দুই মেয়েকে জিম্মায় পেতে আইনি লড়াই করছেন বাবা-মা। কখনো কখনো তাদের সঙ্গে মেয়েরাও আদালতের বারান্দায় ছুটেছে। শেষপর্যন্ত মায়ের কাছেই থাকছে এই দুই শিশু।
রোববার (২৯ জানুয়ারি) দুপুরে এ বিষয়ে রায় ঘোষণা করেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান। আদালত মনে করছেন, মায়ের জিম্মায় থাকলে শিশুদের মঙ্গল হবে। তাই দুই শিশুকে জিম্মায় নিতে বাবা যে আবেদন করেছিলেন তা খারিজ করে দেন আদালত।
এই দুই শিশুর নাম জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা। তাদের নিজ নিজ জিম্মায় নিতে প্রায় দেড় বছর আইনি লড়াই করেন জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো ও বাংলাদেশি প্রকৌশলী ইমরান শরীফ।
সবশেষ আদালত মায়ের হাতেই ছেড়ে দেন দুই শিশুকে। রায়ে আদালত জানান, মেয়েদের নিয়ে জাপান যেতে পারবেন তাদের মা। এছাড়া দুই শিশুর বাবা ইমরান শরীফ যে মামলা করেছিলেন তাও খারিজ করে দেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, নাবালক বা নাবালিকা- তাদের হেফাজত নির্ণয়ে সবচেয়ে বেশি মঙ্গল যেটি তা গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক, মানুষিক ও পারিপার্শ্বিক তথা সব কিছু বিবেচনায় রেখে মামলা নিষ্পত্তিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া বাবার কাছে থাকলে মেয়ে দুটির মঙ্গল হবে কিনা তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের বাবা।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক আরও বলেন, নাবালিকা দুই শিশুর বসবাসের স্থান জাপান। তাদের মা জাপানের চিকিৎসক। তাই মায়ের হেফাজতে তাদের শারীরিক-মানসিক নিরাপত্তা থাকবে বলে মনে করেন আদালত।
জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকোর আইনজীবী শিশির মনির বলেন, এটি একটি যুগান্তকারী রায়। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট।
এদিকে ইমরান শরীফের আইনজীবী নাসিমা আক্তার লাভলী বলেন, এই আদেশের বিরুদ্ধে আমরা আপিল করবো। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দুই সন্তান বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই।
এই আইন অনুযায়ী, ‘অভিভাবক বলতে যে ব্যক্তি কোনো নাবালকের শরীর অথবা সম্পত্তির বা শরীর ও সম্পত্তি দুয়ের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত থাকবে- তাকে বুঝাবে। বাংলাদেশে আইন অনুযায়ী, তালাক হলে এবং তাদের ছেলে সন্তান সাত বছর পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকবে। এক্ষেত্রে মায়ের অধিকার সবার আগে স্বীকৃত।’
২০০৮ সালে জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকোর সঙ্গে বাংলাদেশি প্রকৌশলী ইমরান শরীফের বিয়ে হয়। দাম্পত্য কলহের জেরে ২০২০ সালের শুরুতে বিচ্ছেদের আবেদন করেন এরিকো। এরপর ইমরান স্কুলপড়ুয়া বড় দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। আর ছোট মেয়ে থেকে যান জাপানে মা এরিকোর সঙ্গে।
তবে ওই দুই মেয়েকে জিম্মায় পেতে মহামারির মধ্যে ২০২১ সালে বাংলাদেশে আসেন এ জাপানি নারী। তিনি হাইকোর্টে রিট করলে তাদের সমঝোতায় আসতে বলেন বিচারক। তবে ওই দম্পতি সমঝোতায় না আসায় কয়েক মাস ধরে শুনানির পর হাইকোর্ট দুই সন্তানকে বাবার হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্ত দেন। পাশাপাশি মা যাতে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে বাবাকে খরচ দিতে বলা হয়।
এরপর হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন নাকানো এরিকো। পরে আপিল বিভাগ এক আদেশে শিশু দুটিকে মায়ের জিম্মায় রাখার নির্দেশ দিলেও বাবা তা না মানায় বিচারকরা উষ্মা প্রকাশ করেন। পরে আদালত শিশু দুটিকে বাবার হেফাজত থেকে এনে তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং পরে মায়ের হেফাজতে দেওয়ার আদেশ দেন।
এরপর এই দুই মেয়ে কার জিম্মায় থাকবে তার নিষ্পত্তি পারিবারিক আদালতে হবে এবং তার আগ পর্যন্ত দুই শিশু তাদের মায়ের কাছেই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দেন আপিল বিভাগ। গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি এই আদেশ দেওয়া হয়। এরপর আপিল বিভাগ থেকে মামলাটি পারিবারিক আদালতে যায়।
এসব ঘটনার মধ্যে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর রাতে দুই সন্তান নিয়ে জাপানে যাওয়ার জন্য ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান এরিকো নাকানো। আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে সন্তানদের নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় তাকে বিমানবন্দর থেকে পুলিশ ফিরিয়ে দেয়।
এ ঘটনায় ২৯ ডিসেম্বর দুই সন্তানের বাবা ইমরান শরিফ ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরাফাতুল রাকিবের আদালতে মামলা করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।