আসলে মুশতাক, চাষী ছিলেন ৭১-এ পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর প্রেতাত্মা। মুশতাক, চাষী মুক্তিযুদ্ধেই পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারশেনের প্রস্তাব নিয়ে কম দেন-দরবার করেননি। জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানের সতর্কতা ও দৃঢ়তায় তখন মুশতাক সফল হতে পারেনি। পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের দোসর মুশতাক বঙ্গবন্ধুর কেবিনেটে থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ছুরি শানাতে থাকে এবং বিদেশি শক্তি বিশেষত আমেরিকা, লিবিয়া, সৌদি আরব এবং খোদ পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পনের আগস্ট ট্র্র্যাজেডি ঘটাতে সক্ষম হয়। মুশতাক বহুদিন থেকে তক্কে তক্কে ছিলো। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর বিজয়ে ক্ষুব্ধ আমেরিকা ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে মুশতাককে বড়শিতে গেঁথে তুললো এবং ষড়যন্ত্র সফল করে তোলার জন্য তাকে বাতাস দিতে থাকলো। চাষী মুক্তিযুদ্ধ থেকে মুশতাকের ষড়যন্ত্রের সঙ্গী, নতুন জুটলেন ঠাকুর এবং আরো অনেকে, যাদের নাম ভারতীয় সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত তাঁর লেখা ‘মিডনাইট ম্যাসাকার’ ও ‘মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র’ দুটি গ্রন্থে। সৌদি আরব ও লিবিয়া সমর্থন এবং অর্থ যোগান দেয়। ভুট্টো পরিকল্পনা করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, খুনীরা ৩রা নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল লিবিয়ায়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মুশতাক ক্ষমতায় আরোহনের তার বহুদিনের সাধ পূরণ করলো। পর্দার অন্তরালে থেকে যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ে মদদ যুগিয়েছেন তিনি হচ্ছেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু তাঁকে সেনা প্রধান করেননি, এই রাগ থেকে জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের চক্রান্তে সামিল হন।
মুক্তিযুদ্ধ থেকেই জিয়া এক রহস্যময় চরিত্র। জিয়া দায়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন এবং প্রথম দিকে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা ক্যাম্পে ১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু তার সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ্য করে তাকে ১ নং সেক্টর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়। তিনি ওসমানী সাহেবের প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগের বিরোধিতা করেন এবং তাঁকে প্রধান সেনাপতি পদ থেকে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। খালেদ মোশারফের বিরোধিতার জন্য পারেননি। কামালপুর যুদ্ধে জিয়ার ভুলের কারণে বাংলাদেশ বাহিনীর অনেক অফিসার ও জওয়ান হতাহত হন। সেজন্য জেনারেল ওসমানী তাকে স্যাক করতে চেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি হচ্ছেন জিয়া। তিনি ক্রমান্বয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনা প্রধান এবং অবশেষে প্রেসিডেন্ট হয়ে ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী, আলিম ও মতিনকে মন্ত্রী করার মাধ্যমে একে একে স্বাধীনতা বিরোধীদের পুনর্বাসিত করেন। দালাল আইন বাতিল করে ঘাতক দালাল, রাজাকার, আলবদরদের ছেড়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন বর্জন করেন, রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তর থেকে মুুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ করে দেন।
