বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫, ২ মাঘ, ১৪৩১, ১৫ রজব, ১৪৪৬

নিপা ভাইরাস: যা জানতে হবে

মুক্তি ৭১ ডেস্ক

নিপা ভাইরাস। আবারও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে দেশে। এ পর্যন্ত আক্রান্ত প্রতি দশ জনের মধ্যে মারা গেছেন সাতজন। যার শুরুটা হতে পারে খুব সাধারণভাবে, খেজুরের রস পানের মধ্য দিয়ে। তবে ফলাফল মোটেও সাধারণ নয়; বাংলাদেশে এ যাবৎকালে আক্রান্ত প্রতি দশ জনের মধ্যে সাতজনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এ ভাইরাস। চিকিৎসকরা বলছেন, নিপা ভাইরাসের কোনো টিকা বা চিকিৎসা নেই। আক্রান্ত হওয়ার পর প্রাণে বেঁচে গেলেও ভুগতে হতে পারে দীর্ঘমেয়াদী নানা জটিলতায়।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর শীত মৌসুমে দেশে ১০ জন নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৭ জনের।
বাংলাদেশে ২০০১ সালে প্রথমবারের মত নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এর পর থেকে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৩৩৫ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৩৭ জন, অর্থাৎ ৭০ দশমিক ৭৪ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে প্রাণঘাতী এ রোগে। দোষটা খেজুর রসের নয়। নিপা ছড়ায় বাদুরের মাধ্যমে। বাদুর কোনো রসের হাড়িতে মুখ দিলে সেখানে ছড়ায় ভাইরাস। আর সেই কাঁচা রস পান করলে ভাইরাস পৌঁছায় মানুষের দেহে। সে কারণে কাঁচা রস পান না করা এবং পাখি বা বাদুরে খাওয়া ফল না খাওয়াই এই রোগ এড়ানোর উপায়।

নিপা ভাইরাস কী?
১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। মালয়েশিয়ার একটি গ্রাম সুঙ্গাই নিপার নামে এর নামকরণ করা হয়। শুকরের মাধ্যমে এই রোগটি প্রথম মানুষের মধ্যে ছড়ায় বলে ধারণা করা হয়। এটি এক ধরনের আরএনএ ভাইরাস। এই ভাইরাসে আক্রান্ত পশু বা আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে এলেই সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে বাতাসে এই ভাইরাস ছড়ায় না।
নিপা ভাইরাস: যা জানতে হবে


আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শুকর ছাড়াও বাদুরের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। বাংলাদেশে যেহেতু শুকর তেমন নেই, তাই বাদুরের মাধ্যমে এটি ছড়িয়েছে বলেই ধারণা করা হয়। ভাইরাসটি মূলত বাদুরের লালা, প্রস্রাব, পায়খানার মাধ্যমে ছড়ায়।
বাদুরের শরীরে কীভাবে এল? ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, বাদুরের শরীরে বিভিন্ন ভাইরাস থাকে, নিপা ভাইরাসও থাকে। বাদুর এই ভাইরাস বহন করলেও আক্রান্ত হয় না। তবে সব বাদুর এই ভাইরাস বহন করে না।
“কিন্তু ভাইরাসটি যখন মানুষের শরীরে আসে তখন মানুষ আক্রান্ত হয়। মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল বাদুর ও শুকর এই ভাইরাস বহন করে। বাদুরের মধ্যে টেরোপাস বা ফুড ব্যাট নিপা ভাইরাসের বাহক।”
এই চিকিৎসক বলেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যত মানুষ নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে তা খেজুরের রসের মাধ্যমে হয়েছে। আর খেজুর রসে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে বাদুর।
“আইইডিসিআর এখন পর্যন্ত যে সার্ভিল্যান্স করছে, তাতে এটা নিশ্চিত বাংলাদেশে বাদুরের মাধ্যমে নিপা ভাইরাস ছড়িয়েছে। এই ফ্লুইডগুলো যেখানে টাচ করবে সেখান থেকেই তা মানুষের শরীরে ছড়াবে। আক্রান্ত একজন রোগীর খুব কাছাকাছি থাকলে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
“তার বডি ফ্লুইডের যদি এক্সচেঞ্জ হয়, যদি সে টাচ করে, রোগীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র যদি পরিষ্কার না করে ফেলে দেয়, তাহলে ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।”

