দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি, গ্যাস-পানির দাম বাড়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এর মধ্যেই অধিকাংশ এলাকায় বাড়িভাড়া বাড়ার নোটিশ পাচ্ছেন ভাড়াটেরা। বছরের শুরুতেই গুনতে হবে ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি বাড়িভাড়া। এই বাড়তি ব্যয় নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে আছেন অনেক ভাড়াটে।
যাঁরা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাঁদের আয়ের একটা বড় অংশ চলে যায় বাড়িভাড়ায়। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর অনেক বাড়িওয়ালাই বাসাভাড়া বাড়াননি। এবার ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই বাড়িওয়ালারা নানা যুক্তিতে বাড়িভাড়া বাড়ানোর নোটিশ দিতে শুরু করেছেন।
রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, ধানমন্ডি, রামপুরা, উত্তরা, শ্যামলী, মগবাজার, খিলগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকার ২০ জন ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন বছরের শুরু থেকেই বাড়িভাড়া বাড়বে বলে বাড়িওয়ালারা জানিয়ে দিয়েছেন। শুধু ঢাকা নয়, অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও বাড়িভাড়া বাড়ানো হচ্ছে।
গত ১৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৬ গুণের বেশি। ভাড়াটেদের স্বার্থ রক্ষায় দেশে তিন দশক আগে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন হয়। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। এলাকাভিত্তিক বাড়িভাড়া নির্ধারণে একটি কমিশন গঠনে সাড়ে সাত বছর আগে উচ্চ আদালত রায় ঘোষণা করেন। রায়ের লিখিত কপি বের না হওয়ায় কমিশন গঠনের কাজও এগোয়নি।
রাজধানীর পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকায় দুই কক্ষের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন মাহমুদা হক। এত দিন ভাড়া ছিল ৯ হাজার টাকা। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিল আলাদা। সার্ভিস চার্জ ছিল এক হাজার টাকা। বাড়িওয়ালা জানুয়ারি থেকে ভাড়া এক হাজার টাকা বাড়াবেন বলে জানিয়েছেন। বেসরকারি হাসপাতালের চাকুরে মাহমুদা প্রথম আলোকে বলেন, বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় বাড়িওয়ালাকে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, দুই বছরে বাড়বে না। এখন খরচ বেড়ে যাওয়ার যুক্তিতে বছর না ঘুরতেই ভাড়া বাড়াচ্ছেন। খরচ তো ভাড়াটেদেরও বেড়েছে, সেটা যেন দেখার কেউ নেই।
# ১৫ বছরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৬ গুণের বেশি
# তিন দশক পুরোনো বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর নেই
# সিটি করপোরেশনের গৃহকর তালিকার কয়েক গুণ বেশি ভাড়া আদায়
# ঢাকার বাইরেও বাড়ছে ভাড়া
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১০ শতাংশ।
গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পেট্রল, অকটেন, ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম সাড়ে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়। এর আগে কখনোই জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে এতটা বাড়ানো হয়নি। তাই আগস্টের শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। এ ছাড়া যাতায়াত, পোশাক, শিক্ষাসামগ্রীর মতো খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও বেড়েছে। এর মধ্যে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির নোটিশে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন অনেক ভাড়াটে।
বাড়িভাড়া বেড়েছে লাগামহীনভাবে
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে রাজধানীতে দুই কক্ষের একটি বাসার ভাড়া ছিল ৪ হাজার ৫৩৩ টাকা। ২০২১ সালে এই ভাড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরে ভাড়া বেড়েছে ৬ গুণের বেশি। শতাংশের হিসাবে এই সময়ে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৬২৮ শতাংশ।
ভাড়াটেরা বলছেন, বাড়ির মালিকেরা ইচ্ছেমতোই বাড়িভাড়া বাড়ান। বৃদ্ধির পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করে বাড়ির মালিকের সঙ্গে ভাড়াটের সম্পর্কের ওপরেও। বাড়িভাড়া বাড়লে এর সঙ্গে অন্যান্য খরচও বাড়ে। কিন্তু চাকরিজীবীদের আয় সেভাবে বাড়ে না। তারপর সন্তানদের পড়ালেখার খরচ ও বাজার খরচ তো আছেই।
রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় ১ হাজার ৪৫০ বর্গফুটের বাসায় থাকেন সজল মিত্র। এত দিন ভাড়া ছিল ৩০ হাজার টাকা। জানুয়ারি থেকে ৩ হাজার টাকা বাড়তি দিতে হবে। সজল প্রথম আলোকে বলেন, কোন এলাকায় কত ভাড়া বাড়ানো যাবে, সেটার তো কোনো বিধি-নীতি নেই। এ কারণেই বাড়িওয়ালারা সুযোগ পান।
বাসাভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে বাড়িওয়ালারা নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, গৃহঋণের সুদ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বৃদ্ধিসহ নানা যুক্তি দেখান। মোহাম্মদপুর শেখেরটেক এলাকার বাড়িমালিক ইশতিয়াক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে কয়েক মাস একাধিক ফ্ল্যাট ফাঁকা ছিল। তখন ভাড়া বাড়ানো হয়নি। এবার ভাড়াটেদের আলোচনা করে যতটা না বাড়ালেই নয়, ততটাই বাড়ানো হয়েছে। তিনি তাঁর বাড়ির ফ্ল্যাটভেদে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা ভাড়া বাড়িয়েছেন বলে জানান।