মুশতাক ও জিয়া বঙ্গবন্ধুর নামোচ্চারণ ও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম নিশানা মুছে দিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও মানুষ যাঁকে হৃদয়ে ধারণ করেছে, অত সহজে কী তাঁকে মুছে ফেলা যায়। মানুষের চেতনায় ঠাঁই নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন চিরকাল। মৃত বঙ্গবন্ধু জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি শক্তিশালী বলে প্রমাণিত হলেন। বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে বাংলাদেশ এমন ছাপমারা যে, বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। বাংলার আকাশ, বাতাস, নদী, হাওর-বাওর, বিল, মাঠ-ঘাট, গাছ, লতাপাতা, ফুল-পাখি, প্রকৃতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মিশে আছেন নিবিড়ভাবে। তাঁকে আলাদা করে খুঁজে নিতে হয় না।
ফলে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা ভেবেছিলো, একাত্তরে পরাজিত ও পরিত্যক্ত পাকিস্তানকে আবার তারা ফিরিয়ে এনেছেন বাংলাদেশে, তারা বোকার স্বর্গেই বাস করছিলেন। তাদেরকে যিনি বধ করবেন তিনি গোকুলে বেড়ে উঠছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর আত্মজা শেখ হাসিনা; বিদেশে থাকার কারণে ৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকদের বুলেট থেকে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যার প্রথমজন, কনিষ্ঠ শেখ রেহানা। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ এবং বেপথু হয়ে যাওয়া পিতার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশকে আবার স্বস্থানে স্বপথে ফিরিয়ে আনার বজ্রশপথ নিয়ে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা ফিরে আসলেন স্বদেশে। প্রথমে পিতার গড়া দল, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন। হতাশ, মনোবলহারা, ছিন্নভিন্ন দলীয় নেতা কর্মীদের সুসংগঠিত করে আওয়ামী লীগে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন। পুনর্গঠিত দলতে নিয়ে তিনি ৯৬ তে এবং ২০০৮ থেক বর্তমান সময় পর্যন্ত নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দেশ শাসনের অধিকারী হয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে এনেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার আসনে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিষ্ঠিত করলেন; তাঁকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণা করলেন, সাংবিধানিকভাবেও তিনি তাই। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের দিনকে জাতীয় শোক দিবস, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস ঘোষণা, ‘জয় বাংলা’-কে জাতীয় স্লোগান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করা; বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেল হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করে স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তির ওপর বাংলাদেশকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। বাংলাদেশকে সোনার বাংলাদেশে পরিণত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত করেন। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে এখন কাজ করে যাচ্ছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ব্রত গ্রহণ করেছেন। করোনা অতিমারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল ও উন্নতির পথে পরিচালিত করতে পারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও বলিষ্ঠতার স্বাক্ষর বহন করে। পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থ যোগান দিতে বিশ্ব ব্যাংক অস্বীকৃত হওয়ার পর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। ঢাকায় মেট্রোরেল এবং চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ শেখ হাসিনার সরকারের অমর কীর্তি।
