জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশে ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টারি ফর্ম বা সংসদীয় রীতির রাষ্টপ্রধান ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে সেখান থেকে সংবিধানে পরিবর্তন এনে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা চালু করা হয়। তবে সামরিক রাষ্ট্রপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার পর আবার সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় ফিরে আসে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খুবই সীমিত। শর্তসাপেক্ষে তিনি নিজ থেকে শুধু দু’টি কাজ করতে পারেন, তা হলো প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ করা। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কিছুই করতে পারেন না।
এরপর থেকে রাষ্ট্রপতি পদ অনেকটা আলংকারিক থাকলেও কোন কোন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতিতে নিজ ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত এবং ভুমিকা নিতেও দেখা গেছে। তাতে কখনো কখনো সংকটের সমাধান হয়েছে, কখনো সংকট আরও ঘনীভূতি হয়েছে। আবার কখনো সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার মূল্য চুকাতে হয়েছে।
বাংলাদেশের এরকম কয়েকটি ঘটনার দিকে ফিরে তাকিয়েছে বিবিসি বাংলা।
রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধানের মুখোমুখি দ্বন্দ্ব
আওয়ামী লীগের প্রবল আন্দোলনের মুখে সংবিধান সংশোধন করে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজন করা হয়েছিল।
সেই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. হাবিবুর রহমান।
নিয়ম অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের পরামর্শ অনুযায়ী তখনকার রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের ভূমিকা রাখার কথা। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির হাতে রাখা হয়েছিল।
সেই সময় সেনাবাহিনীর দুইজন শীর্ষস্তরের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সেনাবাহিনীর চীফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমকে নির্দেশ দেন।
‘আমি জেনারেল নাসিম বলছি’ বইয়ে মি. নাসিম উল্লেখ করেছেন, টাঙ্গাইলে ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকা সফর শেষে ঢাকায় আসার পর দুই কর্মকর্তার অবসরের কাগজ তার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। তিনি রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ পাওয়ার চেষ্টা করলে পরদিন তাকে সময় দেয়া হয়।
রাষ্ট্রপতি তাকে বলেন, তাদের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র এবং একটা রাজনৈতিক দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কিন্তু মি. নাসিম সেই নির্দেশ প্রত্য্যাখ্যান করেন। এরপর রাষ্ট্রপতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সেই কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করেছিলেন।
রাষ্ট্রপতির সেই আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন সেনাপ্রধান মোহাম্মদ নাসিম। তিনি তার অনুগত সৈন্যদের সংগঠিত করার চেষ্টা করলে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে তাকে গৃহবন্দী এবং চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। নতুন সেনাপ্রধান করা হয় মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমানকে।
সেই সময় সারা দেশে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। কারণ বগুড়া ও ময়মনসিংহ সেনানিবাসের সৈন্যরা সেনাপ্রধান নাসিমকে সমর্থন করেছিলেন। অন্যদিকে ঢাকা ও সাভার সেনানিবাসের সৈন্যরা রাষ্ট্রপতির অনুগত ছিল।
তখনকার যশোর সেনানিবাসের জিওসি, বর্তমানে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইব্রাহিম (অবসরপ্রাপ্ত) বিবিসি বাংলার আকবর হোসেনকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘’১৯৯৬ সালের মে মাসের ২০ তারিখ বাংলাদেশে একটা সংকট হয়েছিল। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বীরবিক্রম একদিকে, অপরদিকে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস- তাদের মধ্যে সংঘাত।‘’
সেনাপ্রধানের নির্দেশে যেমন সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল ভূমিকা রাখতে শুরু করে, অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে সেনাবাহিনীর অন্য ইউনিটগুলো অবস্থান নিতে শুরু করে।
এমন পরিস্থিতি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতির সমাধান করা হয়। সেনাপ্রধান মোহাম্মদ নাসিম এবং তার অনুগত কর্মকর্তাদের অবসর দেয়া হয় বা বরখাস্ত করা হয়।
বিতর্কিত আইনে স্বাক্ষর করেননি রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ
উনিশশো ছিয়ানব্বই সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে সরকার গঠন করেছিল।
বিএনপি মনোনীত রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নির্দলীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের নাম প্রস্তাব করে আওয়ামী লীগ।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ।