ঢাকার বাইরেও বাড়ছে ভাড়া
সাভারের জাহাঙ্গীরনগর সোসাইটিতে ভাড়া থাকেন ফাতেমা বিনতে শরীফ। এখন ভাড়া দেন ১১ হাজার টাকা। ফাতেমা প্রথম আলোকে বলেন, ‘১১ মাস হলো এই বাসায় উঠেছি। বাড়িওয়ালা জানিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে ১ হাজার টাকা বাড়তি দিতে হবে।’
সিলেটের উপশহর এলাকার যতপুরে দুই কক্ষের একটি বাসায় থাকেন গাজী মাহবুব। বাসার ভাড়া ১০ হাজার ২০০ টাকা। তিনি বলেন, জানুয়ারি থেকে দেড় হাজার টাকা বাড়িভাড়া বাড়বে। বাড়িওয়ালা বলছেন, সবকিছুর দাম বেড়েছে তাই ভাড়া বাড়াচ্ছেন।
নারায়ণগঞ্জ শহরে দুই কক্ষের বাসায় ভাড়া থাকেন মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, এখন ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। আগামী মাস থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা দিতে হবে। এমন বাড়তি ভাড়া কর্মজীবীদের জন্য অতিরিক্ত চাপ।
আইন কার্যকর না, কমিশনও হয়নি
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনটি ১৯৯১ সালের। ভাড়াটেদের স্বার্থ রক্ষায় অনেক কথাই উল্লেখ আছে এই আইনে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। সরকার এখনো এই আইনের বিধি করেনি। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১-এ বলা আছে, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার অধিক বৃদ্ধি করা হলে ওই অধিক ভাড়া, কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও আদায়যোগ্য হবে না।
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ কার্যকর করতে ২০১০ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) নামের একটি সংগঠন জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। রিট আবেদনটির পরিপ্রেক্ষিতে রুল ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১ জুলাই আদালত রায় দেন।
ঘোষিত রায়ে বলা হয়, বিদ্যমান আইনটি কার্যকর না হওয়ায় ভাড়াটেদের সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। আইনটি কার্যকরে রাষ্ট্রকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে, অন্যথায় সাধারণ মানুষ এ থেকে পরিত্রাণ পাবেন না। রায়ে সারা দেশে এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বাড়িভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। রায় ঘোষণার ছয় মাসের মধ্যে কমিশন গঠন করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
রিট আবেদনকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, রায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রায় লেখার আগেই রায় প্রদানকারী বিচারপতি মারা যান। ফলে নতুন করে শুনানির সিদ্ধান্ত হয়। আগের রিটের সঙ্গে আইনের বিষয়ে সম্পূরক রুল চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি এখনো শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
গৃহকরের কয়েক গুণ ভাড়া আদায়
এলাকাভিত্তিক গৃহকর আদায়ের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১০টি অঞ্চলের সম্ভাব্য বাড়িভাড়া নির্ধারণ করেছে। মূল সড়কের পাশে, সড়কের ৩০০ ফুটের মধ্যে এবং সড়কের ৩০০ ফুটের বাইরে এই তিন শ্রেণিতে ভবনের বাড়িভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন যে হারে গৃহকর আদায় করে, বাড়ির মালিকেরা তার কয়েক গুণ বেশি বাড়িভাড়া নিচ্ছেন।
সিটি করপোরেশনের তালিকা অনুযায়ী, মিরপুর ২ নম্বর এলাকায় মূল সড়কের পাশে বাড়ির ভাড়া বর্গফুটপ্রতি সর্বোচ্চ সাড়ে ছয় টাকা। সে হিসাবে এক হাজার বর্গফুটের একটি বাড়ির ভাড়া হওয়ার কথা সাড়ে ছয় হাজার টাকা। মিরপুর এলাকায় মূল সড়কের পাশে এই আয়তনের একটি বাসার ভাড়া ১৮ থেকে ২২ হাজার টাকা।
সিটি করপোরেশনের তালিকা অনুযায়ী, উত্তরা এলাকায় মূল সড়কের পাশের ভবনে প্রতি বর্গফুটের সর্বোচ্চ ভাড়া ৯ টাকা এবং সড়কের ৩০০ ফুটের ভেতরে পর্যন্ত সর্বনিম্ন ভাড়া সাড়ে ৬ টাকা। গৃহকরের তালিকা অনুযায়ী, ফার্মগেটসংলগ্ন মনিপুরি পাড়ায় সড়কের পাশে প্রতি বর্গফুটের সর্বোচ্চ ভাড়া সাড়ে সাত টাকা আর সর্বনিম্ন ভাড়া ছয় টাকা। বাস্তবে এই হারে উত্তরা ও মনিপুরি এলাকায় বাসা ভাড়া পাওয়া অসম্ভব।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনেরও গৃহকরের এলাকাভিত্তিক বাড়িভাড়ার চার্ট রয়েছে।
সেখানেও বাড়িভাড়া গৃহকরের তালিকার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। বাড়িভাড়া বিষয়টির ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলে মনে করেন নগর গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আবাসন মৌলিক অধিকার। বিপুলসংখ্যক ভাড়াটের চাহিদার বিষয়টি সরকার উপেক্ষা করেছে। বাড়িওয়ালারা একচেটিয়াভাবে ভাড়া বাড়িয়েছেন। একটি কমিশন বা বোর্ড করে বাড়িভাড়ার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।-প্রথম আলো