বাপকা বেটি-বঙ্গবন্ধুর মতই দুর্মর সাহস পেয়েছেন বঙ্গ-দুহিতা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে এ বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের প্রারম্ভে যে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে, সে ব্যাপারে বিদেশিদের বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহ ও কৌতূহল লক্ষ্য করে তিতিবিরক্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অসীম সাহসে ভর করে অবলীলায় বোমা ফাটিয়ে দেন; বলেন- শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশ বিক্রি করবে না। সেন্ট মার্টিন ইজারা দিলে তাঁর ক্ষমতায় থাকার পথে সমস্ত কন্টক দূর হয়ে যায়। কিন্তু তিনি তা করবেন না। বঙ্গবন্ধুর কাছেও মার্কিন দূত ফারল্যান্ড একটি দ্বীপ চেয়েছিলেন। তার মুখের ওপর না করতে বঙ্গবন্ধুকে এক মুহূর্তও ইতস্তত করতে হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক নেতাদের মধ্যে তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও সাধনাকে নিবেদিত করেছেন। সমসাময়িক সমস্যা ও ইস্যু নিয়ে তিনি আন্দোলন-সংগ্রাম করলেও পূর্ববঙ্গকে (পূর্ব পাকিস্তান) স্বাধীন করতে হবে এই কথাটিকে যৌবনের উন্মেষকালে একবার যখন সত্য বলে জেনেছেন, জীবনে আর কোনো দিন এক মুহূর্তের জন্য সেকথা বিস্মৃত হননি। সেজন্যই তিনি বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য ভারতীয় সাহায্য চাইতে অন্তত তিনবার (১৯৬১, ১৯৬২ সালে দু’বার এবং আরেকবার সম্ভবত আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর) আগরতলা গেছেন বঙ্গবন্ধু। সিলেটের মোয়াজ্জেম চৌধুরীরা নেতাজী সুভাষ বসুর স্টাইলে বঙ্গবন্ধুকে ভারতের মধ্য দিয়ে লন্ডন নিয়ে গিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চালাতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালে সে সময় ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনে কর্মরত কূটনীতিক এস এস ব্যানার্জীর মাধ্যমেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সাহায্য চেয়ে।
১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য পূর্ববঙ্গ মুক্তিফ্রন্ট একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এমন তথ্য পাওয়া যায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের বইতে। তিনি জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু তাঁকে উক্ত সংস্থার নামে মুদ্রিত কিছু লিফলেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল এবং আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিলি করার জন্য দিয়েছিলেন। তিনি লিফলেটগুলি শেখ ফজলুল হক মণিকে দিলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের বিভিন্ন রুমের দরজার নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।
তারও আগে ১৯৬০ সালে দিল্লির সাউথ ব্লকে পাকিস্তান ডেস্কে কর্মরত একজন গোয়েন্দা চট্টগ্রামে এসেছিলেন। তিনি পতেঙ্গা সৈকত, হালিশহর ইত্যাদি এলাকা পরিদর্শন করে নোয়াখালী চলে গিয়েছিলেন। এটিও বঙ্গবন্ধুর একটি স্বাধীনতা প্রচেষ্টার অংশ। উক্ত গোয়েন্দার নাম রাজ নির্মল নারায়ণ চৌধুরী। তার বাড়ি নোয়াখালী। তিনি ‘র’ চিফ রামনাথ কাও’র সহকারী ছিলেন। তার সফরের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ ও পরবর্তী কালে আগরতলা মামলার আসামি মানিক চৌধুরী উক্ত গোয়েন্দার সঙ্গে ছিলেন।
এসব ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু কত মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬২ সালে ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমদ ও আবদুর রাজ্জাক কর্তৃক ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত গোপন সংগঠন নিউক্লিয়াসকে স্বাধীনতার জন্য আদি গোপন বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা হিসাবে বর্ণনা করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় কোন কোন মহলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তারও আগে থেকে স্বাধীনতার জন্য গোপনে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেটা আমরা ইতিমধ্যে দেখিয়েছি। স্বাধীনতা চিন্তা ও স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র গোপন বৈপ্লবিক প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন সকলের চেয়ে এগিয়ে।
তাঁর রাজনীতি ও সংগ্রামকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়–একটি স্থানিক ও সাময়িক, আর একটি স্থায়ী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তাঁর রাজনীতির চিরস্থায়ী ও চিরসত্যকথা। এ কারণে পঞ্চাশের দশকে সাতচল্লিশে দেশভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে যখন রাজনীতি আরম্ভ করছেন, তখন বিরোধী নেতৃবৃন্দের মধ্যে ঢাকায় রাজধানীর নিয়ন্তা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনেক পূর্ববর্তী নেতা শের-ই- বাংলা এ কে ফজলুল হক, তাঁর সাক্ষাৎ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, কমরেড মনি সিং প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক নেতা ছিলেন অলি আহাদ, খোন্দকার মুশতাক আহমদ, অধ্যাপক মোজফফর আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ।
৭০ সালে এ কে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দী ছাড়া অন্য সকল নেতাই ছিলেন জীবিত। কিন্তু তাঁরা কেউ জনপ্রিয়তায় বঙ্গবন্ধুর ধারে কাছেও ছিলেন না। জনপ্রিয়তায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব তখন এত উচ্চতায় উপনীত হয়েছিলো যে, শুধু হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্ঘ এভারেস্ট-এর সঙ্গে তাঁর তুলনা হতে পারতো। বঙ্গবন্ধুর তুলনায় অন্য নেতাদের মনে হচ্ছিলো বামন। এ কারণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীনতার মহানায়ক।
বাঙালি জাতিসত্তা নির্মাণ এবং জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বঙ্গবন্ধুর মহত্তম কীর্তি। বাংলাদেশ নামে কোনো অখ- রাষ্ট্র কখনো ছিলো না। বঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্র, সমতট, হরিকেল ইত্যাদি নানা স্বাধীন বিচ্ছিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিলো পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে বাংলা মুুলুক নামে পরিচিত ভূখ-টি। ব্রিটিশ শাসনামলে বিচ্ছিন্ন জনপদ বা স্বাধীন রাজ্যসমূহকে একীভূত করে অখ- বাংলার সৃষ্টি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের চেষ্টা বাঙালির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে ভেস্তে যায়। ১৯৪৭-এ অখ- বাংলাকে দ্বিখ-িত করে পূর্ববঙ্গকে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাতচল্লিশের বাংলা ভাগের মূলে ছিলো জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের তাড়না। জিন্নাহ সাহেব বাঙালি জাতির প্রধান দুই উপাদান হিন্দু ও মুসলমানকে দুই জাতি হিসেবে বর্ণনা করে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও ধর্ম কখনো জাতীয়তার ভিত্তি হতে পারে না। তা সত্ত্বেও জিন্নাহ সাহেব হাজার মাইলের ব্যবধানে বসবাসকারী মানুষ, যাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এমনকি গাত্রবর্ণও ভিন্ন ভিন্ন, শুধুমাত্র ধর্ম বিশ্বাসে ছিল অভিন্ন, তাদেরকে ধর্মের রুজ্জুতে গেঁথে একটি আজব রাষ্ট্র গঠন করলেন যাকে বলা হলো, পাকিস্তানি জাতীয়তা। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দেশটির জন্মের সাড়ে চার মাস পর বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করে পাকিস্তানি জাতীয়তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন। ছাত্রলীগ গঠন ছিল একটি মেয়াদী বোমা, যা ৭১-এর ২৬ মার্চ বিস্ফোরিত হয়ে পাকিস্তানকে খানখান করে দিয়েছিলো।