সেই সময় রাষ্ট্রপতিই ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তবে ৬ই অগাস্ট সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হয়।
উনিশশো ছিয়ানব্বই সালের জুলাইয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ। কিন্তু পরবর্তীতে নানা বিষয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা যায়।
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর জননিরাপত্তা আইন নামের একটি বিতর্কিত আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সই করতে অস্বীকৃতি জানান।
সেই কারণে তাঁর সাথে তৎকালীন সরকার এবং আওয়ামী লীগের তিক্ততা তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই সম্পর্কে আর উন্নতি হয়নি।
সেই সময় জননিরাপত্তা আইন বিল আকারে সংসদে তোলা হয়। সেখানে কোন অভিযুক্তকে জামিন দেয়া যাবেনা সহ আরও কয়েকটি কঠোর বিধান ছিল। ফলে আইনটি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।
কিন্তু সংসদে সেটিকে অর্থবিল হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, অর্থবিল রাষ্ট্রপতির সামনে স্বাক্ষরের জন্য উপস্থাপন করা হলে রাষ্ট্রপতি কোন মতামত বা অসম্মতি জানাতে পারেন না।
কিন্তু পরে যখন এ নিয়ে সরকারি দল বলতে শুরু করে যে, রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর করেছেন, তখন সাহাবুদ্দিন আহমেদ একটি বিবৃতিতে জানন, অর্থবিল হিসাবে তার সামনে উত্থাপন করায় সাংবিধানিকভাবে এতে স্বাক্ষর না করে তার কোনো উপায় ছিল না।
দুই হাজার ষোল সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন যে, রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারি প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে চাওয়ায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি।
“উনি নিজেকে যতদূর সম্ভব সরকারি বাধা-নিষেধের প্রভাব মুক্ত করে কিছু কথা বলেছিলেন, দেশের কল্যাণের জন্য। এই ধরণের কথা তিনি বলেছিলেন এবং কাজ তিনি করেছিলেন,তাতে পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিছুটা রূষ্টই হয়েছিল,” বলেছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দূরত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, একসময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন যে, রাষ্ট্রপতি চাইলে পদত্যাগ করতে পারেন, সেই স্বাধীনতা তার আছে।
দুই হাজার একুশ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ার পর দলটির নেতারা সাহাবুদ্দিন আহমদের ওপরেও দায় চাপিয়েছিলেন।
দুই হাজার দুই সালের চৌঠা জানুয়ারি একটি প্রতিবাদ লিপিতে সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ লিখেছিলেন, ‘’আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে জেতানোর মুচলেখা দিয়ে আমি রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করিনি ….তাদের সব কথা শুনলে আমি ফেরেশতা, নইলে আমি শয়তান। … হেরে যাওয়ার পর তারা আমাকে নির্বাচন বাতিল করে রাষ্ট্রপতির অধীনে পুনরায় নির্বাচন করার অনুরোধ করেন। আমি তাতে রাজি হইনি।‘’
কবর জিয়ারত ঘিরে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত আরেকটি ঘটনা রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পদত্যাগ করা।
দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব নেয়ার সাত মাসের মাথায় তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
দু’হাজার দুই সালের জুন মাসে বিএনপির সংসদীয় দরের বৈঠকে অনেক সদস্য রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পদত্যাগের দাবি করেন। তা না হলে তাকে ইমপিচ করার হুমকি দেন। সেই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াও উপস্থিতি ছিলেন।
তাদের ক্ষোভ ছিল মূলত দুটি কারণে।
প্রথমতঃ রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী কর্তৃক বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে না যাওয়া, আর দ্বিতীয়তঃ জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা।
পরদিন বিএনপির তৎকালীন চিফ হুইপ খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের স্বাক্ষর করা একটি চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়, যেখানে তাকে পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়।
সেদিন এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া সংসদ ভবনে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। সেখানে তিনি মন্তব্য করেন, “রাষ্ট্রপতি দলের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছেন, তা ক্ষমাহীন ব্যাপার। ভুলেরও একটা মাত্রা আছে। তিনি সে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন।”
মাত্র সাত মাস সাত দিনের মাথায় রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে কেন বিদায় নিতে হয়েছিল, তার নানাবিধ কারণ উল্লেখ করে তখন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল।