আক্রান্তের লক্ষণ, চিকিৎসা
নাক, মুখগহ্বর দিয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নিপা ভাইরাস। এতে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা, জ্বর, মাথা ঘোরা, বমি, খিঁচুনি হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তি প্রলাপ বকে, অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যায়। শরীরে ভাইরাস প্রবেশের ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, “নিপা ভাইরাস মানুষের মস্তিষ্কে আক্রমণ করে। এতে মস্তিষ্কে এনকেফেলাইটিস (মস্কিষ্কে প্রদাহ) হয়। এনকেফেলাইটিসের বিরুদ্ধে কোনো টিকা, বা অ্যান্টিভাইরাল নেই।
“ভাইরাস শরীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সাধারণ এক সপ্তাহ থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। জ্বর আসে, মাথাব্যথা হয়। যে কারণে শুরুতে কেউ বুঝতেই পারে না। এই জ্বর যেহেতু অন্য জ্বরের মত, লক্ষণগুলো ভাইরাল ফিভারের কাছাকাছি অনেকটা। অজ্ঞান হওয়া, ভুল বকা, খিঁচুনি- এসব না হলে মানুষ বুঝতেই পারে না। এ কারণেই এই রোগে মৃত্যুর হার বেশি।”
এ রোগের চিকিৎসা হয় লক্ষণ ও উপসর্গ দেখে। নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নাই। ব্রেইনের প্রদাহ কমানোর জন্য সম্ভাব্য ওষুধ যেগুলো আছে, সেগুলো দেওয়া হয়।
ডা. নাজমুল বলেন, “রোগীকে আমরা আইভি ফ্লুইড দিই, জ্বর থাকলে জ্বর কমানোর ওষুধ দেওয়া হয়। অবস্থা খুব খারাপ হলে আইসিইউতে নেওয়া হয়।

চলতি শীতে নিপা ভাইরাসে ৫ মৃত্যু
“নিপা ভাইরাসের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম আছে বহু আগে থেকেই। এর চিকিৎসা হচ্ছে লক্ষণ অনুযায়ী। একটা গাইডলাইন তৈরি করা আছে। আমরা রিফ্রেশার্স ট্রেইনিং দিয়েছি চিকিৎসকদের।”

ছড়াচ্ছে যেভাবে
এ বছর সারাদেশে যে দশজন রোগী নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের নয়জনই খেজুরের কাঁচা রস পান করেছিলেন। আর এক রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে একজন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, এ বছর রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, রাজশাহী, নওগাঁ, পাবনা, নাটোর ও ঢাকা জেলায় এই ১০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রাজবাড়ী জেলায় ৪ জন রোগী। ঢাকায় যে ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছেন তিনি চিকিৎসক।
“ওই চিকিৎসক সব ধরনের সতর্কতা মেনে রোগী দেখেছেন, তারপরও তার ইনফেকশন হয়েছে। সে রোগীকে দেখে আসার সময় হয়ত রোগীর ফাইল, ইনভেস্টিগেশনের কাগজ- এগুলো স্পর্শ করেছে, হয়ত সেখান থেকে ভাইরাস চলে এসেছে।” এ ছাড়া আরও কয়েকজন রোগী আছেন, যাদে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। নমুনা পরীক্ষায় নিপা ভাইরাস নেগেটিভ হলেও নিপা ভাইরাস আক্রান্তের সব লক্ষণ উপসর্গ রয়েছে তাদের, তারাও খেজুরের রস পান করেছিলেন বলে ডা. নাজমুল জানিয়েছেন।

কাঁচা খেজুরের রস আর নয়
শীতকাল এলেই মানুষের মধ্যে খেজুরের রস খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রস খাওয়ার ছবিও পোস্ট করেন অনেকে। অনেকে করেন উৎসব।

নিপা ভাইরাস: সতর্কতামূলক ব্যবস্থার নির্দেশনা স্বাস্থ্যের
চিকিৎসকরা বলছেন, এই ভাইরাসের কোনো টিকা নেই, চিকিৎসাও নেই। তাই এ থেকে বাঁচার উপায় খেজুরের কাঁচা রস পান না করা, বাদুড়ে খাওয়া ফল না খাওয়া। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া একদম নিষেধ। তবে খেজুরের জ্বাল দেওয়া রস খাওয়া যাবে, গুড়েও কোনো সমস্যা নাই। কোনো পশু-পাখির আংশিক ফল খাওয়া একদম নিষেধ যেগুলো নিচে পড়ে থাকে।”
দেশের ৩২ জেলার মানুষ নিপা ভাইরাসজনিত জ্বরের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাই হাসপাতালে জ্বর নিয়ে আসা রোগীদের সেবা দেওয়ার সময় সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নিতে চিকিৎসকদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ঢাকার মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ২০টি শয্যা প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে।

নিপা: মায়ের অ্যান্টিবডি পেয়েছে সন্তানও
কর্তব্যরত চিকিৎসকদের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, রোগী দেখার সময় অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। রোগী দেখার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। জ্বরের উপসর্গ দেখা গেলে রোগীকে অবশ্যই আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখতে হবে। জ্বরের পাশাপাশি রোগীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে রোগীকে হাসপাতালের আইসিইউতে রাখতে হবে। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীর পরিচর্যাকারীরা শুধু গ্লাভস, মাস্ক পরলেই হবে। বাংলাদেশে ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় প্রথম নিপা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ২০০৪ সালে সবচেয়ে বেশি ৬৭ জন রোগী শনাক্ত হয়, যার মধ্যে মৃত্যু হয়েছিল ৫০ জনের।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

আলবিদা ২০২৪

২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া লাইফ ইন এ মেট্রো ছবির আলবিদা শিরোনামের গানের লাইন এটি। (উল্লেখ্য বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী জেমসের গাওয়া)। সত্যিই তো আর মাত্র

বিস্তারিত »

‘দিনের পর দিন অনির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ চলতে পারে না’

সংস্কারের কারণে দিনের পর দিন অনির্বাচিত সরকারের হাতে দেশ চলতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) জাতীয়

বিস্তারিত »

সচিবালয়ে প্রবেশ: সাময়িক অসুবিধায় দুঃখ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের সহযোগিতা চায় সরকার

সচিবালয়ে প্রবেশ ইস্যুতে সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের সহযোগিতা চেয়েছে সরকার। শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ভয়াবহ

বিস্তারিত »

স্বামীর ছোড়া অকটেনের আগুনে দগ্ধ গৃহবধূ নাজমা আর নেই

চন্দনাইশে স্বামীর ছোড়া অকটেনের আগুনে দগ্ধ গৃহবধূ নাজমা মারা গেছে। শুক্রবার (২৮ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ৩টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাজমা মারা যায়

বিস্তারিত »

হাসিনা ও রেহানার ব্যাংক হিসাব তলব

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানার ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলব করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সেই সঙ্গে

বিস্তারিত »

জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগানের রায় স্থগিত

২০২০ সালের ১০ মার্চ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল হাই কোর্ট। ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত

বিস্তারিত »

সাংবাদিক মাহবুব উল আলমের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, বাম রাজনীতির নীরব সমর্থক ও সংগঠক, মাইজভাণ্ডারী দর্শন ও মওলানা ভাসানীর একনিষ্ঠ অনুসারী এবং সাহিত্যিক মোহাম্মদ মাহবুব উল আলম হাটহাজারী

বিস্তারিত »

‘কেয়ামতের ফজরেও আ.লীগ রাজনীতি করতে পারবে না’

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য, চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের আমির ও সাবেক এমপি শাহাজাহান চৌধুরী বলেছেন, নবী মুহাম্মদ (স.) যেমন মসজিদের ঈমাম, যুদ্ধের ময়দানেও সেরকম সেনাপতি।

বিস্তারিত »

আন্দরকিল্লায় দুটি সড়কে ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য

ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্যে নগরীর আন্দরকিল্লা এলাকার দুইটি সড়কে যানবাহন তো দূরের কথা পথচারীর চলাচলও কঠিন হয়ে উঠে। ভয়াবহ রকমের বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকা ব্যাটারি রিকশাগুলো পথচারীদের

বিস্তারিত »