যাই হোক, জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানে মুসলিম জাতীয়তাবাদ কায়েম করলেন। বঙ্গবন্ধু জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের বিপরীতে একজাতিতত্ত্বের ধারণা উপস্থিত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রবর্তন করেন। তিনি বললেন ধর্মের ভিত্তিতে কোন জাতি হতে পারে না। অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য জাতি গঠনের আবশ্যকীয় শর্ত। সাতচল্লিশে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলে এই ভৌগোলিক সীমার মধ্যে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তার উপাদান দেখতে পেলেন এবং বাংলাদেশের যে ছবি তিনি মনে মনে কল্পনা করতেন, পূর্ববঙ্গের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে তার সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করেন। অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে জাতীয়তা নির্মাণে সচেষ্ট হলেন। পূর্ববঙ্গকে (তখনও পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানের উপনিবেশের মত শোষণ এবং উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মত ব্যবহার দেখতে দেখতে অভিমানাহত বাঙালি জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে আরম্ভ করে। ষাটের দশকে বাঙালি জনমনে ধূমায়মান অসন্তোষের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেয়। ৬ দফার মধ্যে নিহিত স্বায়ত্বশাসনের দাবি বাঙালির মুক্তিসনদ হিসেবে প্রতিভাত হয়। ৬ দফা মানতে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠির অস্বীকৃতি থেকে বাঙালি স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
অতঃপর ৭০-এর নির্বাচনে বাঙালি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী করে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদান করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী গণরায় মানতে অস্বীকার করে বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু বাংলদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতিকে পাকিস্তানি হানাদারদের বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করার আহ্বান জানালে জাতি মুুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ রাতে তাঁর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। বাংলাদেশে যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী হেরে যাওয়ায় পাক সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন।
জিয়া প্রসঙ্গে আবার একটু বলতে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়ার সংশ্লিষ্টতার একটি বড় প্রমাণ সম্প্রতি দিয়েছেন ভারতীয় কূটনীতিক এসএস ব্যানার্জী। তিনি এক সময় ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৬২ সাল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাক্ষী এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের কালে তিনি লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনে কর্মরত ছিলেন। সর্বোপরি পাকিস্তানে বন্দি দশা থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসছিলেন, তখন নিঃসঙ্গ বিমান যাত্রায় বঙ্গবন্ধুর একমাত্র সঙ্গী হওয়ারও সৌভাগ্য অর্জন করেন ব্যানার্জী। সুতরাং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর মত অভিজ্ঞতা খুব কূটনীতিকেরই আছে। কূটনৈতিক পেশা থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি শুধু বাংলাদেশ প্রসঙ্গে দু’টি বই লেখেন-একটি ইংরেজিতে, একটি বাংলায়। ইংরেজিতে লেখা বইয়ের শিরোনাম -“ওহফরধ, গঁলরনঁৎ জধযসধহ, ইধহমষধফবংয খরনবৎধঃরড়হ ্ চধশরংঃধহ” বাংলায় লেখা বইয়ের শিরোনাম-‘ভারত, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান’ (অজানা তথ্য)। শেষোক্ত বইয়ে ব্যানার্জী লিখেছেন ১৯৭৩ সালের একটি ঘটনা। নবগঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ আর্মি স্টাফ কর্নেল জিয়াউর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৭৩ সালের শুরুতে ওয়াশিংটনে পাঠান। বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সূত্রে আইএসআই এবং মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের কোন কোন কর্মকর্তার সঙ্গেও হয়তো তাঁর জানাশোনা ছিলো। সেজন্যই বঙ্গবন্ধু জোট থেকে বেরিয়ে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সুতো সেলাইয়ের কাজটি জিয়াকে দিয়ে করাতে চেয়েছিলেন।
জিয়াউর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে পেন্টাগন, সিআইএ এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর প্রধানদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করেন।
যুক্তরাষ্ট্র সফরে তার দায়িত্ব পালন শেষে তিনি ঢাকায় ফেরার পথে লন্ডনে কিছুদিন যাত্রাবিরতি দেন। আর লন্ডনে এই যাত্রাবিরতির সময়েই জিয়াউর রহমান এস এস ব্যানার্জির সাথে দেখা করতে যান। ব্যানার্জি তখন লন্ডনে ভারতীয় হাই কমিশনের এ্যাটাশে হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনার সৈয়দ আবদুল সুলতানের মাধ্যমে একটি মেসেজ পেয়ে ব্যানার্জি নটিংহীল গেইটে হাইকমিশন অফিসে জিয়ার সাথে দেখা করেন। মিটিং-এর উদ্দেশ্য ছিলো ফারুক রহমানের একটি সুটকেস ও কর্নেল ব্যাটন ফেরত নেয়া যা ব্যানার্জীর বাসায় ছিলো। ফারুক সৌদি সামরিক বাহিনীর ট্রেনিং অফিসার হিসেবে সৌদি আরবে ছিলেন। ২৫ মার্চ যখন বাংলাদেশে টিক্কা খান গণহত্যার নির্দেশ দেন, তখন ফারুক লন্ডন সফরে ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার আগে তার সুটকেস ও রেজিমেন্ট ব্যাটন ব্যানার্জীর কাছে রেখে যান। ব্যানার্জী লিখছেন-“এই স্যুটকেসটি জিয়াউর রহমানের সাথে আমার সিরিয়াস একটি আলোচনা শুরু করিয়ে দেয় প্রধানমন্ত্রী মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ে। ভারতে চলমান গুজব যে মুজিবুর রহমানকে হত্যার বিষয়টি নিলামে উঠেছে। এই বিষয়টির প্রেক্ষিতে আমাদের আলোচনা হয়েছিল। আলোচনার মাঝখানে আমি নিজে বোঝার তাগিদে কর্নেল জিয়াউর রহমানের কাছে অনুমতি চাইলাম তাকে একটা বা দুটো অপ্রিয় প্রশ্ন করর। আমি তাকে বললাম যে শেখ মুজিবের জীবন নিয়ে আমার শঙ্কা ব্যক্তিগত, কারণ আমরা বেশ দীর্ঘদিন পুরোনো বন্ধু। তিনি বললেন যে হাই কমিশন বিষয়টি তাঁকে জানিয়েছে।
অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে প্রশ্ন করার আগে আমি তাকে বললাম যে প্রশ্নের জবাব দিতে আরাম বোধ না করলে তাকে কিছুই বলতে হবে না। তারপর জানতে চাইলাম ছয় সপ্তাহের ওয়াশিংটন সফরে তিনি কার কার সাথ দেখা করেছেন? তিনি আমাকে বললেন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ডিফেন্স সেক্রেটারি থেকে শুরু করে নিচের দিকের অনেক সিনিয়র অফিসিয়ালের সাথে দেখা করেছেন। আমি আরো জানতে চাইলাম যেহেতু তিনি তার পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে, তাই পুরোনো দিনের কথা ভেবে তার নিশ্চয়ই ইচ্ছে করছিলো ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের মিলিটারি এ্যটাশের সাথে দেখা করার? প্রথমে কিছু দ্বিধা করলেও তিনি সায় জানালেন।
অনেকখানি নার্ভাস থাকলেও আমি সরাসরি আসল বিষয়ে চলে এলাম। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম যে উপমহাদেশে রাজনৈতিক আবহাওয়া যখন কালো মেঘে ঢাকা এবং মুজিবকে হত্যার সম্ভাব্য তৎপরতা চলছে তখন ছয় সপ্তাহের জন্য দেশের ডেপুটি চিফ অফ আর্মি স্টাফকে দেশের বাইরে পাঠানো কি প্রয়োজনহীনভাবে সমস্যা ডেকে আনা নয়? আমি অবশ্য প্রথমেই তাকে বলে নিয়েছিলাম যে আমি একটি তাত্ত্বিক পরিস্থিতি বিচার করছি, ব্যক্তিগত নয়। আমি যখন দেখলাম তিনি মনক্ষুন্ন নন আমি জানতে চাইলাম তার মতো একজন মানুষ যদি কেনো ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির অপারেশনাল প্রধান হন তবে কি তিনি এই সম্ভাবনা বিচার করবেন না যে যখন একজন যোগ্য প্রার্থী হাতে আছে তখন ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের বিরক্তি উৎপাদনকারী ঝামেলার ব্যক্তিকে সরিয়ে দেয়া যায়। চিলির সালভাদর আলেন্দেকে হত্যা একটি বিষয় ছিল, আর ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের মিলিটারি এ্যটাশের সাথে দেখা করা ছিল আরেকটি। তিনি একজন পরিণত কূটনীতিকের মতই আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন। তিনি বেশ হাসতে হাসতে বললেন এভাবে ভাবতে পারছি কারণ আপনার আসলেই একটি উর্বর মস্তিষ্ক আছে। তিনি সাথে সাথই মিটিং শেষ করে দিতে পারতেন কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি তা করেননি।
আমি জানতে চাইলাম একজন উচ্চপস্থ আর্মি অফিসারের জায়গা থেকে ফারুক রহমানের মত অধিনস্ত কর্মচারীর স্যুটকেস নেবার মত তুচ্ছ কাজ কেন করেছেন তিনি? আমি মনে মনে ভাবলাম তবে কি তিনি কোন একটি ভালো সময়ে বিশাল কোন অপারেশনে ব্যবহারের জন্য ফারুক রহমানের গুটিটি তৈরি রাখছেন? তবে কি কোন বৃহত্তর পরিকল্পনা আছে? পাকিস্তানি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষিত, সামরিক একনায়কদের ভূমিতে লালিত হওয়ায় খুব বেশি কি কল্পনা করা হয়ে যায় যদি ভাবি যে তারও হয়তো গোপন উচ্চাকাক্সক্ষা আছে সামরিক কু’র মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার? গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন নেতাকে হত্যা করার বিষয়টি এমন একজনের মাথায় আসতেই পারে।
পাকিস্তানি মিলিটারি এ্যটাশের সাথে তার কি কথা হয়েছিলো জানতে আমার খুব কৌতুহল হচ্ছিল কিন্তু যখন আমি দেখলাম যে সে বিষয়ে কথা বলতে তিনি খুব নার্ভাস হয়ে যাচ্ছেন তখন আমি আর কথা বাড়ালাম না।”
জিয়া ব্যানার্জীর সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশগ্রহণ করেন এবং ফারুকের সুটকেসটি সংগ্রহ করে নিজে তা বহন করে রেস্টুরেন্ট থেকে পাশের দালানের হাই কমিশন অফিস পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন। এরপর ব্যানার্জী যা লিখেছেন, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
তাঁর লেখা উদ্ধৃত করছি-“বাংলাদেশের ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ কর্নেল জিয়াউর রহমানের সাথে লন্ডনে আমার সাক্ষাতের বিষয়বস্তু নিয়ে এবং তার সম্পর্কে আমার মতামতসহ একটি রিপোর্ট খুব দ্রুত তৈরি করে আমি দিল্লি পাঠাই। আমি আমার আশঙ্কা নিয়ে কোনো শব্দ সাজাইনি। এটি শুধুমাত্র দেখার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে পাঠানো হয়। মুজিব এর জবাবে বলেন, ‘জিয়াউর রহমান আর ফারুক রহমানের মত ছেলেরা আমার নিজের ছেলের মতো। আর ছেলেরা কখনও পিতা-মাতাকে হত্যা করে না’। অন্যান্য অনেক গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও মুজিবের জীবন সংক্রান্ত বিষয়ে একই রকম তথ্য আসছিলো। কিন্তু তিনি এসব বিশ্বাস করতে রাজি ছিলেন না এবং তাঁর এবং তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তাবও গ্রহণ করেননি।…
মনে রাখতে হবে ১৯৭৩ সালে লন্ডনে জিয়াউর রহমানের সাথে আমার আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল কর্নেল ফারুক রহমান। আমি জানি না কেন যেন আমার মনের খুব গভীরে এই লোকটা সম্পর্কে একটি নোংরা মনোভাব তৈরি হয়েছিল যে মুজিব হত্যার জন্য কর্নেল জিয়াউর রহমান কর্নেল ফারুক রহমানকে ব্যবহার করে কোন বড় অপারেশনের পরিকল্পনা করছেন। আর কিভাবে সেই ভয় সত্যি হয়ে গেল। আমার জীবনের সবচেয়ে অনুতাপ মৃত্যুর দিন পর্যন্ত আমাকে ভোগাবে যে আমার সাবধানতা সত্ত্বেও মুজিব আমার উপদেশ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেননি, পরিণতিতে আমি মুজিবের মূল্যবান প্রাণ বাঁচাতে পারিনি। যখন দেশের তাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তখনই তিনি সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। মানুষের কল্যাণে তিনি তার সবটুকু করতে তৈরি ছিলেন। যখন আমি ফারুক রহমান ও শরিফুল ডালিমের হাতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর পাই, তখন আমার মনে হয় মানুষ এত নিষ্ঠুর আর দয়ামায়াহীন কিভাবে হতে পারে।” (এস এস ব্যানার্জী : ভারত, মুজিবুর রহমান, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান (অজানা তথ্য), সঞ্চিতা (অপরাজিতা সাহিত্য ভবন : ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ), ৩য় মুদ্রণ, ২০১৯, পৃ. ১৯১-১৯৬)।