একুশে পত্রিকার সম্পাদক আজাদ তালুকদার আর নেই। বুধবার (২ আগস্ট) ভোররাত ৩ টা ৪৫ মিনিটে রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৫ বছর। তিনি দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
সাংবাদিক আজাদ তালুকদারের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে শোক প্রকাশ করেন। অনেকে ছুটে যান হাসপাতালে।
সাংবাদিক আজাদ তালুকদারের প্রথম জানাজা বুধবার বাদ যোহর নগরীর জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জানাজা শেষে আজাদ তালুকদারকে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে নেওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে আসরের নামাজের পর গ্রামের বাড়ি রাঙ্গুনিয়ার পদুয়া মাদ্রাসা মাঠে তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজার আগে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আজাদ তালুকদারের স্মৃতিচারণ করে পদুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর বলেন, আজাদ তালুকদারকে নিয়ে গর্ব করি। কেননা আজাদ তালুকদার আমাদের এ মাটির সন্তান। সাংবাদিক আজাদ তালুকদার তাঁর সাহসী লেখনির মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতেন। অসত্যের বিরুদ্ধে তাঁর কলম চলত অশ্বগতিতে। তিনি শুধু সাংবাদিকতা নয় সমাজসেবা ও সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলেছেন। খায়ের জাহান ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে নিজ এলাকার মানুষের চিকিৎসা সেবা করেছেন। চেষ্টা করেছেন নিজ উপজেলা রাঙ্গুনিয়ার মানুষের উপকার করতে, সেবা করতে। পুরো জীবনভর তিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন।
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ভাই এরশাদ মাহমুদ বলেন, সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায় হয়েছে আজ। তাঁর বিদায় এতো তাড়াতাড়ি হওয়ার কথা ছিলো না। এ নক্ষত্রের কাছ থেকে দেশ ও সমাজের আরও বহু উপকার পাওয়ার কথা ছিল। তাঁর কর্মে এই দেশ, এই সমাজ ধারাবাহিকভাবে উপকার পাচ্ছিল। এ নির্ভিক কলম যোদ্ধার চির প্রস্থান, চলে যাওয়া আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আজাদ তালুকদারের সঙ্গে ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদের সম্পর্ক। তাঁর মতো সহজ-সরল, উপকারী মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি। তাঁর মৃত্যুতে আমি দুঃখিত।
এরশাদ মাহমুদ আরও বলেন, আজাদ তালুকদারের কাছ থেকে আমাদের এই সমাজের যতটুকু পাওয়ার ছিল তার পুরোটা আমরা নিতে পারিনি। আমরা যদি এই সমাজের জন্য ছোট ছোট উপকার করি তাহলে আমরাও আজাদ তালুকদার এর মতো বেঁচে থাকব মানুষের মাঝে।
রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার মেয়র শাহজাহান সিকদার বলেন, একুশে পত্রিকা সম্পাদক আজাদ তালুকদার একজন ক্ষনজন্মা পুরুষ। তিনি একজন নির্ভিক, সাহসী ও আদর্শিক সাংবাদিক ছিলেন। আমরা যতটুকু জানি তার চেয়েও বেশি নির্ভিক সাংবাদিক ছিলেন তিনি। সাহসী, আদর্শিক এ ধরনের পুরুষ বাংলার ঘরে ঘরে আরও জন্ম নিক সেই প্রত্যাশাই করি আমরা।
জানাজায় অংশ নেন, রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আতাউল গনি ওসমানী, চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ইদ্রিস আজগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নুরুল আজিম সিকদার, প্রয়াত আজাদ তালুকদারের বড় ভাই শাহাদাত হোসেন তালুকদার প্রমুখ।
নামাজে জানাজা শেষে সন্ধ্যা ৬টার দিকে তাকে বাবার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন সভাপতি তপন চক্রবর্তী ও সাধারণ সম্পাদক ম. শামসুল ইসলাম।
আজাদ তালুকদার ১৯৭৮ সালের ২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার উত্তর পদুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মৃত খায়ের আহমেদ তালুকদার, মা মৃত জাহান আরা বেগম। তাঁর বাবা খায়ের আহমেদ তালুকদার কর্ণফুলী পেপার মিলসের প্রাক্তন কর্মকর্তা; তিনি দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়ায় মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রথম শিক্ষিত ব্যক্তি। ১৯৪৯ সালে রাঙ্গুনিয়া হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন, ১৯৫১ সালে কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে কিছুদিন কর্ণফুলী পেপার মিলস, পাকিস্তানের করাচির বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এরপর নিজ এলাকা রাঙ্গুনিয়ায় নিজের সর্বস্ব দিয়ে সমাজসেবা ও জনহিতকর কাজে জড়িয়ে পড়েন। যুক্ত হন বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায়। ২০০৬ সালের ৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।
আজাদ তালুকদারের মা জাহান আরা বেগম ১৯৭০ থেকে একটানা ১৫ বছর পদুয়া ইউনিয়ন পরিষদে জনপ্রতিনিধি (ইউপি মেম্বার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সত্তরের দশকের পর চারদেয়ালে যখন বন্দি নারীজীবন, ঘর থেকে নারীদের বের হওয়াকেই যেখানে ‘অন্যায়’ এবং ‘পাপ’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো তখনই জাহান আরা বেগম জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব নিয়ে নারীমুক্তি, নারীঅধিকারের কথা বলেছিলেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৫ সাল থেকে বন্দরনগরীতে সাংবাদিকতা করে আসছেন আজাদ তালুকদার। তিনি এর আগে একাত্তর টিভি, বৈশাখী টিভি, একুশে টিভি ও আন্তর্জাতিক ফিচার সংস্থা-সান ফিচার সার্ভিসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। এছাড়া কপ-১৭ (ডারবান), কপ-১৮ (দোহা), কপ-১৯ (ওয়ারশো) কাভার করার পাশাপাশি পেশাগত প্রয়োজনে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তরান্বিত করতে আজাদ তালুকদার গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন অনুসন্ধিৎসু তথ্য-উপাত্ত। একাত্তর টিভিতে ‘রাজাকারের রোজনামচা’ শীর্ষক ডকুমেন্টারি তৈরিতে সারথী হয়েছেন তিনি। ২০১৩-১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের আগুন-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একাত্তর টিভিতে সংবাদ প্রচার ও টক-শোতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে তাদের বিভিন্ন হুমকি ও হামলার শিকার হয়েছেন আজাদ।
করোনার সংক্রমণ শুরুর পর ২০২০ সালে মাত্র ১৪ দিনে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল ‘চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতাল’ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আজাদ তালুকদার। করোনাকালে সবাই যখন চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে চিন্তার অস্থির, তখনই তাঁরা করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন। বাঙালি জাতির মুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন সাবেক কর্মী ও সাংবাদিক হিসেবে মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই এমন উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনিও।
২০০৪ সাল থেকে একুশে পত্রিকা সম্পাদনার পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, সাফল্য নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠান নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আজাদ তালুকদার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশ কিছুদিন আগে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। ব্যয়বহুল বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও কেমো নেয়ার মাধ্যমে দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নেন একুশে পত্রিকা সম্পাদক আজাদ তালুকদার।
সম্পাদক আজাদ তালুকদারের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে চিকিৎসায়ও সহায়তা করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।