যেসব কারণের কথা ওইসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে:
* জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর সমাধিতে রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা নিবেদন না করা।
* রাষ্ট্রপতির বাণীতে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা।
* বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাকে মুন্সিগঞ্জে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপতির ছেলে এবং সংসদ সদস্য মাহী বি. চৌধুরীর তোরণ নির্মাণ।
* রাষ্ট্রপতির বিভিন্ন বক্তব্যে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ব্যবহার না করা, কারণ ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বিষয়টি বিএনপি রাজনৈতিকভাবে ধারণ করে।
* ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আফতাব আহমদকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ সংক্রান্ত ফাইল রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর না করা। অধ্যাপক আফতাব আহমদের নাম প্রধানমন্ত্রীর দফতর অনুমোদন করেছিল। রাষ্ট্রপতি সেই ফাইলে স্বাক্ষর না করায় পরবর্তীতে আফতাব আহমদকে বাদ দিয়ে অধ্যাপক জিন্নাতুননেসা তাহমিদা বেগমকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
* দলের মনোনীত হয়ে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মি. চৌধুরীর নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়া।
* সেনাবাহিনীসহ কয়েকটি বিষয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণ করেন রাষ্ট্রপতি।
তবে ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, “প্রথম কথা আমি দলের বিরুদ্ধে কোন কাজ করি নাই, আর দ্বিতীয়তঃ আমি তো দলে ছিলামই না! আমি তো নির্বাচনের আগেই পদত্যাগ করে এসেছি, সুতরাং আমি দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে যেভাবে কাজ করা উচিত ছিলো সেভাবেই কাজ করেছি।”
রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধান উপদেষ্টা, আবার স্বস্থানে ফেরত
দু’হাজার এক সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা কয়েক দফা সংবিধান সংশোধন করেছিল।
তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত ছিল ২০০৪ সালের ১৬ই মে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর নেয়ার বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ করা।
তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ অভিযোগ তোলে যে, বিএনপি তাদের পছন্দসই ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা করার জন্য এই পরিবর্তন করা হয়েছে।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কে. এম. হাসান অবসরের পরে যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে নিয়োগ পান, সেই জন্যই ওই পরিবর্তন করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে। তাদের বক্তব্য ছিল, কে. এম. হাসান ‘বিএনপির লোক’।
তিনি যাতে প্রধান উপদেষ্টা হতে না পারেন, সেজন্য ২০০৪ সাল থেকেই আন্দোলন শুরু করে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের সহিংস আন্দোলনের মুখে ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে একটি বিবৃতি দিয়ে কে. এম. হাসান জানিয়ে দেন, যে তিনি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে চান না।
সংবিধান অনুযায়ী, সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে না চাইলে তার আগের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি আমন্ত্রণ জানাবেন। এভাবে চারটি বিকল্প ছিল সংবিধানে।
কিন্তু কেউ দায়িত্ব নিতে না চাইলে রাষ্ট্রপতি নিজে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেবেন।
বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পদত্যাগের পর বিএনপির মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। তিনি অন্য বিকল্পগুলো না দেখেই নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরাকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
আপাত দৃষ্টিতে সংকট সমাধানে তার এই দায়িত্ব গ্রহণ বলে মনে হলেও সেটা বরং সংকটকে আরও জটিল করে তোলে।
প্রথমে আওয়ামী লীগ কোন আপত্তি না করলেও কিছুদিনে মধ্যেই ইয়াজউদ্দিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ অভিযোগ করে, তিনি বিএনপির দ্বারা চালিত হচ্ছেন।
রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে জটিলতা আরও বাড়ে।
কিন্তু নানা সমালোচনা সত্ত্বেও ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
অবশেষে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙ্গে দেয়া হয়। তিনি আবার সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির বিধিবদ্ধ দায়িত্বে ফিরে যান।
পরের দুই বছর এবং আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ফেব্রুয়ারিতে নতুন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের দায়িত্ব নেয়া পর্যন্ত তিনি নিয়মতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন।